এস পি বালাসুব্রামনিয়াম : সুরের ভুবনের অতুলনীয় শিল্পী – লিখেছেন সায়ন্তনী দাশ সান্যাল

রাহুল দেববর্মন ও জাভেদ আখতারের তখন একটাই চিন্তা, কি করে কিশোর কুমারের নাটকীয়কায় ভরা দুষ্টু মিষ্টি কন্ঠস্বরের সঙ্গে অপর গায়কের গায়কীর মেলবন্ধন হবে। কারণ, ছবির দুইজন নায়কের একজন ঋষি কাপুরের লিপে থাকবে কিশোরকুমারের কন্ঠ। আরেকজন নায়ক হলেন কমল হাসান, তার লিপেও এক প্রাণোচ্ছল গায়কীর দরকার নয়তো ডুয়েট জমবে না।কমল হাসানের লিপে যখন এস পি বালাসুব্রামনিয়াম কে দিয়ে গাওয়ানো হলো, তখনও পঞ্চম ও জাভেদ সাহেব চিন্তিত, গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু ছবি রিলিজের পর গানটি ইতিহাস, ছবির নাম ‘সাগর’ ও গানটি হলো ‘ইউহি গাতে রহো, মুসকুরাতে রহো’, একটি কন্ঠস্বর অপরের পরিপূরক, কোথাও বেসুরো বাজলো না।
এর আগেও দক্ষিণী পরিচালক কে বালচন্দরের ছবি ‘ এক দুজে কে লিয়ে’ তে বর্ষীয়ান সঙ্গীত পরিচালক লক্ষীকান্ত-পেয়ারেলাল জুটির সুরে কমল হাসানের লিপে বিখ্যাত হয়েছে এস পির একাধিক গান, ‘ মেরে জীবন সাথী পেয়ার কিয়ে যা’, ‘তেরে মেরে বিচমে ক্যায়সা হ্যায় ইয়ে বন্ধন’ ‘হাম বনে তুম বনে এক দুজে কে লিয়ে’। অদ্ভুত ভরাট, মেলোডিয়াস কন্ঠস্বর , শোনার পর হৃদয়ে রেশ থেকে যায়। ‘এক দুজে কে লিয়ে’ ছবির গানের জন্য ফিল্মফেয়ারে নমিনেশন মিললো প্রচুর, কিন্তু প্রকৃত পুরস্কার এলো জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চ থেকে। সারা জীবনে ছয়টি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন এস পি বা বালু।
এস পির জন্ম নেল্লোরে 1946 সালে। বাবা ছিলেন লোকশিল্পী। ফলে বাড়িতে একটা শিল্প চর্চার পরিবেশ ছিলই। তবে এস পি চেয়েছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে। তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের জওহরলাল নেহেরু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু ওই যে, অন্য জায়গায় বোধহয় তার ভাগ্য অন্যরকম ই লেখা হচ্ছিল। টাইফয়েডের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিগ্রি অর্জন করতে পারলেন না এস পি। শুরু হয় সঙ্গীতচর্চা। তেলেগু, কন্নড়, তামিল সঙ্গীত জগতের তাবড় পরিচালকদের সাথে কাজ করলেন তিনি। সুরের জাদুতে দক্ষিণ মাতিয়ে পা রাখলেন বলিউডে। জেসুদাসের পর দ্বিতীয় পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে তিনি মুম্বাইতে আসেন।
এস পির বলিউডে গাওয়া প্রথম ছবি ‘এক দুজে কে লিয়ে’। এরপর ধর্মেন্দ্র সাহেবের ‘ম্যায় ইন্তেকাম লুঙ্গা’, জিতেন্দ্র ও রেখা অভিনীত ‘এক হি ভুল’ ছবিতে তাদের লিপ এ এস পির জাদু ভরা গলা শুনতে পাওয়া যায়।
এস পির বলিউডের কাজ কে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ পূর্ববর্তী ও ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া পরবর্তী পর্যায়। যদি কখনো আপনাকে প্রশ্ন করা হয় যে সুপারস্টার হওয়া ছাড়া কমল হাসান ও সলমন খানের মধ্যে সাদৃশ্য কি? আপনি নির্দ্বিধায় উত্তর দিতে পারেন তাদের দুজনের সাথেই এস পির মায়াময় কন্ঠ এক হয়ে গিয়েছিল। কমল হাসানের ডাবিংও এস পি করতেন। সলমনের কথায় আসি। এখনকার ভাইজান বা দাবাং এর সলমন নয়, বলিউডে রোমান্টিক নিষ্পাপ হিরো হিসেবে প্রবেশ সলমন খানের। ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’, ‘লাভ’, ‘ পাত্থর কে ফুল, ‘ সাজন’ , ‘ হাম আপকে হ্যায় কৌন’ একেরপর এক ছবিতে এস পির গান আর সলমনের রোমান্টিকতা জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে ফেলে। ছবি হিট হোক বা ফ্লপ , গান গুলি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। যেমন, ‘লাভ’ ছবিতে চিত্রার সঙ্গে গাওয়া ‘ সাথিয়া তুনে ক্যায়া কিয়া’ আজও প্রেমিক প্রেমিকার মনে আলোড়ন তোলে। তেমনই ‘পাত্থর কে ফুল’ ছবির লতা মঙ্গেসকরের সঙ্গে ডুয়েট , ‘ কভি তু ছলিয়া লাগতা হ্যায়’ গানের নেশাধরানো গায়কী ও তার সাথে সলমন ও রবিনার প্রাণোচ্ছল অভিনয় নব্বই টিনএজারদের মাতিয়ে দেয়।
‘ বহুত পেয়ার করতে হ্যায় তুমকো সনম’ , ‘ পেহলা পেহলা পেয়ার হ্যায়’, ‘ মেরে রংমে রংনে ওয়ালি’ ‘ দিল দিওয়ানা বিন সাজনা কে মানে না’আজও মুখে মুখে ঘোরে।
এ আর রহমানের প্রথম বলিউডে কাজ ‘রোজা’। কে ভুলতে পারে অরবিন্দ স্বামীর ওষ্ঠে ব্যাথাতুর ‘রোজা জানেমন তু হি মেরা দিল’ বা অসাধারন পার্বত্য নিসর্গে নব দম্পতির খুনসুটির ব্যাক গ্রাউন্ডে বেজে ওঠা ‘ ইয়ে হাসিন বাদিয়া এয় মেরে সাজনা’।তবে এরপর প্রায় দেড় দশক বলিউড থেকে দূরে সরে থাকেন বালু। তাঁর বলিউডের শেষ গান ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ছবি তে।
অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন। গত 25শে সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন এস পি বালাসুব্রামনিয়াম। ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত এই অসাধারণ গায়কের একটা আক্ষেপ বোধহয় ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি না পাওয়ার। আর তাঁর শ্রোতাদের আক্ষেপ থেকে গেল তাদের আদরের বালু-র কাছ থেকে আর সংগীত উপহার পাওয়া যাবে না বলে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।