মেহফিল -এ- কিসসা কবিতা: ডিসেকশন ও আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ শাপলা সপর্যিতা

পেশা শিক্ষকতা। অরণী বিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত হয়েছে এই পৃথিবী এই দেশ ও নিভৃত পরবাস নামে দুটি কবিতার বই। টাইমমেশিন ও গুপ্তহত্যা অতঃপর নামে দুটি বড় গল্পের বই। মূলত উপন্যাস লিখছেন। বর্তমানে ‘সম্পর্কটি শুধুই জৈবিক’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন। ঢাকায় বসবাস করেন।

কবিতা:ডিসেকশন ও আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ – ১০

আমার বন্ধু নিরঞ্জন – ভাস্কর চৌধুরী

আজ দেশ কাল সমাজ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই রাজনৈতিক কিংবা ক্ষলিত মানবিকতার চুড়ান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে আমার ‘আমার বন্ধু নিরঞ্জন’ কবিতাটির প্রেক্ষাপট আমার কাছে বড়ো সংলগ্ন ভীষণ মূল্যবান হয়ে উঠেছে। কবিতাটি আবার নতুন করে পড়তে পড়তে তার ব্যবচ্ছেদের শব্দ সাজাতে সাজাতে আমার এই কথাটাই বার বার মনে হচ্ছে। এ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিল স্রোত আবৃত্তি সংসদের উজ্জ্বলতর আবৃত্তিকারদের একজন মাহফুজ মাসুম। আমি স্রোত আবৃত্তি সংসদের চতুর্থ কর্মশালা করে দলে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই। ঠিক পরের বছরই পঞ্চম কর্মশালায় দলে যোগ দেয় মাহফুজ মাসুম তওহিদুল ইসলাম স্ট্যালিন শান্তা শ্রাবণী শারমিন মুস্তাফা শফিকুল ইসলাম এই রকম আরও এক ঝাঁক উজ্জ্বল আবৃত্তিকার। তার মধ্যে মাসুম অন্যতম। পরবর্তীতে এরা সবাই আমার অসাধারণ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আজও আছেন। অদ্ভুত সুন্দর খেয়ালি অথচ টগবগে এক মানুষ আমাদের এই বন্ধু মাসুম। প্রথম প্রথম যখন এই কবিতাটি পড়তে শুরু করে তখনও ওর ভীষন রকম উচ্চারণে আঢ়ষ্টতা। নানা শব্দে মাঝে মধ্যে দারুণ রকম গোলমালে বেসামাল। তারওপর ওর বরিশালের আঞ্চলিকতার ওপর দারুণ ভালোবাসা। আবৃত্তি করার সময়টুকু বাদ দিলে আমাদের সাথে বাকি সময়টাতে ও বরিশালের আঞ্চলিক টানেই যত দুষ্টুমী করে চলে। হালকা চটুল মেজাজে ভারবহ বেদনা কিংবা দুঃসহ যাতনা অতিক্রম করা অথবা দলের প্রয়োজনে কোনো গুরুত্বপূ্র্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া খুব সহজেই সম্ভব হতো মাসুমের দ্বারা। দারুণ খোশমেজাজী এক মানুষ দেখেছি আমি ওকে বাকি সারাটা আবৃত্তিজীবনের যতদিন দলের হয়ে কাজ করেছি। আবার দলের প্রয়োজনে কঠোর হতেও দেখেছি তাকে। নিজের ব্যক্তিত্বের প্রখরতম প্রাবল্যে, মেধার তীক্ষ্ণধারের সাবলীলতায় একসময় দলের খুব প্রয়োজনীর এবং শক্তিশালী মানুষ হয়ে উঠেছিল মাসুম। আমাদের সেই বন্ধু মাসুমের জন্য বরাদ্দ হলো ভাস্কর চোধুরীর কবিতা ‘আমার বন্ধু নিরঞ্জন’।
কবিতাটি আসলে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমে নিজেকে সঁপে দেয়া এক দারুনতর রাজনীতিকের গল্প। যে গল্পটি সাধারণ পাঠক ও স্রোতার সামনে বলে চলেছেন তারই বন্ধু যিনি লিখছেন কবিতাটি। কোনো ব্যক্তির জীবনে প্রেম এক জটিল ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের আবহে নির্মিত ভীষণ পরীক্ষা। কারো কারো জীবনে প্রেমই সকল। কারো কারো কেন হবে সকল মানুষেরই জীবনে প্রেম আরাধ্য, প্রেম সর্বস্ব, প্রেম নবজীবনদায়িনী প্রেম জীবনধাত্রীও কখনো। কিন্তু কোন সে প্রেম এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজেই আমাদের জীবন হয়তো অস্তমিত হতে চলে। অথচ নিজের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিরঞ্জনকে কবি আবহমান কাল ধরে চলে আসা দ্বিধার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একজন রাজনীতিকের বলিষ্ঠ ভাবনা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের কোনো ধরণের জায়গা না রেখে যে অসাধারণ এক্ চরিত্র নির্মাণ করেছেন তা আমাকে চিরকাল বিস্মিত করে রেখেছে। কবির বন্ধুর জীবনে নারী প্রেম ছিল। কিন্তু যে নারী পেছনে টেনে রাখতে চেয়েছে, ঘরের চারদেয়ালে বন্দী করতে চেয়েছে নিরঞ্জনকে সে নারী তার কাম্য নয়। ব্যক্তিক ভালোবাসাকে মানুষের স্বার্থে বিসর্জন দেবার কথা নিরঞ্জনের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। তাই নিরঞ্জনের প্রেমিকা জয়লতার চিঠিটি খুব সহজে কবিকে পড়তে দিয়েছেন নিরঞ্জন আর কবির কৌতুহলকে দ্বিধাহীন চিত্তে নিবৃত্ত করেছেন কয়েকটি কথায়ই;
-আমার ঘরে, বসে সিগারেট টানতে টানতে
নিরঞ্জন চিঠিটা চুপ করে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘বিভূ, চিঠিটা পড়ুন’।
নিরঞ্জনের নারী প্রেমের প্রতি এক দারুণ নির্বিকার রূপ পরের কয়েকটি পংক্তি পড়বার সাথে সাথেই আমাকে দারুনভাবে আহত করেছিল। প্রেমে বিশ্বস্ত হলে সম্মানের কিংবা ভালোবাসার মায়ায় ঋদ্ধ যে প্রেমিক তার কি এমনিই ভাবান্তর হবার কথা!
-আমি প্রথমে পড়তে চাইনি।
পরে ওইটুকু পড়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম-
না-ওই সিগারেটের ধুঁয়োয়
আমি কোনো নারী-প্রেম-তাড়িত মানুষের ছায়া দেখিনি-ভয়ানক নির্বিকার।
কিছু বলছেন না যে? আমি প্রশ্ন করেছিলাম
কী বলবো?
এই ব্যাপারে?
কোন ব্যাপারে?
এই যে জয়লতা।
বাদ দিন।
আসলে কি লেখা ছিল ওই চিঠিটিতে? জয়লতা নিরঞ্জনকে লিখেছিল তাকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে তুলে নিয়ে যেতে। না হলে অন্য পুরুষ তার দখল নিয়ে নিতে পারে সত্ত্বর। আর এই চিঠি পড়ে যে প্রেমিক নির্বিকার নীরব তাকে আপাত দৃষ্টে একজন ভণ্ড প্রেমিক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রেমিকার প্রতি এক নীরব অসম্মান সাধারণের মনকে পর্যুদস্থ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসলে কি তাই? যে নিজেকে নিয়োজিত করেছে অন্যের সেবায় তার কি ব্যক্তিগত প্রেম ভালোবাসা নিয়ে এতটা বিক্ষেপ মানায়? এই যে নিজের অবস্থানকে দ্বিধাহীনভাবে নিশ্চিত করা সংশয়াতীর্ণ অবস্থায় প্রেমিকাকে দূরে সরিয়ে দেয়া যাতে আপাত শ্লাঘা থাকলেও সে মানুষের প্রতি তুমুল ভালোবাসা শ্রদ্ধা আর সম্মানেরই প্রতিরূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেকে নিচের কয়টি শব্দে। যখন কবি নিজেই জয়লতা সম্পর্কে বিষোদগার করছেন
-জয়লতার সাথে অন্য পুরুষের বিয়ে হয়েছিল
আমি জয়লতা এবং অন্য পুরুষটিকে দেখেছি বহুবার, বিশ্ববিদ্যালয়েই
জয়ললতা আরও দেমাগী আর সুন্দরী হয়ে উঠেছিল
অন্য পুরুষ ছিবড়ে খেলে মেয়েরা বুঝি আরো সুন্দরী হতে থাকে?
এ কথার সূত্রে সেদিন নিরঞ্জন আমাকে বলেছিল
মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না,
মানুষ এত বড় যে,
আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে উচ্চারণ করেন
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’
তো আপনি কাঁদবেন।
আমি মানুষের পক্ষে, মানুষের সঙ্গে এবং মানুষের জন্য।
এই লাইনগুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরে কবিতাটি শুরুর গল্পে যে ক্লেদ জমা হতে শুরু হয়েছিল তার সব কেমন যেন উড়ে উড়ে উধাও হতে শুরু করে দেয়। তারপরের লাইনগুলো মানুষ নিরঞ্জনকে মানুষের জন্য নিবেদিত নিরঞ্জনকে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেয়া নিরঞ্জনকে আরও এক উর্ধ্বতর সত্তায় তুলে আনে
-‘তুমি দুষ্কৃতি মারো, বাঙ্গালী মারো,
হিন্দু-মুসলমান মারো, গেরিলা-তামিল মারো
এভাবে যেখানে যাকেই মারো না কেন
ইহিতাস লিখবে যে এত মানুষ মরেছে
বড়ই করুণ এবং বড়ই দুঃখজনক
শক্তির স্বপক্ষে তুমি যারই মৃত্যু উল্লেখ করে উল্লাস করনা কেন
মনে রেখো মানুষই মরেছে।’
অসাধারণ এক বোধের, দুর্দান্ত আবেগের সম্নোহনে সম্মোহিত করে তুলেছেন কবি কবিতাটির পরবর্তী লাইনগুলোতে। যেখানে দ্বিধাহীনভাবে জয়লতাকে ফিরিয়ে দেয়া নিরঞ্জনকে মানুষ ভালোবাসাতে শুরু করে দেয়। যে নিরঞ্জন মানুষকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চিরকাল সোচ্চার ছিল। যে নিরঞ্জন মানুষের অধিহার হননের বিরুদ্ধে শব্দে শব্দে প্রতিবাদ করেছিল। যে নিরঞ্জন বিচার বর্হিভূত মানুষ হত্যার প্র্রতিবাদে প্রতিবাদী হাত উঠিয়েছিল আর যে নিরঞ্জন জানতো একদিন তার এ হাতকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্র উন্মুখ। শক্তিশালী শাসক, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখবার রাজনীতি, মানুষ হত্যার রাজনীতি একদিন তার এই হাত ভেঙে দেবেই। তার এই কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবেই। তবু সে হাত উত্তোলিত রাখবে। তাই সে জয়লতাকেও নির্বিকার চিত্তে ফিরিয়ে দিয়েছিল। যে জয়লতার সুখে থাকার গল্পে তাই নিরঞ্জনের হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়নি, কোনো বিদ্বেষ তৈরি হয়নি জয়লতা যখন অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী ও সুন্দর হয়েছিল তখন সে জয়লতাকে মানুষ হিসেবে ঘোষনা করে নিজের মহত্তর হৃয়য়াবেগকেই উর্ধ্বতর সত্ত্বায় তুলে ধরেছিল। পরের লাইনগুলোতে একজন বিপ্লবী নিরঞ্জনকে এমন হৃদয়াবেগে অঙ্কন করা হয়েছে যে গভীরে পাঠ করলে পাঠকের চোখে জল আসতে বাধ্য
-‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না। মানুষকে বাঁচতে দাও’।
নিরঞ্জন বাঁচেনি।
তার উদ্যত হাতে লেগেছিল মানুষের হাতে বানানো বন্দুকের গুলি
বুকেও লেগেছিল-
যেখান থেকে ‘মানুষ’ শব্দটি বড় পবিত্রতায় বেরিয়ে আসতো।
অসাধারণ একটি গল্প পুরো কবিতাটি জুড়ে এঁকেছেন। ভীষন সহজসুন্দর এক চিত্রকল্পও পাঠক খুব সহজেই দেখতে পাবেন কবিতাটির পাঠের আড়ালে আবডালে। মনের গভীরে ফুটে উঠবে যেন এক দ্ব্যর্থহীন মানবপ্রেমিকের করুণ প্রেমের আখ্যান। আখ্যানের শেষে যখন এই রাষ্টযন্ত্রের হাতে-নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে স্থির অচঞ্চল শাককের হাতে- মানুষের হাতেই নির্মম ভাবে নিহত হয় নিরঞ্জন
-সে লাশ আমার বন্ধু নিরঞ্জনের লাশ;
আমি দেখেছি রক্তাক্ত ছিন্ন ভিন্ন লাশ,
মানুষ কাঁধে করে তাকে বয়ে এনেছিল মানুষের কাছে।
জয়লতা সে লাশ দেখেছিল কি না সে প্রশ্ন উঠছে না।
দেখলেও যদি কেঁদে থাকে সে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে
তাতে নিরঞ্জনের কোনো লাভ হয়নি।
মানুষ কেঁদেছিলি
আমি জানি তাতে নিরঞ্জনের লাভ ছিল
কবিতাটি শব্দে শব্দে বাক্যে আর ভাষার ব্যবহারের মাধুর্যতে একজন মানুষের জাগতিক বেদনার আড়াল কিংবা মানুষের জন্য দ্বিধাহীন প্রেমের কিংবা বিসর্জনের এক অপরূপ ছবি ফুঠে উঠেছে। নিজের বেদনা কিংবা আনন্দ, ভালোবাসা কিংবা বিদ্বেষ সকলই ধারণ করার পক্ষে ভীষণ রকম নির্লিপ্ত স্বল্পবাক একজন মানুষের এমন ছায়াছবি অসম্ভব সুন্দরতর করে তুলে এনেছিল সেদিন মাসুম। যে মাসুম, গল্পের চরিত্রটির ঠিক বিপরীত কাঠামো নিয়ে আমাদের সামনে বরাবর আবর্তিত হতো সে মাসুম এত সুন্দর করে নির্মাণ করেছিল কবিতাটি যে আজও তার কথা মনে পড়ে গেলে আমি মুগ্ধ হয়ে থাকি। অসম্ভব পরিশ্রম করেছিল কবিতাটি নির্মাণের শুরুতে। আর সে ধৈর্য নিষ্ঠা পরিশ্রমের সকল তুলে এনেছিল মঞ্চে আবৃত্তি করার সময়। কবিতাটি নির্মাণের শুরুতে যে সংশয় দ্বিধা তার সব হারিয়ে গিয়ে এমন একটি ছবি সেদিন স্রোতার মনে আঁকতে পেরেছিল আবৃত্তিকার তা কেবল সেদিন পাবলিক লাইব্রেরীর হল ভরা স্রোতাই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন। কবির কবিতারও ওপর নির্মিত হয়েছিল সেদিন আরও অন্য এক মুগ্ধশ্রবণ নতুন কবিতা, ‘আমার বন্ধু নিরঞ্জন’। তখন কতটা গভীরে পাঠ করেছি বা অবলোকন করেছি কিংবা অনুভব করেছি এক একটি কবিতা, কি মুগ্ধ চিত্তে কি আবেগে কি আদরে বুকের নিভৃতে তুলে রেখেছি তা এতকাল বুঝতে পারিনি। এই ধারাবাহিক লিখতে না বসলে হয়তো আজও নিজেকে কবিতা কিংবা আবৃত্তির সাথে এতটা অতোপ্রতো অাবিস্কার করতে পারতাম না। আজ ২২ বছর পর কবিতাটি নিয়ে লিখতে বসে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সব দিনরাতের কবিতাপ্রবণ সময়ের সব চিত্রপট। যা চিরকাল এক গভীর সম্নোহনে বেঁধে রেখেছে আমাকে একাল আর সেকালের সাথে। দীর্ঘ দীর্ঘ দিনযাপনের ক্লান্তি, বিচ্ছেদ বিরহ, দলভাঙনের যাতনা কিংবা অবসাদের দূরত্বে বসে আজও সেই মানুষগুলোকে মনে হয় বড় আপন। বহুদূরে থেকেও কাছের। যখন কবিতাটির ডিসেক্শন কিংবা আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণের সত্যাসত্য গল্পরূপ লিখতে বসেছি তখনও কানের কাছে বার বার বেজে উঠছে মাসুমের ভরাট কন্ঠের সেই অপরূপ শব্দে শব্দে আাঁকা ছায়াছবি, সেই মুখভঙ্গী, সেই শব্দেপ্রক্ষেপণ কিংবা নিরঞ্জনের দুঃখ বেদনার আতিশয্যে একাত্ম আবেগে ভরপুর কবিতাপ্রেমি এক দারুণ মানুষের মুখ, এক অনন্য আবৃত্তিকারের কণ্ঠস্বর। চলুন কবিতাটি পড়ি.. অনেক কথা বলবার আছে আমার
তবে সবার আগে নিরঞ্জনের কথা বলতে হবে আমাকে
নিরঞ্জন আমার বন্ধুর নাম, আর কোনো নাম ছিল কি তার?
আমি জানতাম না।
ওর এক বান্ধবী, ছিল অবশ্য কিছু দিনের জন্য-
সে তাকে ‘প্রীতম’ বলে ডাকতো।

ওর বান্ধবীর নাম ছিল জয়লতা
নিরঞ্জন জয়লতা সম্পর্কে আামকে কিছু বলেনি তেমন।
জয়লতাকে কখনো কোনো চিঠি লিখেছিল কি না
সে কথাও আমাকে সে বলেনি।
তবে জয়লতার চিঠি আমি দেখেছি
একটা চিঠি ছিল এরকম-
প্রীতম,
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি বলেছ, এখন দুঃসময়
কিন্তু আমি জানি, সবসময়ই সুসময়, যদি কেউ ব্যবহার করতে জানে তাকে।
আমি বুঝি বেশি দিন নেই, যদি পার এক্ষুণি তুলে নাও
নইলে অন্য পুরুষ ছিবড়ে খাবে আমাকে-
আমার ঘরে, বসে সিগারেট টানতে টানতে
নিরঞ্জন চিঠিটা চুপ করে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘বিভূ, চিঠিটা পড়ুন’।
আমি প্রথমে পড়তে চাইনি।
পরে ওইটুকু পড়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম-
না-ওই সিগারেটের ধুঁয়োয়
আমি কোনো নারী-প্রেম-তাড়িত মানুষের ছায়া দেখিনি-ভয়ানক নির্বিকার।
কিছু বলছেন না যে? আমি প্রশ্ন করেছিলাম
কী বলবো?
এই ব্যাপারে?
কোন ব্যাপারে?
এই যে জয়লতা।
বাদ দিন।
আমি বাদ দিয়েছিলাম।
নিরঞ্জন আমার ঘরে বসে অনেক্ষণ সিগারেট
টেনে টেনে ঘরটাকে অন্ধকার করে রেখে চলে গিয়েছিল সেদিন।

জয়লতার সাথে অন্য পুরুষের বিয়ে হয়েছিল
আমি জয়লতা এবং অন্য পুরুষটিকে দেখেছি বহুবার, বিশ্ববিদ্যালয়েই
জয়ললতা আরও দেমাগী আর সুন্দরী হয়ে উঠেছিল
অন্য পুরুষ ছিবড়ে খেলে মেয়েরা বুঝি আরো সুন্দরী হতে থাকে?
এ কথার সূত্রে সেদিন নিরঞ্জন আমাকে বলেছিল
মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না,
মানুষ এত বড় যে,
আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে উচ্চারণ করেন
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’
তো আপনি কাঁদবেন।
আমি মানুষের পক্ষে, মানুষের সঙ্গে এবং মানুষের জন্য।

হ্যা, মানুষের মুক্তির জন্য নিরঞ্জন মিছিল করতো।
আমি শুনেছি নিরঞ্জন বলছে—
‘তুমি দুষ্কৃতি মারো, বাঙ্গালী মারো,
হিন্দু-মুসলমান মারো, গেরিলা-তামিল মারো
এভাবে যেখানে যাকেই মারো না কেন
ইহিতাস লিখবে যে এত মানুষ মরেছে
বড়ই করুণ এবং বড়ই দুঃখজনক
শক্তির স্বপক্ষে তুমি যারই মৃত্যু উল্লেক করে উল্লাস করনা কেন
মরে রেখো মানুষই মরেছে।’
এই ভয়ঙ্কর সত্যকথা নিরঞ্জন বলেছিল
মিছিলে হাত উঠিয়ে বলেছিল,
‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না। মানুষকে বাঁচতে দাও’।
নিরঞ্জন বাঁচেনি।
তার উদ্যত হাতে লেগেছিল মানুষের হাতে বানানো বন্দুকের গুলি
বুকেও লেগেছিল-
যেখান থেকে ‘মানুষ’ শব্দটি বড় পবিত্রতায় বেরিয়ে আসতো।
সে লাশ আমার বন্ধু নিরঞ্জনের লাশ;
আমি দেখেছি রক্তাক্ত ছিন্ন ভিন্ন লাশ,
মানুষ কাঁধে করে তাকে বয়ে এনেছিল মানুষের কাছে।
জয়লতা সে লাশ দেখেছিল কি না সে প্রশ্ন উঠছে না।
দেখলেও যদি কেঁদে থাকে সে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে
তাতে নিরঞ্জনের কোনো লাভ হয়নি।
মানুষ কেঁদেছিলি
আমি জানি তাতে নিরঞ্জনের লাভ ছিল
নিরঞ্জন প্রমাণ করতে পেরেছিল
গতকাল মিছিলে আইন অমান্যের অভিযোগে যে দুস্কৃতি মারা গিয়েছে
তার নাম নিরঞ্জন-
সে আসলে ‘মানুষ’।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।