সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৭)

ক্ষণিক বসন্ত

চারুকেশী

জোছনার আলোয় ক্যানভাসটা সামান্য আলোর দিকে এলিয়ে দিল চারুকেশী। তারপর মোবাইলটা ট্রাইপডে রেখে ক্যামেরা ফোকাস করে লাইভ ভিডিওতে ঢুকে পড়ল সে। মোবাইলে পর্দার ওইপারে হিন্দোল স্যার। তিনিও ক্যানভাস নিয়ে বসে। চারুকেশী এক এক করে তার ওড়না, সালোয়ার কামিজ খুলে দিচ্ছিল। মাঝেমাঝে লজ্জায় থমকে যাচ্ছিল সে। বাবা নেই আজ। ফিরতে রাত করবে। হিন্দোল স্যার অনেকদিন থেকেই তার কাছে এই মুহূর্তটা চেয়ে এসেছে। হিন্দোলের চোখদুটোর দিকে তাকালে চারুকেশী কেমন হারিয়ে যায় যেন। আঁকার ক্লাসে বারবার তাকে ‘ন্যুড’ আঁকতে ইচ্ছে হয় তার।
-নগ্ন আঁকতে হলে নগ্ন হতে হবে চারু।
নিজস্ব প্রাইভেট চেম্বার একথা প্রথম প্রথম ক্লাসের সময় একদিন তাকে বলেছিল স্যার। সেদিন লজ্জায় তার দুই কান লাল হয়ে গিয়েছিল, দুই গালে ফুটে উঠেছিল কুমকুম। তারপর কতোবার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। কফিহাউজে চা খাওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই মুহূর্তটুকু অধরা থেকে গেছে। আজ সেই মুহূর্ত। চারুকেশী শেষ সাহসটুকু একত্রিত করে অবশেষে নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দিল ক্যামেরার সামনে। পর্দার ওপারে হিন্দোল স্যার তাকে আঁকছেন লাইভ। ‘টাইটানিক’ সিনেমার কেট উইনসেটের মতো।
-তুমিও আঁকো চারু। আমি দেখি। কী অপূর্ব চুল তোমার।
চারু তার কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া কেশরাশি দিয়ে সামান্য নগ্নতাটুকু ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তারপর হঠাৎ সে দেখতে পায় জানলার শার্সি বেয়ে ক্ষেপলির বিল বেয়ে জোছনা এসে পড়ছে তার উপর। তার চুল মায়াবিনী হরিণপুচ্ছর মতো আলোকময় হয়ে উঠেছে যেন। তার বুকের ভিতর, উরুর ভিতর থেকে এক চেনা সুর বেজে ওঠে।”শ্যাম তেরি বংশি পুকারে রাধা নাম”। চারুকেশী গুণগুণ করে আঁকতে থাকে। পর্দার ওইপারে কেউ তাকে দেখছে, নাকি বিস্মিত বিভোর হচ্ছে, নাকি লেহন করছে। সে ভুলে যায়। ক্যানভাসে আঁকার আঁচড় পড়ে। বাঁশির এক কোণে ময়ুরপালক আঁকতে থাকে চারুকেশী। সেই বাঁশির সুরে সে যেন হাল্কা চাঁদনরি প্রজাপতির মতোই ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় ওই মুক্তধারা জোছনার দিকে। মোবাইলে পর্দার ওইপার থেকে হিন্দোল বলে ওঠে,”অ্যামেজিং চারু। আমি স্পেলবাউণ্ড। তোমাকে এঁকেছি দেখ।” ছবি দেখতে ঝুঁকে পড়ে চারু। হিন্দোল তার স্তনসন্ধীতে পর্দার ওইপার থেকে চুমু ভাসিয়ে দেয়। চারু আবার ক্যানভাসে ফিরে আসে। আর ঠিক তখনই সিঁড়ি ঘর থেকে এক প্রবল ‘ধপ’ করে ভারি কিছু মেঝেতে পড়বার শব্দ তাকে সচকিত করে। চারুকেশী দেখল সিঁড়ির ঘরে কেদার মেঝের ওপর পড়ে থরথর করে কাঁপছে। এক বৈদ্যুতিক শীতলপ্রবাহ নেমে এল তার শুষুম্না দিয়ে।
-কী হল চারু?
-কিছু না। আমি একটু আসছি হিন্দোলদা।
বলেই ফোনটা বন্ধ করে দিল সে। তারপর কোনও মতে কুর্তিটা গলিয়ে সে ছুটে গেল সিঁড়ি ঘরের দিকে। তবে কি তার অজান্তেই কেদার তাকে আড়াল থেকে দেখছিল! বাবা সেকথা জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিন্তু সে সম্ভাবনা কম। কেদার যে কথা বলতে পারে না। কিন্তু চারুকেশীর সামনে তখন অন্য সমস্যা। কেদারের মুখ দিয়ে লালা মেশানো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার চোখের মণি কাঁপছে তিরতির করে। এতোগুলো দিন পর হঠাৎ আবার সেই ভয়ানক মৃগীরোগ ফিরে এসেছে তার শরীরে। দুতিনবার ‘কেদার কেদার’ বলে ডাকতেও সাড়া না মিললে চারুকেশী দ্রুত জামাকাপড় পরে নিল। তারপর বাবাকে ফোন করতে গেল। তার ফোন ‘নট রিচেবল’।উত্তেজনায় দরদর করে ঘামছিল চারুকেশী। এখন সে কী করবে?

মনোহরের ঘরে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই তার মনে হল কিছু একটা যেন ঠিক নেই। সদরদরজার উপরে আলোটা জ্বলছে না। তবে কি চারু ওটা জ্বালাতে ভুলে গেছে। ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলে হাত রেখে মনোহর বুঝতে পারল ঘরে কারেন্ট নেই। হঠাৎ এক অজানা ভয় যেন চেপে বসল তার বুকে। ‘চারু চারু’ বলে খানিক ডাকাডাকি করতেই থমথমে মুখ নিয়ে চারুকেশী ঘরের দরজা খুলে দিল।
-এতোবার ফোন করলাম। ফোন তুললে না কেন?
-ফোন করেছিলি? কই জানি না তো।
মনোহর পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল তারই অজান্তে কখন যন্ত্রটি বন্ধ হয়ে গেছে।
-কী হয়েছে?
-কেদার।
-কী হয়েছে কেদারের?
-ওকে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও।
-সে কী! দরজা বন্ধ রাখিসনি?
-রেখেছিলাম। তাও।বলছি সব। ভিতরে এসো বাপি। আগে জল খাও।
মনোহর হতাশভরে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে ধপ করে বসবার ঘরের সোফার ওপর বসে পড়ল। কেদার নেই! কোথায় গেল ছেলেটা! চারুকেশী ভিতর থেকে গ্লাসে করে জল এনে দিল। তারপর মুখোমুখি সোফায় বসে সাজিয়ে নিল কী কী সে তার বাবাকে বলবে। হিন্দোলদা বা ভিডিও শ্যুটের কথাটা সম্পূর্ণ গোপন করে কেদারের ফিট হবার ঘটনার কথাগুলো বলল সে। বাবাকে না পেয়ে কী করে কেদারের মুখের ওপর জলের ছিটে দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল সে। কেদার বিড়বিড় করছিল কী যেন। দোতলায় ওষুধ আনতে গিয়েছিল সে। কেদারের ঘরে সে খুব কম ঢোকে।ঠিক সেই সময়ই তার সমস্যা আরো যেন খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে ঘরের কারেন্টটা চলে গেল দুম করে। হাতড়ে হাতড়ে অনেক খোঁজার পর ডাক্তারবাবুর দেওয়া ওষুধটা নিয়ে নিচে আসতেই চারুকেশী দেখেছিল কেদার নেই। কোথায় গেল? বাথরুম বারান্দা সিঁড়িঘর কোথাও নেই সে। তারপর সে আবিষ্কার করল সদর দরজা খোলা। তরকার ঘটনাটি থেকে সম্বিত ফিরতে না ফিরতেই কেদার ঘর থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। চারুকেশীর থেকে সমস্তটুকু শোনবার পর মনোহার শূন্য চোখে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে রইল। কোথায় গেল ছেলেটা? এই গুরুপূর্ণিমার জোছনা রাতে রমুনাঘাটার সঙ্গে তার শেষটুকু সংযোগও যেন ছিন্ন হয়ে গেল। এতো সহজে সে কথা মেনে নিতে পারছিল না মনোহর। একবার পুলিশকে জানানো উচিত। একটা চেষ্টা করতেই হবে।তার মন বলছে। কাছাকাছিই আছে ছেলেটা। শুধু তার ভয়। কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে। চারুকেশীকে ঘরে একা রেখে যেতে মন করল না তার।
-তৈরি হয়ে নে মা। বেরোতে হবে। থানায় যাবো চল।

ঘোলা থানার ওসি বিভাস রাউত মনোহরের পূর্বপরিচিত। বিভাসের বাবা কৌশিক রাউত স্যারের কাছে যমুনাঘাটার কোন ছাত্র না অঙ্কে হাতেখড়ি করেছে। সেই অর্থে মনোহর বিভাসের ভিতরেও কৌশিকস্যারের ছায়া দেখতে পায়। সেই দৃপ্ত উদ্যমী চলন। নির্ভীক চাহনি। ইতিমধ্যেই ঘোলার মাটিতে বেড়ে ওঠা একটি প্রোমোটারি সিণ্ডিকেট ভেঙে দিয়েছেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। কেদারকে নিয়ে এই বিপদের সময় বিভাসের কথাই তাই প্রথমে মনে এল মনোহরের। ফোন করতেই সে তৎক্ষনাৎ চলে আসতে বলল। পার্থপুর আসার পর একটা ছোট স্কুটি কিনেছিল মনোহর। টুকিটাকি এদিক ওদিক যেতে সুবিধা হয়। সেই স্কুটিতেই চারুকেশীকে পিছনে বসিয়ে ঘোলা থানার দিকে চলল সে। পথে নির্জন দুইপারে জোনাকী আর জোছনার আলোআঁধারিতে তার চঞ্চল চোখদুটো খুঁজে চলল। যদি বা কেদারের সন্ধান মিলে যায়। হা কৃষ্ণ ।
বিভাস রাউতকে এর আগে কখনও সরাসরি সামনে থেকে দেখেনি চারুকেশী। দেখেনি না বলে দেখার দরকার পড়েনি বললেই বোধহয় ভালো। দরকার না পড়লে আর থানাপুলিশের কাছে আসতে কেই বা চায়। তবে মাঝবয়সী লোকটার চোখের দিকে একটানা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয় যেন মনের ভিতর ঢুকে চোখদুটো সমস্ত গোপন খবর বের করে নেবে। সে চোখের দিকে তাকিয়েই বুক ঢিবঢিব করছিল চারুকেশীর। হিন্দোল স্যারের ব্যাপারটা পুরো গোপন করে গেছে সে। থানার এই অফিসারটা সেইসব জেনে ফেলবে না তো! মনোহর বলতেই বিভাসবাবু খাতা খুলে কেদারের নাম বর্ণনা লিখে নিল। তারপর স্বভাবতই প্রশ্নর তির ঘুরে গেল চারুকেশীর দিকে।
-ছেলেটার কোনও ছবি দিতে পারেন। আপনার ফোনে আছে।
চারুকেশী ভাবছিল। কয়েকদিন আগে কলেজের কয়েকজন বান্ধবী এসেছিল চারুকেশীর বাড়ি। সেদিন অনেকগুলো ফটো তোলা হয়েছিল ঘরের ভিতর। সেখানে কেদারের ছবি থাকতেও পারে। গ্যালারি খুলে হাতরাতে হাতরাতে একটা ছবিতে সত্যিই কেদারের ছবি পাওয়া গেল। মনোহর বলল।
-আসলে মন্দির থেকে কুড়িয়ে পাওয়া। আধার জন্মপত্র এমনকি কোনও ফোটো আইডিও করিনি ছেলেটার …
চারুকেশী বলল,” দেখুন তো। এই ফোটোতে একঝলক কেদারকে দেখা যাচ্ছে।”
ফোনটা নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বিভাস রাউত জিজ্ঞেস করল হঠাৎ।
-আপনি আর্ট কলেজে পড়ছেন?
-আজ্ঞে হ্যাঁ।
-কলকাতার গভরমেন্ট আর্ট কলেজ?
-হ্যাঁ।
-এই ছবিতে মেয়ে গুলো কি আপনার বন্ধু?
-হ্যাঁ।
-ভেরি ইন্টারেস্টিং।

অতর্কিত প্রশ্নবাণের মুখে পড়ে চারুকেশী যেন অসহায়ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাইছিল। কেদারের অন্তর্ধানের সঙ্গে এই ফোটোর অন্যান্য চরিত্রগুলোর কী সম্পর্ক থাকতে পারে! ঠিক তখনই বিভাসবাবু নির্দিষ্ট একটি মেয়েকে আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করে বলল।
-একে চেনেন?
চারুকেশী ভালো করে ছবিটা দেখে ঘাড় নাড়ল। পূরবীদি তার এক বছরের সিনিয়র। সেটুকু দেখে বিভাসবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন।
-বেশ। ছবিটা আমার মোবাইলের ওয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিন তো।
মনোহরের মনের ভিতর কৌতূহল বেড়ে উঠছিল। অবশেষে আর থাকতে না পেরে সেও বলল।
-কিছু সমস্যা আছে বিভাস?
-একটা সমস্যা তো আছেই। সমস্যা না বলে খটকা বলাই ভালো। তবে যেহেতু আজকের কেসটার সঙ্গে এটা আনরিলেটেড, তাই আজ আর আপনাদের দুশ্চিন্তা বাড়াব না। শুধু এটুকু সাবধান করে দেব। ওই পূরবী মেয়েটার সঙ্গে আপনার মেয়েকে বেশি মিশতে বারণ করবেন। মেয়েটার একটা পুলিশ রেকর্ড আছে। এটুকুই বলার। যাক গে। দেখি। ছেলেটাকে খুঁজে পাই কিনা। পেলে ফোন করব। চিন্তা করবেন না।

বিভাস রাউত কেদারকে খুঁজে দেবেন কথা দিয়ে আশ্বাস দিলেও বাবা আর মেয়ের মনের ভিতর তখন অন্য এক জটিল চিন্তা দানা বাঁধছে। এ যেন বাবুইপাখির বাসার মতো। ভিতরে গোবরে আটকে থাকা জোনাকির আলোয় যেন না বলা কথা জ্বলেই নিভে যাচ্ছে। ফিরতে ফিরতে দূর থেকে ভেসে আসা কীর্তনের সুর শুনতে পেল দুইজনে।”গণসহ নরোত্তমে করি আলিঙ্গন। নিজহস্তে পরাইলা শ্রীমালাচন্দন।” একই সঙ্গে অন্য কোনও অনুষ্ঠান থেকে ভেসে আসছে গান। “শ্যাম তেরি বংশি পুকারে রাধা নাম”। সে গান শুনে স্কুটির পিছনে বসে হঠাৎ যেন শিউরে ওঠে চারুকেশী। পূরবীদিকে তো কখনও খারাপ মেয়ে মনে হয়নি তার। কলেজে ছাত্রী হিসেবে বেশ ভালো সুনাম তার। অবশ্য হিন্দোল স্যারের সঙ্গে আগে একবার তার একটা সম্পর্কে জরিয়ে পড়ার কথা শোনা যায় মাঝেমাঝে। কিন্তু তা নিতান্তই অপ্রমেয়। মৃদুগুঞ্জন বলা চলে। পূরবীদি তার কোন অন্ধকার নিষাদকোণ লুকিয়ে রেখেছে তার কাছে কে জানে! মনোহরের মনও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। একদিকে কেদারের হারিয়ে যাবার ঘটনা, অন্যদিকে বিভাস মেয়েটার কলেজের ভিতর না জানি কোন বিপদের কথা বলল কে জানে। এরা দুজন না থাকলে তার জীবন তো ক্ষেপলির বিলের জলের মতোই তরঙ্গ শূন্য।
-মেয়েটাকে চিনিস?
-পূরবীদি।
-কী করেছে কে জানে মেয়েটা। জানিস কিছু?
-না তো।
-মিশিস না বেশি। বিভাস যখন বারণ করেছে নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই বলছে। কারণ আছে কোনও।
-আচ্ছা।

দুজনে ঘরে ফিরে আসে। কেদারের ঘরের আলোটা জ্বলছে। বিদ্যুত ফিরে এসেছে। কেদার ফেরেনি। নিস্তরঙ্গ ঘরের ভিতর দুটি প্রাণী আশ্রয় নিতে ঢুকল যেন। আর সামনের বিলে জল সামান্য টলে উঠল। কে জানে কোনও সাপটাপ হবে হয়তো!

দিন কেটে গেল প্রবহমান লীলাকীর্তনের বাণীর মতোই। অষ্টপ্রহরের তোড়জোড় বাড়ছে পানিহাটির রাধাগোবিন্দ মন্দিরে। কিন্তু কেদারের সন্ধান মিলল না কোথাও। বিভাস রাউত ফোন করলেই বলে সন্ধান চলছে। মনোহর জানে ছেলেটা সিরিয়াস। মিথ্যে বলবে না। নিশ্চয়ই চেষ্টা করছে। বাকিটুকু রাধাগোবিন্দর ইচ্ছে।
চারুকেশীর পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষার বিষয় ‘ন্যুড স্টাডি’। হিন্দোল স্যার যত্ন করে প্রত্যেকের তুলির আঁচড়ের আড়ষ্টতা কাটিয়ে দিয়েছে। কাল প্রোজেক্ট জমা দেবার শেষ দিন। অনেক রাত অবধি কাজ করে চলল চারুকেশী। তারপর ভোররাতে তার ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। সেখানে অচেনা এক নম্বর।
-কী করছ চারু?
-হিন্দোল স্যার?এটা কোন নম্বর।
-এটা আমার আর একটা নম্বর। তোমার ভিডিওটা বারবার দেখছি। আমি যে আর পারছি না চারু।
কী বলছে হিন্দোল চারুকেশী ঠিক বুঝতে পারে না। মনে মনে জানে সে এই হিন্দোলকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যেদিন কেদার হারিয়ে গেল সেদিন নগ্ন হয়ে সে শুধু তার ক্যানভাসটাই নয়, তার জাগতিক সবকিছু হিন্দোলকে সমর্পণ করেছে। কিন্তু কোন ভিডিওর কথা বলছে স্যার।
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।
-তুমি এতো সরল কেন চারু? ঠিক শিশুর মতো। সদ্যোজাত। নগ্ন। সেই গুরুপূর্ণিমার রাতের মতো…
আগুনের হলকা ছুটে যায় চারুকেশীর ধমনীর ভিতর দিয়ে।
-আপনি সেটা রেকর্ড করেছেন?
-করেছিই তো। আমরা যতোবার ওটা দেখছি তোমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।
-আমরা মানে?
-আমি আর চন্দ্র। চন্দ্র কোসাম্বি। বম্বের একটা ডান্স বার আছে ওর। ওও চাইছে তোমাকে।
-কী সব আবোলতাবোল বলছেন স্যার? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
-একটা লিঙ্ক পাঠাচ্ছি। ক্লিক করে দেখ। ওটা একটা প্রাইভেট পর্নসাইট। সবাই দেখতে পাবে না। ওখানে ওই ভিডিওটা দেওয়া মাত্র এক লাখ ‘লাইক’ পেয়ে গেছে।
চারুকেশী চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। বাবা ঘুমোচ্ছে উপরে। কেদার চলে যাবার পর থেকে বাবার মন ভালো নেই। তার ওপর এতো বড় ধাক্কা সে সহ্য করতে পারবে না।
-শয়তান। আমি আপনাদের পুলিশে দেব।
-দাও না। কিন্তু তার আগে আমরা এই ভিডিওটা পাবলিক করে দিতে চাই। লোকে তোমার দেহের মধু থেকে বঞ্চিত থাকুক, এ আমি চাই না।

কী চাইছে লোকটা? পয়সা? শরীর? নাকি অন্যকিছু? চারুকেশীর আশপাশ ঘুরছে বনবন করে। সে কোনও মতে শুধু বলতে পারল।
-কী করতে হবে বলুন?
-একটা সপ্তাহ আমাকে দিতে হবে তোমাকে। আই মিন আমাকে নয়। আমার কোম্পানিকে। আজ প্রজেক্ট জমা দেবার পর তুমি বাড়ি ফিরে তোমার বাবাকে বলবে তোমার কাজটা বাঙ্গালোরে একটা ছবির প্রদর্শনীতে লোকেদের পছন্দ হয়েছে। তাই কলেজ তোমাকে এক সপ্তাহের স্পেশাল ট্রেনিংএ পাঠাচ্ছে। পূরবী সব বুঝিয়ে দেবে।
-পূরবীদি?

মাত্র কয়েকদিন আগেকার বিভাসবাবুর কথায় তৈরি মেঘলা আকাশ হিন্দোলের কথায় যেন হঠাৎ পরিষ্কার হয়।
-হ্যাঁ। পূরবী আমাদেরই লোক।
-তারপর?
-ফ্লাইটে মুম্বই। চন্দ্রর বার। জাস্ট ফাইভ নাইটস। ফাইভ ল্যাক্স।
-বেশ্যাবৃত্তি।
-না। ছিছি। একি বলছ চারু? আস্তে বল। তোমার বাবা শুনতে পাবেন। বড় ভালোমানুষ উনি। আমাকে পূরবী বলেছে। ওনার কোনও ক্ষতি হোক আমরা চাই না।
শিউরে ওঠে চারুকেশী। মাকড়শা তার জালে আটকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলছে তাকে। আর পালাবার পথ নেই।
-তারপর?
-বড় ভালো গাও তুমি চারু। ‘শ্যাম তেরি বংশি পুকারে রাধা নাম’। আহা। ইউ শ্যুড হ্যাভ বিন আ সিঙ্গার।নট আ পেন্টার। তুমি ওখানে পাঁচদিন জাস্ট গান করবে। ব্যাস। বাকিটা অপশনাল।
-অপশানাল মানে?
-ইচ্ছে হলে করবে? শরীরে কী আছে চারু। আসল তো মন। ওই পাঁচদিনের একদিন শুধু তুমি চন্দ্রকে দিও। ওকে একটু খুশি রেখ। আমাকে ও অনেক টাকা দিয়ে রেখেছে। হি লাভস ন্যুড মডেলিং। এণ্ড অলসো স্লিপিং উইথ দেম। অবশ্যই প্রটেকশন নেবে। চিন্তা নেই।
-বাহ। আর?
-আর কি?
-ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমাকে হিন্দোল। এতোটা আশা করিনি। টাকার জন্য বেচে দিলে আমাকে?
-টাকাটা জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ চারু। এই অভাগা দেশ শিল্প মানে শুধু শরীর বোঝে। আর সেই শরীরটা তোমার আছে। ডোন্ট ওয়েস্ট ইট। আর একটা কথা। কারোকে এর মধ্যে কিছু বললে ধরে নাও তোমার বাবার ক্ষতি হয়ে যাবে। নজর আছে আমাদের ওর ওপর। সো চিল। আজ রাত। দমদমে ফ্লাইট। কলেজে এসো। পূরবী বলে দেবে।

ফোনটা একটা সুনামির মতোই হুট করে এসে কেটে গেল। মধ্যিখানের সময়টুকু সব তছনছ করে চলে গেল যেন। সকালে বাবাকে কিছু বলল না চারুকেশী। কলেজে পূরবীদি তাকে ক্লাসের এক ফাঁকে ডেকে একটা খাম ধরিয়ে দিল। তিনদিন বাদেই যেতে হবে তাকে।বাঙ্গালোরের ফ্লাইট টিকিট। সেখান থেকে গাড়ি করে মুম্বই। সরাসরি মুম্বইয়ের টিকিট কাটলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। এই পূরবী আর আগের পূরবীর ভিতর কোনও মিল খুঁজে পেল না সে। টেম্পেরায় চারপাশ ঢেকে গেছে যেন। প্রোজেক্ট জমা দেবার পর আপাতত দুই দিনের অক্সিজেন নেবার ফুসরত। তারপর কী হবে কে জানে !

বসন্তের ক্ষণগুলি বড় ঝটিকার মতো। হঠাৎ যেন তার এক উস্কানিতে সুরের অবরোহণের মতোই হুড়মুড় করে গাছের শুকনো পাতাগুলো কাব্যিকভাবেই মাটিতে ঝরে পড়ে। চারুকেশীর জীবনেও তেমনই এক মুহূর্ত এসে দাঁড়িয়েছিল। সে মুহূর্ত তার রিক্ত হবার। কিন্তু সে তার বাবাকে তার সেই রিক্ততার কথা বুঝতে দিল না কিছুতেই। ঘরে ফিরে বাঙ্গালোরে হঠাৎ প্রজেক্ট পাবার খবর দিতেই বাবা আনন্দে উথলে উঠল। পরক্ষণেই মনোহরের মনের ভিতর ভীড় করল উৎকণ্ঠা। মেয়েকে কখনও এতো দৃর একা ছাড়েনি সে। একা একা প্লেনে করে এতোটা পথ। নাহ। সেও যাবে সঙ্গে। কিন্তু চারুকেশী তার মুখের উপর হাত রেখে বলল।
-একদিন তো আমাকে একা যেতে দিতেই হবে বাবা। আমি পারব ঠিক। তুমি দেখ। মাত্র তো ক’টা দিন। তারপরই আবার চলে আসছি কলকাতায়। তুমি দেখ কেদারকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।
তারপর একটু ভেবে চারুকেশী আবার বলল, “তুমি চিন্তা করো না বাবা। আমার সঙ্গে তো কলেজের সিনিয়ররা থাকবে। তাছাড়া কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব তোমাকে আমি জানাতে থাকব তো।

মনোহর জানে তার মেয়ে পারবে। জীবনের সব চ্যালেঞ্জ একলা সামলে দেবার শক্তি তার আছে। নির্দিষ্ট দিনে দমদমে যাবার পথে চারুকেশী মনোহরের কাছে ফুচকা খেতে চাইল পাণিহাটির মোড়ে। আজ এখানে রাধাগোবিন্দ মন্দিরে অষ্টপ্রহর শুরু। মাইকে ঘোষণা করছে আয়োজক। ফুচকা খেতে খেতে চারুকেশী মনোহরের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। হঠাৎ বলল।
-আমি চলে গেলে একাএকা কী করবে তুমি বাবা?
-কি জানি।
-কীর্তন শুনতে যেও। অষ্টপ্রহর হবে বলছে আজ। তবে রাতে রুটি নিয়ে ঘরে ঢুকো। খেয়ে নেবে নিয়ম মতো।

টার্মিনালে চারুকেশীকে দেখে চোখ ঝাপসা হয়ে এল মনোহরের। পায়ে হাত রেখে প্রণাম করল সে। মনে মনে বলল মনোহর।
-বিজয়িনী হোস।
মুখে বলল।”পৌছে ফোন করবি”।
ফেরার পথে যেন শেষ হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটম্যানের মতো মনোহর ফিরে আসছিল। এই এক সপ্তাহ বড় অসহনীয় হবে তার কাছে। সে হোক। একদিন তার মেয়ে অনেক বড় শিল্পী হবে। নিজের অজান্তেই মেয়েটা হঠাৎ যেন কতো বড় হয়ে গেল।একদিন এভাবেই দেশেবিদেশে তার ছবি ছড়িয়ে পড়বে। ভাবতে ভাবতে মনোহর ঘরে ফিরে চলল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। কেদারের ব্যাপারে বিভাস এখনও কিছু জানালো না! মন্দির থেকে ভেসে আসছিল অষ্টপ্রহরের আওয়াজ। নগরকীর্তন শুরু হয়েছে। পানিহাটির মোড়ে অটো থেকে মনোহরের একবার মনে হল সেখানে যায়। ভেসে এল সুর।”নদীয়া ভ্রমিতে গোরা এল নিমের হাটে। গৌর এল হাটে, সঙ্গে নিতাই এল হাটে। নাচে মাতোয়ারা নিতাই খোদ্রুমের মাঠে। জগৎ মাতায় নিতাই প্রেমের মালসাটে।” শুনতে শুনতেই হঠাৎ মাইকের ভিতর শোরগোল শোনা গেল। সেই হট্টগোলে মন পরিবর্তন করল মনোহর। নাহ। আর এইসব ঝুট ঝামেলা ভালো লাগছে না তার। আপাতত সাড়ে চার ঘন্টা পর চারুকেশী বাঙ্গালোরে পৌছে তাকে ফোন করবে। ততক্ষণ ঘরেই থাকা ভালো। পার্থপরের দিকে আসতেই মাইকের সেই শোরগোল ফিকে হয়ে এল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।