সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১১)

ক্ষণিক বসন্ত

দেশকার

ঝুমরোকোঠির বাইরে দাঁড়িয়ে দেশকার গোমস নোট গুনছিল। আজ ভালো কামাই হয়েছে সকাল থেকে। মেয়েগুলো খাটছে সকাল থেকে। তবু মন কেড়ে নিয়েছে একা বঙ্গাল থেকে আসা মেয়েটার গান। আহা। আন্ধেরির মেহরাজি আজ অনেকদিন বাদে কোঠিতে এসেছিলেন। মেহরাজির মিউজিক প্রোডাকশনের কোম্পানি আছে। তাই তার কান জহুরির কান। মেয়েটির গান শুনে থমকে চেয়েছিল অনেকক্ষণ। পরে টাকা দেবার সময় বলল,”কামাল কি গাতি হয় লড়কী। ক্যায়া বাত।” বোধহয় কোঠির ছোপ চুনরিতে না লেগে থাকলে আজই মেয়েটিকে রেকর্ডিংএ তুলে নিয়ে যেতেন। তখন হয়তো দেশকারকেও ডাকতেন।
বেস গিটারে একসময় ভালো হাত ছিল দেশকারের। একসময় তার নাম ছিল দেশকার সিদ্দিক। সে আর তার বোন সাহানা জোট বেঁধেছিল। বেশ চলছিল সব। সাহানা চড়াতে মিষ্টি সুর তুলতে পারত। বাপ মা মরা ছেলেমেয়েদের এই মুম্বইয়ের ব্যস্ত শহরে হয়তো হারিয়ে যেতে হতো। সে নিয়তি খানিকটা প্রলম্বিত করে দিল ফাদার লাডউইগ। দেশকাররা গোয়াতে গিয়েছিল কনসার্ট করতে। সেখানেই ফাদার তাদের অফার দিল। আর ঘুরে ঘুরে গান নয়। প্রতি শনি রবিবার চার্চে গান গাইতে হবে দুই ঘন্টা। ব্যাস। থাকা খাওয়া কোয়ার্টার, সব পেল দেশকাররা। শুধু একটাই শর্ত। ধর্ম পালটে ক্রিশ্চান হতে হবে দুজনকে। মাইনের পরিমাণ নেহাত কম ছিল না। দেশকার সিদ্দিক ব্যাপটাইজড হয়ে দেশকার গোমস হলো। আর সাহানা প্রেমে পড়ে গেল চার্চের পিয়ানো বাদক এলিস ডিসুজার। এখন সাহানা গোয়াতেই দিব্বি ঘর করছে। দেশকার মুম্বইয়ে ফিরে এসেছিল ভাগ্য অন্বেষণে। কিন্তু এখানে এসে বুঝল এখন ডিজিট্যাল যুগ চলছে। বাস গিটারের দিন আজ ফুরিয়েছে। স্টুডিওতে ঘুরে ঘুরে ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে একদিন সে আশ্রয় পেল ঝুমরোকোঠিতে। এই কোঠির মালিক মিশ্রাজির বয়স হয়েছে। আজকাল আর আগের মতো চলতে ফিরতে পারেননা। তাই ব্যবসার দিকটা আজকাল দেশকারকেই দেখতে হয়।
টাকা গুনতে গুনতে চৌকের দিকে চোখ যেতেই চোয়াল শক্ত হলো দেশকারের। ছোকরাটা আজ আবার এসেছে। এমনিতে দেখে মনে হয় অনেক কাঁচা পয়সা আছে হাতে। চলনচালনে সৌখিনতাও আছে বেশ। টাকা পয়সাও ভালোই দেয়। তাহলে? কী এতো ভাবাচ্ছে দেশকারকে? ওই মেয়েটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কী? সে তো সবাই সবাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। ঘনিষ্ঠতাই তো ঝুমরোকোঠির আসল মূলধন। তাহলে? দেশকার মনে মনে বুঝতে পারে। ওই বঙ্গালি মেয়েটার ভিতর কী যেন একটা আছে। ওকে দেখলে দেশকারের সাহানার কথা মনে পড়ে যায়। সাহানা আর যোগাযোগ রাখে না তার সঙ্গে। ঝুমরোকোঠির কথা জানতে পেরেই হয়তো। ওই ছোকড়াটার ছোঁক ছোঁক ভালো ঠেকে না দেশকারের। মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়। কোনও ক্ষতি করে দেবে না তো ছেলেটা?
অবশ্য ক্ষতি করে দেবার মতো কোনও লক্ষণ দেখতে পায়নি দেশকার আজ অবধি। আজ মাসখানেক হলো ছেলেটা আসছে। এসে ঘন্টাখানেক গান শোনে ছেলেটা। তারপর কথা বলে কীসব। চলে যায়। ছেলেটা এলে মেয়েটার গানে যেন বাড়তি গমক চলে আসে। দেশকার এটা বারবার লক্ষ করেছে। আজ সে ঠিক করল ছেলেটার মুখোমুখি হবে। ওর ভিতরের অভিসন্ধি তার জানা দরকার।

দরজায় দেশকারের মুখোমুখি হতেই ছেলেটি কেমন ভয়ে গুটিয়ে গেল। যেন সে অপরাধী। দেশকার গম্ভীরভাবেই বলল।
-ক্যায়া হ্যায়? জানা হ্যায়?
-হাঁ।
ছেলেটির মুখে আকুল ছটফটানি নেই। আছে অপরাধবোধ।
-বঙ্গাল সে হো?
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানায়। দেশকার তবু ভাবতে থাকে। ঝুমরোকোঠিতে অনেককে আসতে দেখেছে সে। তাদের চোখে কুণ্ঠা থাকে। কিন্তু এই ছেলেটির ভিতর ইতস্তত ভাব নেই। আছে অপরাধবোধ। কিসের অপরাধ? ছেলেটা কি তবে কোনও অপরাধী?
-আজ জলদি করনা। উসকি তবিয়ত খারাপ হ্যায়।
ছেলেটা ইতস্তত করে বলল।
-গান শুনবো। একটা। তারপর চলে যাব।
বাংলা একটু একটু বোঝে দেশকার।
-কৌন সি গানা?
-জ্যোতি কলস ছলকে।
চমকিয়ে ওঠে দেশকার। এই গান তার যে বড় প্রিয়। এই গান তাকে তার ভুলে যাওয়া শিল্পসত্তার অতীত মনে করিয়ে দেয়।
-ঠিক হ্যায়। যাও। আজ ডাবল লাগেগা। অউর যানে সে পহলে বাত করকে যানা।
-ওকে।
কোঠিতে ঢুকে গেল ছেলেটি। দেশকারও খানিকটা ভেবে ভিতরে ঢুকে পড়ল। বন্ধ দরজায় আড়ি পেতে শুনল ছেলে আর মেয়েটির কথোপকথন।

কিন্তু কথা তেমন শোনা গেল না। বরং কুলকুল জলঝরণার মতো ভিতর থেকে ভেসে এল গান। দেশকার চমকে উঠল। এ যেন সাহানার গলা। আহা। মন্ত্রস্তব্ধ হয়ে এক জ্যোতির্ময় কলসে চড়ে দেশকার যেন স্বপ্নলোকে পা রাখল। নিমেষে কেটে গেল সময়। ছেলেটি বেরিয়ে আসতেই টাকা গুনতে গুনতে সে বলল।
-বাহার চল। বাত করতে হ্যায়।
চৌকের কাছে একটা খাসির মাংসের দোকানের পাশে সরকারি লালবাসের অপেক্ষালয় আছে। সেখানেই পাশাপাশি সিটের ওপর বসল দুই জনে।
-বোল। ক্যায়া কিয়া হ্যায় তু?
-ক্যায়া?
-কুছ তো হ্যায়। তু ছুপা রহা হ্যায়।
ছেলেটা ঘামছিল। রুমালে কপাল মুছতে মুছতে বলল।
-আপ পুলিশকে আদমি হো?
-নেহি।
-ও।
আবার কপাল মোছে ছেলেটা। তারপর বলে।মুম্বাইয়ের ব্যস্ত শহরে লাল বাস চলতে থাকে ভ্রমরের মতো। শুধু এখানে তাকে খুঁজতে হয় না। ফুলরেণুর মতোই অসংখ্য অফিসযাত্রী যেন আপন আগ্রহেই তার মধ্যে ধরা দেয়।
-নাম ক্যায়া হ্যায় আপকা?
-দীপক।
-ভাগ কে আয়ে হো? ঘর সে।
-হাঁ। লেকিন উও ঘর নেহি থা মেরা ।
-সমঝা। ইস লিয়ে পড়েশানি।
দেশকার গোমস ভাবতেই থাকে। কার ঘর আছে। তার নিজের জীবনে যেমন ঘর নেই। মা নেই। ফাদার লুডউইগ আশ্রয় দিলেন, কিন্তু তার নিজস্ব কৌম কেড়ে নিলেন। এখন সে নিজেও জানে না কে আসল। কে নয়। প্রভু না পয়গম্বর। তার কাছে বেস গিটারের চারটে তার হলো ঈশ্বর। এই ছেলেটার?
-ইঁয়াহা কিঁউ আতে হো? জানতে হো উস ছোকরি কো?
ছেলেটি মাথা নাড়ে। ঘাম মোছে। তারপর বলে।
-মেয়েটা ভালো মেয়ে। মনোহরকাকার মেয়ে। ট্র্যাপে পড়ে গেছে।
-আড়ে। হিন্দি মে বলো। কৌন হ্যায় ইয়ে মনোহরকাকা?
-মেরে গাঁও কা হ্যায়। এক আচ্ছা ইনসান।
-ট্র্যাপ কিঁউ? মুলতানভাই খুদ লায়ে হ্যায়। আচ্ছা গাতি হ্যায়। বাকি সব ভি আচ্ছা হি করতা হোগা।
দেশকার হাসতে গিয়ে থমকে যায়। ছেলেটা কাঁদছে। এই জল সে চেনে। সাহানার চোখে অনেকবার দেখেছে। তখন সাহানা এলিসের সঙ্গে ঘর বাঁধবে ভাবছে।
-প্যার করতে হো উসে?
-হাঁ।
-ইরাদা ক্যায়া হ্যায়।
-ভাগনা হ্যায়। আপ হাম দোনো কা মদত করো। ও ভালো নেই এখানে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।

বাহ রে বা। কে আমার দুই কবুতর জুটলো রে, যে তাকে সাহায্য করতে হবে? কসাইখানা থেকে মাংসের চর্বি ছিটকে এসে লাগল দেশকারের গালে। মিশ্রাজি লোকটা এমনিতে খারাপ নয়। কিন্তু ধান্দার ব্যাপারে সে খুব কঠোর। তার ঝুমরোকোঠিতে অজস্র অদৃশ্য চোখ আছে যা সিসিটিভির থেকেও সহস্র গুণ শক্তিশালী। একবার উত্তর প্রদেশের একটি মেয়ে পালাতে গিয়েছিল কোঠি থেকে। মুম্বাই স্টেশনে ধরা পড়ে গেল মিশ্রাজির লোকেদের হাতে। তারপর তার কী হলো কেউ জানে না। কেউ বলে আরবে পাচার করে দিয়েছে মিশ্রাজি। এখন কোন আরব শেখের খিদমত খাটে। কেউ বলে জ্যান্ত হালাল হয়ে গেছে বান্দ্রার এক নার্সিংহোমে। কিডনি, লিভার, এমন কি শরীরের চামড়াটুকুও জ্যান্ত ছাড়িয়ে বেচে দিয়েছে মিশ্রাজি। মেয়েটিকে দেখেনি দেশকার। কিন্তু শুনেছে মেয়েটি নাকি অসম্ভব সুন্দরী ছিল। বহু বছর ঝুমরোকোঠি তার জন্যই জেগে ছিল বিচ বাজারে। ইশক না করলে এমন পালাতোও না হয়তো মেয়েটা।
-না মুমকিন।
-ম্যায় কিমাত দুঙ্গা।
-কিতনা।
-পঁচাশ লাখ।
-ইতনা হ্যায়? দেখনে মে নেহি লাগতা।
-হ্যায়। জেহরাত। মন্দির সে লেখে আয়া হুঁ। মেরে আপনে মা কি জেহরাত।
বলে কি লোকটা। পঞ্চাশ লাখ দেবে? অতো টাকা পেলে সেও এই নরক থেকে পালাবে। কেরালা চলে যাবে। সমুদ্রের ধারে একটা মিউজিক ক্যাফে খুলবে যেখানে সারা রাত শুধু গান হবে। কিন্তু কীভাবে?
-আসান নেহি হ্যায়। মিশ্রাজি। বহুত খতরনাক। আপ করো গে। মুঝে মালুম হ্যায়। আপ করো গে।
-কিঁউ। রুপেয়া কে লিয়ে।
-নেহি। আপনে বহিন কে লিয়ে। চারুকেশী মুঝে বোলা হ্যায়। আপ উসকো বহিন কি তারা সম্ভালকে রাখতে হো।
মেয়েটার নাম চারুকেশী। এতোদিন কখনও বলেনি। সকলে ওকে ‘বানো’ বলে ডাকে। এই ছেলেটা আসা মাত্র এতো কিছু জানে! সত্যিই হয়তো ভালোবাসে ছেলেটা।
-সোচনে দো।

দিন চলে যায়। দীপক আর চারুকেশী দেখা করতে থাকে। তারপর গণেশ চতুর্থীর দিন চলে আসে। ওইদিন মিশ্রাজির নির্দেশ আছে। সবাই মিলে সিদ্ধিবিনায়কের মন্দিরে যাবে। অবশ্যই কড়া নজরদারিতে। কিন্তু সেই ভীড়ে সুযোগ মিলতে পারে। দীপককে সংকেত দিল দেশকার। কখন এবং কোথায়। চারুকেশী তাকিয়ে রইল শুধু। দেশকারের আপার মতো। মুখে বলল না কিছু।
মন্দিরের চতুর্দিক দিয়ে ভক্তদের ভিড়। ধুম ধুম শব্দ হচ্ছে। আরতি হবে। ‘জয় দেব, জয় দেব, জয় মঙ্গলমূর্তি’। সকলে হাত তালি দিয়ে গান শুনছে। ঝুমরোকোঠির মেয়েরা একদিকে দাঁড়িয়ে গান করছিল। প্রার্থনার পর বেরিয়ে আসবার সময় চারুকেশী শৌচাগারের দিকে যাবার অনুমতি চাইল। দেশকার ঘাড় নাড়তেই সামান্য হেসে চারুকেশী পালিয়ে গেল সেই দিকে। সেই হাসিতে সাহানা ছিল। আর ছিল বেস গিটারের চারটি তার।
বাইরে বাইক জোগাড় করা ছিল দীপকের। আসা মাত্র দীপক চারুকে তুলে নিয়ে মিলিয়ে গেল। দেশকার পঞ্চাশ লাখ টাকা নেওয়া হলো না। মিশ্রাজি দেখে ফেলে বলল।
-আব্বে হারামি। ক্যায়া কর রহে হো? পাকড়ো সালে কো।শালা। দেশকার। হারামখোড়। সব জানতা তুম।
বাস গিটারে তখন সি, ই আর জি মেজর বাজছে তখন।দীপক আর চারুকেশীকে ধরতে না পেরে মন্দিরের সামনেই দেশকারকে বেধারক মারছে মিশ্রাজির লোক। কেউ প্রতিবাদ করছে না। দেশকারও না। দেশকার গোমস তখন মনে মনে ভাবছে ‘ডাউউন-আপ-ডাউউন-আপ-ডাউন-আপ-ডাউন-আপ-ডাউন “।ভাবতে ভাবতে যন্ত্রণায় কাতরে উঠছে। দেশকার গোমস। যাকে ফাদার লাডউইগ সিদ্দিক থেকে গোমস বানিয়েছিল, সে জিসেভেন কর্ডের মতোই কঁকিয়ে উঠে বলছে,”ইয়া আল্লা। তোঁসে লাখো কুরবান।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।