কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুজিত চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ৬)

নীলচে সুখ 

মিসেস রায় , প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। দেখলেন , মানালি আর নীল, অন্ধকার পাহাড়ি পথে হেঁটে হেঁটে চলেছে। একবার মনে হলো চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে , কোথায় যাচ্ছিস,, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। কোথায় আর যাবে। এইতো এতটুকু জায়গা। সামনের রাস্তাটা , যেটা দিয়ে ওরা এসেছে এখানে সেটাই একমাত্র চলাচলের পথ। ডানদিকে কিছুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বাকিটা অন্ধকারে ঢাকা। সেই দিকেই গেছে মানালিরা।
বামদিকে একটু গিয়েই পথ বাঁক নিয়েছে। তাই বেশি দূর দেখা যায় না। চোখ বাধা পায় পাহাড়ের গায়ে। ওই দিকেই লাচুন লাচেনের পথ। ধ্বস নেমেছে। কাল কী হবে কেজানে।
তন্ময় বাইরে এসে মিসেস রায় কে দেখে বললো,,
একি কাকিমা , একা দাঁড়িয়ে কেন ?
আর বলো কেন ? মেয়েটা এই অন্ধকারে কোথায় গেল বলোতো ? কোনও মানে হয় ?
তন্ময় আস্বস্ত করে বললো , আহা, কাকিমা কেন চিন্তা করছেন ? সঙ্গে নীল আছে। নো টেনশন। আসুন তো আমাদের ঘরে আসুন। স্যার কে ডাকুন। বলেই , নিজেই ডাকতে শুরু করে দিলো,,,, স্যার ,, স্যার। প্লিজ বাইরে আসুন। কী একলা ঘরের মধ্যে বসে আছেন। আসুন আমাদের ঘরে। কাকিমা কে নিয়ে গেলাম।
তন্ময় মিসেস রায় কে নিয়ে তাদের ঘরে এলো। দীপেন, ব্রজেশ প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো , এইতো কাকিমা আসুন আসুন। জমিয়ে গল্প করা যাক।
ইতিমধ্যে প্রফেসরও এসে পরলেন। ওরা তালি দিয়ে হৈহৈ করে উঠলো।
এইবারে আসর জমবে। প্রফেসর বললেন,,, না না,, শুধু মুখে আসর জমে না। কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা যায় , সঙ্গে একটু কফি ?
ব্রজেশ সঙ্গে সঙ্গে বললো,,, এটা কোনও কথা হলো স্যার। এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি।
মিসেস রায় অবাক হয়ে বললেন , এখানে এই জঙ্গলে কীভাবে কী ব্যবস্থা করবে।
ব্রজেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো দেখুনতো কীভাবে কী করি। বলেই হুস করে বেরিয়ে গেল। ভাবখানা এমন , যেন নিউমার্কেট। চাইলে বাঘের দুধও মিলবে।
মিসেস রায় হতাশ গলায় বললেন ,,,, দ্যাখো দেখি ছেলের কান্ড,,,
প্রফেসর , হাসতে হাসতে বললেন ,,,, আহা, তুমি ওমন করছো কেন ? ওরা একটু আনন্দ ক’রে যা করে করুক।
কিন্তু মা’য়ের মন। সদাই খিচখিচ করে। বললেন ,,, নীল আর মানালিটা থাকলে ভালো হতো। কেন যে হটাৎ বাইরে গেল ,, কী জানি বাবা,, বুঝি না।
তারপরেই জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
একি, জানালা খোলোনি কেন ? খুলে দাও ওটা। বাইরের হাওয়া বাতাস আসুক।
দীপেন ঝটপট জানালা খুলে দিলো। নির্মল ঠান্ডা হাওয়ায় ঘর ভরে উঠলো।
ঠিক তখনই ব্রজেশ হৈহৈ করে ফিরে এসে বললো,, আসছে , হাতে গরম চিকেন চাউমিন , আর কফি।
প্রফেসর আনন্দ মেশানো অবাক গলায় বললেন,, সেকি ! পেলে কোথায় ? এখানে এইসবের দোকান আছে নাকি,, আশ্চর্য!
ব্রজেশ ভ্রু নাচিয়ে বললো আছে স্যার , সব আছে। এই বাড়ির নিচের তলায় , দুটো দোকান আছে। একটা মুদিখানা , আর একটা ছোট্ট রেষ্টুরেন্ট।
প্রফেসর প্রায় আঁতকে উঠে বললেন,,, রেষ্টুরেন্ট?
ব্রজেশ খানিকটা ভুল শুধরে নেবার মতো করে বললো ,,,, না মানে , অর্ডার দিলে বানিয়ে দেয় আরকি। তাই রাতের খাবারের কথাও একেবারে বলে এলাম। চিকেন কারী আর রুটি।
মিসেস রায় একটু কুন্ঠিত ভাবে বললেন,,, আমাদের জন্যেও তাহলে,,
ব্রজেশ আস্বস্ত করে বললো , বলে দিয়েছি । সকলের একই মেনু। যদিও আপনাদের জিজ্ঞেস না করেই,,,,
প্রফেসর ব্রজেশ পিঠে স্নেহের চাপড় মেরে বললেন,,,, ওয়েল ডান মাই বয়। মেনি মেনি থ্যাংকস টু অল অব ইউ। তোমরা সঙ্গে না যে কী হাল হতো , তা বেশ হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি। কীবলো মিসেস রায়। ভুল বলেছি ?
মিসেস রায় সলজ্জ ভঙ্গিতে বললেন ,,,, নিশ্চয়ই। একশোবার। ছেলেগুলোর তুলনা হয়না। অন্তত আজকের যুগে ।
প্রফেসর একটু বিরক্ত স্বরে বললেন ,,, থামো তো। এমন একটা সুন্দর পরিবেশে , অকারণ যুগ যুগান্তরের কথা ভালো লাগে। এখন এখানে যে কদিন বেড়ানো চলবে , চুটিয়ে আনন্দ করো। টিভি , খবরের কাগজ একদম বন্ধ। খালি দূর্নীতি , ধান্দাবাজী, জঘন্য পলিটিক্স ওফ্ফ , অসহ্য। সেসব থেকে এক্কেবারে শতহস্ত দূর।
তখনই একটি ছোট ছেলে। চাউমিনের প্যাকেট গুলো নিয়ে এলো।
ব্রজেশ সেগুলো টেবিলে রাখতে বলে , আরও গোটাকয়েক মোমবাতি নিয়ে আসার জন্য বললো। ছেলেটা নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে চলে গেল।
নাও, সবাই গরম গরম খেয়ে নাও। দ্যাখো আবার কেমন বানিয়েছে। মিসেস রায় সকলের হাতে একটা করে প্যাকেট তুলে দিলেন।
ঘরে হোক কিংবা বাইরে। খাবারের তদারকি করা থেকে পরিবেশন করার অলিখিত দায়িত্ব মেয়েদের হাতেই থাকে। সেটা শুধুই মানানসই নয় , খাদ্যের স্বাদও যেন বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়।
দেবী অন্নপূর্ণার কাছে , দেবাদিদেব কেও হাত পেতে দাঁড়াতে হয়।
ছেলে মেয়ে দুটোর জন্যে,,,, থাক , যখন আসবে খাবে। ঠান্ডা হয়ে যাবে । ভালো লাগবে খেতে তখন?
এই হলো মায়ের মন। খেয়ে নয়। সকল কে খাইয়ে তৃপ্তি। সকলের ভালো লাগাই তার ভালো লাগা। তার অপরিসীম আনন্দ বোধ । এখানেই সে জয়ী। অপরাজেয়। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি । হে মাতৃরূপা প্রকৃতি , তোমাকে শতকোটি প্রণাম।
খাওয়া পর্ব শেষ । এখন কফি পর্ব চলছে। কফির কাপ হাতে নিয়ে তন্ময় খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ,, আরিব্বাস কী দারুণ রে। এদিকে এতক্ষণ চোখ যায়নি কেন রে? এই দীপেন , ব্রজেশ এদিকে আয় একবার । তাকিয়ে দ্যাখ। ফাটাফাটি।
দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ ঢাকা সাদা চূড়ায় চাঁদের আলো লুটোপুটি খেলছে। রুপোর মুকুটে সেজে উঠেছে পর্বত রাণী।
প্রফেসর বিভোর হয়ে উদাস কন্ঠে বললেন,,,
অপূর্ব,,, অনির্বচনীয় ,,, সুন্দর ।
দীপেন মোহিত হয়ে , হঠাৎ উদাত্ত গলায় গান ধরলো,,,,
আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও ,
আপনা এই লুকিয়ে রাখা ধূলার ঢাকা ,,,,
ধুইয়ে দাওও,,,,
সেই গানে সকলেই গলা মিলিয়ে দিলো। তৈরি হলো সত্যিই এক স্বর্গের পরিবেশ ।
বিদ্বেষ বিহীন শান্তিময় এমন স্বর্গীয় পৃথিবীতে অনন্ত কাল বেঁচে থাকা যায় ।
কিন্তু অশান্তি পিছুছাড়ে না। ছেলে মেয়ে দুটো এখনো ফিরলো না। দুজনেই মোবাইল ফোন লজে ফেলে গেছে। যোগাযোগ অসম্ভব। ক্রমশ,,
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।