এক মাসের গল্পে সুপর্ণা বোস (তৃতীয় পর্ব)

চাঁদের কণা

_তুমি আমি আমরা যখন আর থাকব না তখন ওর কি হবে অর্ণব?নর্ম‍্যাল মানুষের এই মস্তবড় পৃথিবীতে কে ওকে বুঝবে?কে বা ওর সহায়ক হবে?
মিলির গলা ভারি হয়ে আসে।অর্ণব মিলির হাতে একটু চাপ দেয়
_এতো চিন্তা কোরোনা মিলু।এখনো অনেক সময় আছে।এই তো সবে ছ বছর।চিকিৎসা শাস্ত্রেরও কম উন্নতি হয়নি।ওর বোধবুদ্ধির জায়গাটা আরো ডেভেলপ করবে।দেখো।তুমি তো বলছিলেL karnocine দিয়ে একটু যেন ইমপ্রুভমেন্ট দেখছ?
_প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল অর্ণব।দুমাস পরে আর তেমন কোনো পার্থক্য আমি বুঝতে পারছি না । তাছাড়া এটা নিয়ে ড.রায়ও আর খুব একটা গুরূত্ব দিলেন না জানো?
ঘাটের সিঁড়ির প্রায় শেষ ধাপে জলের খুব কাছাকাছি বসেছিল ওরা।জোলো হিমেল হাওয়ার মধ‍্যেও হঠাৎ যেন একটু গরম লাগছিল ।কার্ডিগানের গলার দিকের কয়েকটা বোতাম খুলে একটু আলগা করল মিলি।এই ক বছরে সে এংজাইটির পেসেন্ট হয়ে পড়েছে।একটা মাইল্ড ডোজের এংজিওলাইটিক চলে তার। খুব উদ্বেগ বাড়লে সে অবনঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল নিয়ে বসে।যেভাবে তার ছেলেবেলায় মা ছুটির দিনের দুপুরবেলাগুলোতে তাকে আর দাদাকে পড়ে শোনাতো।সেভাবেই সেও সোনাকে নিয়ে দুপুরভর সুয়োরানী দুয়োরানীর গল্প পড়ে শোনায়।সোনা হয়ত কিছুই শোনে না।অথবা শোনে।বোঝে অথবা বোঝে না।কিন্তু মিলির কেমন জানি একটা সেন্স অফ সিকিউরিটি তৈরি হয়।কিছুক্ষণের জন‍্যে মনে হয় সব ঠিকঠাকই আছে।কোথাও কোনো বিপন্নতা নেই।

বেনারস থেকে ঘুরে আসার পর মিলির আর সেভাবে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি।অর্ণবকে কলেজের কাজে বছরে দুবার জয়পুর যেতে হয়।মাস খানেক মতো থাকতেও হয় সেখানে।অর্ণব মাঝেমাঝে মিলি ও সোনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চায়।কলেজের গেস্টহাউস আছে।থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত।মস্তবড় জায়গা নিয়ে ফলের বাগান।সোনারও ভাল লাগবে উন্মুক্ত পরিবেশে।মিলি যেতে পারেনি।এই শহরের বুকে স্পেশাল চাইল্ডদের জন‍্যে স্কুল বানাবার সংকল্পে এগিয়ে চলেছে।যেকোনো কাজে অর্থ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তারপর লোকবল।মিলি অপরূপা ও স্নিগ্ধার জমানো টাকার একটা বড় অংশ একটু একটু করে এই প্রতিষ্ঠানে ঢুকে গিয়েছিল। কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিজেদের খরচেই প্রশিক্ষিত করিয়েছিলেন তারা। একসময় স্নিগ্ধা ও অপরূপাও দূরে চলে গেল।স্নিগ্ধার স্বামীর বদলির চাকরি।সপরিবার হায়দ্রাবাদে চলেগেলেন।কি এক অজ্ঞাত কারণে অপরূপার সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল। একদিন নিজের সমস্ত পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে প্রস্ফুটন থেকে সরে গেল অপরূপাও।সমস্ত দায়ভার বর্তাল মিলির ওপর।

এভাবেই দশ বছর কেটে গেছে।সোনার মত আরো জনা ত্রিশেক ছেলেমেয়ে নিয়ে মিলিদের স্কুলটাও চলছে রমরম করে। তাদের ছোট্ট সোনা এখন ষোলোবছরের কিশোর। এবার কোনো একটা ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়া হবে।এতোদিনের চেষ্টায় সোনা ও তার মত আরো কয়েকজনকে টাকা পয়সা চেনা ও তার ব‍্যবহার শিখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সেন্টারে। তাদের মধ‍্যে কেউকেউ এখন দোকানে গিয়ে একাএকা ছোটোখাটো কেনাকাটা করে ব‍্যালান্সটা গুনে ফিরিয়ে আনতে পারে।পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে হলে এটিই বেসিক শিক্ষা হয়ে উঠেছে ছেলেমেয়েগুলির জন‍্যে।পেটিএমের ব‍্যবহার শেখানো গেলে কাজটি আরো সহজ হবে।এসব কাজে এডুকেটারদের ধৈর্য ও স্কিল সবথেকে জরুরী।

মিলি তার স্কুল নিয়ে বাচ্ছাদের নিয়ে খুব বেশি জড়িয়ে মড়িয়ে গেছে।দিব‍্য আছে মিলি।সে যখন থাকবে না তখন এই স্কুল আর তার লোকজন ও ট্রাস্টিরা তার সোনাকে আগলে রাখবে।মিলি খুব বেছে বেছে লোকজন রিক্রুট করে এখানে। বিশ্বাস করে এখনো পৃথিবীতে ভাল মানুষ আছে।মিলিরও জহুরীর চোখ। সেদিন যেমন গোলাপফুল বিক্রেতা মেয়েটির খবর নিতে বলেছে পারভেজকে।এভাবেই তো একদিন হর্ষকে পেয়েছিল। মিলিদের পাড়ায় একটা ছোট্ট স্টুডিও ছিল হর্ষর।কয়েকটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি তোলানোর প্রয়োজন হওয়ায় সোনাকে নিয়ে গিয়েছিল ছবি তোলাতে।কথায় কথায় জানা যায় হর্ষর স্টুডিও প্রায় উঠে যাওয়ারই মুখে।হর্ষকে ম‍্যানেজার হিসেবে প্রস্ফুটনে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল মিলি।সেও তো চার বছর হয়ে গেল প্রায়।

মিলিকে প্রস্ফুটনের প্রিন্সিপালের চেয়ারে খুব কমই দেখা যায়।হাতে কলমে কাজই তার পছন্দ।ঠাকুরঘরের কাঁসাপেতলের বাসনের মত শিশুগুলিকে মেজেঘষে ঝকঝকে করে তুলতে প্রাণপাত করে ।
হর্ষ মিলির অফিস ঘরের দরজা ঠেলে দেখল যথারীতি মিলি নেই।লাগোয়া ছোট্ট পার্কটিতে বাচ্ছাদের নিয়ে কাজ করছে। হর্ষ মিলিকে জানায় একটি শিশুকে নিয়ে এক ইয়াং কাপল এসেছেন।মিলির সঙ্গে একটু দেখা করতে চায়।

মিলি রুমে ঢুকে দেখল, একটি বছর দুয়েকের মেয়েকে নিয়ে ওরা বসে আছেন।কথা বলে জানা গেল বাচ্ছাটির স্ক্রিনিং অলরেডি হয়ে গেছে। পেরেন্টস খুব স্পষ্ট করেই জানালেন শিশুটির কোন ডোমেইনগুলিতে প্রোগ্রেস চান তাঁরা।কালার আসেসমেন্ট থেকে বাঝা গেছে ও লাল রংটি ভাল দেখতে পারে।এতে করে অবজেক্ট আইডেনটিফাই করার সময় একটু সুবিধে হয়।ধরা যাক শিশুটিকে চামচ ও তার ব‍্যবহার শেখানো হচ্ছে।অথচ শিশুটি কিছুতেই সেটা শিখতে পারছে না।কিন্তু লাল রঙের চামচ ব‍্যবহার করতেই বিষয়টি সহজ হল।অনেকসময় ব‍্যাকগ্রাউন্ড আর ফোরগ্রাউন্ডের তফাৎ বোঝাতে হয়ত সাদা প্লেটের ওপর লাল স্পুন ব‍্যবহার করা হল।তবে যেকোনো বিষয়ই সময় ও শ্রমসাধ‍্য।

দেখতে হবে পেরেন্টস তার বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চাটির থেকে ঠিক কিই চাইছেন এবং কতটা চাইছেন। বাচ্চাটির অবস্থা এবং পেরেন্টদের চাহিদা বুঝে নিয়ে প্রোফেশনাল তাঁর এডুকেশন প্রোটোকল প্রোগ্রামিং করেন।মিলি দেখল মা বাবা দুজনেই লাল রঙের পোশাক পরে আছে।শিশুটিও লাল বেবিফ্রকে ফুটফুট করছে। মিলি বোঝে মা বাবা ওর দুনিয়ায় একটুকু প্রবেশের আশায় লাল রংটিকে খড়কুটোর মত ধরেছে।মিলিরও তো এইসব দিন গেছে।মিলি বোঝে,শিশু যখন তার মাকে দেখে কোলে আসার জন‍্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে না অথবা নাম ধরে শত ডাকেও চেয়ে দেখে না তখন মায়ের কতটা কষ্ট হয়। তবে যেকোনো কষ্টই মানুষের একদিন না একদিন সয়ে যায়। যাইহোক, সামান‍্য যেটুকু ফরমালিটিজ আছে সেটুকু পুরন করে শিশুটি স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল।সামনের সপ্তাহ থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে কাজে লেগে পড়বে প্রস্ফুটনের পুরো টিম।মা বাবা দুজনেই চাকরি করে।তাই সপ্তাহে একদিনই নিয়ে আসবে স্কুলে।সেদিনই বুঝিয়ে দেওয়া হবে সারা সপ্তাহ কি ধরণের অনুশীলনের মধ‍্যে রাখতে হবে শিশুটিকে।

ওরা চলে যেতে হর্ষকে ডেকে পাঠাল মিলি।এই ক বছরে কেবল প্রতিষ্ঠানের কর্মী নয় মিলির অত‍্যন্ত ভরসাযোগ‍্য এক বন্ধু হয়ে উঠেছে হর্ষ।বসতে বলে খানিক্ষণ টেবিলের ওপর পেপারওয়েটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল মিলি।হর্ষ জানে মিলি মনেমনে গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে।নিজের ব‍্যক্তিগত বিষয়ে মিলি যে কতখানি চাপা তা হর্ষ বিলক্ষণ জানে।হর্ষ মিলির দিকে চেয়ে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পরে ধীরভাবে মিলি বলল
_আজ সকালে জয়পুর থেকে ফোন এসেছিল
_ঠিক আছেন তো? মিস্টার দস্তিদার?
_হ‍্যাঁ।মিলি আরো একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল

_কয়েকদিনের মধ‍্যে ডিভোর্স পেপার এসে পড়বে

হর্ষ চমকে উঠল, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করল না।মিলি আবার বলল
_আমি অবশ‍্য জানতাম।আজ নয় কাল এটা আসবেই।ওদের কলেজের অধ‍্যাপিকা রত্নাবলি স‍্যান্নালের ডিভোর্সের খবরটা যখন পেলাম তখনই বুঝলাম।তবু সব বুঝেও মনকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।অর্ণব আমার সহপাঠী ছিল।কলেজ থেকেই প্রেম।তবু সম্পর্ক তো আর করপোরেশনের ল‍্যাম্পপোস্ট নয়। যে একবার বাতি জ্বেলে দিলে রাত কাবার করেও জ্বলতেই থাকবে…ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলাম আমরা।

মিলি মুখ নিচু করে থাকে অনেকক্ষণ।হর্ষর ইচ্ছে করে মিলির হাতটি স্পর্শ করতে। স্পর্শই একমাত্র সান্ত্বনার নিঃশব্দ ভাষা।

জীবন এক অলৌকিক মন্থন।কিছুটা মধু আর বিষ নিত‍্য জমা হয়।কখনো সেই বিষ পরবর্তী দিনগুলির জন‍্য জীবনদায়ী ওষুধ হয়ে ওঠে।মানুষের ভিতর যে আকাঙ্খার বিহঙ্গটি থেকে থেকে ডানা ঝাপটায় তার সঠিক জোড়াটি বুঝি সহজে মেলে না। আর্তির ভিতর সৃষ্টি হয় এক রমনীয় অন্তরাল।আলোছায়ার আমলকীবন।সেখানেই এক একলা দোয়েল ডেকে যায় বারবার।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।