বিশ্বকর্মার কুঠারটার দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে মা দুর্গা। কতদিন হয়ে গেলো, ব্যবহার হয়না, তবু একই রকম জৌলুস! অস্ত্রটা দেওয়ালে টাঙানো। সকাল থেকেই আজ মায়ের মন উচাটন। কোথাও একটা কিছু ভুল হচ্ছে, অনেক দিন ধরে ভুল হচ্ছে! ভুলটা ঠিক করা দরকার মনে হলো। আনমনে মা দুর্গা উঠে এলেন অস্ত্রটার দিকে। তাঁর আজ ইচ্ছে হলো অস্ত্রটা নিয়ে ধারটা পরীক্ষা করতে। কৈলাসে এদিক-ওদিক বড় পাথরের ছড়াছড়ি। কুটির থেকে বেরিয়ে খুঁজলেন মা। বড় একটা পাথরের খন্ড খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না তাঁর। পাথরে কোপ পড়লো, বিশ্বকর্মার পরশু আজ শিল্পকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ল!
__________________________________________________________________
হাইস্কুলের বাথরুমে দরজার ভেতরে ঢুকে বুক কেঁপে উঠলো কিশোরটির! জীবনে প্রথম পাওয়া প্রেমপত্র বলে কথা! প্যান্টের পকেট থেকে চিঠিটা বের করে পড়তে পড়তে খেয়ালই নেই কখন আশেপাশে ঘিরে এসেছে আরো কিছু সহপাঠী! তারা কিশোরটির আবেগমথিত ছলোছলো চোখে প্রেমপত্র পড়তে দেখে ব্যাঙ্গে-উপহাসে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! কিশোরটির যে বিশাল চোখদুটো একটু আগে প্রেমের আবেগে ছলছল করছিলো, তাতে এবার লজ্জায় সংকোচে থৈথৈ করলো আবেগ। কেন? প্রেমপত্র তো সবাই পায়, তাঁরও তো প্রেমপত্র দেখে আবেগ উপচে ওঠে! নাঃ, এভাবে থাকা যায় না।
___________________________________________________________________
পাথরের ওপর কোপে কোপে মায়ের হাতের জাদু ফুটে উঠছে একটু একটু করে। জটাজুটধারী মুর্ত্তি, চওড়া পুরুষালী কাঁধ, দীর্ঘদেহ, সবল সুঠাম দুটো পা, বলিষ্ঠ বাহু – মা কি সোমনাথের মূর্ত্তি তৈরী করছেন? কাঠামো দেখে তো তাই মনে হয়! শিবের মতন বৌপাগলা বলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাঁর নাম ছড়িয়ে নেই ঠিকই, ব্যক্তিত্বে মা অতুলনীয়া, তবু তিনি যে স্বামী অন্তপ্রাণ, পতিপ্রেমে তাঁর জুড়ি নেই – এ কথা ত্রিভুবন বোঝে! মায়ের তন্ময় হয়ে শিল্পসাধনায় স্তম্ভিত-বিস্মিত দেবতারা। যাকে বলে ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’ সেরকম ভাবে সবাই মা দুর্গার পিছনে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আজ একটা অনন্যসাধারণ কিছু হতে চলেছে – এই আশায় রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকে সারা কৈলাস।
____________________________________________________________________
“কতদিন লাগবে ডাক্তার?”
“ভালো করে ভেবে বলো! এতগুলো অপারেশন, রিস্কি হবে! সেগুলো মাথায় আছে তো?”
“এই তো সামনেই, আঠারোয় পা দেব! অ্যাডাল্ট মানুষের তো বন্ডে সই থাকলেই হলো। আমার রিস্ক আমি বুঝেই নেবো, আপনি তো খালি অপারেশনটুকু করবেন”
“ভুল বুঝো না। তোমার মতো সুস্থ শরীর আর বলিষ্ঠ মন ও সাহস না থাকলে আমি অপারেশনে রাজি হতাম না। অনেক ওষুধ খেতে হবে, অনেক সাইড এফেক্ট। অনেক মনের জোর চাই”
“আর কথা বাড়াবেন না। আপনি কবে থেকে শুরু করবেন বলুন”
“বেশ মনস্থির করেছো যখন, এসো! ঈশ্বর সহায় হোন!”
ঈশ্বর সহায় হলেন! জটিল অপারেশনের প্রতিটা সফল হতে লাগলো। শারীরিক-মানসিক বলে অসীম শক্তিশালী মানুষটি একটা একটা করে বাধা পার করতে লাগলো। শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক ডিপ্রেশন, অস্থিরতা, সামাজিক
বিরোধ – কিচ্ছুকে পাত্তা দিলো না। ডাক্তারের ওপরে ধন্বন্তরী ভর করলো। ডাক্তারের হাতের অস্ত্র বিশ্বকর্মার কুঠারের মতন নিখুঁত-নিপুণ হয়ে উঠলো।
_____________________________________________________________________
পাথরের গায়ে নিপুণ সোমনাথের বিগ্রহটি শেষ করেও মা দুর্গা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছেন সেদিকে! দেবদেবীরা রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়! সবাই বুঝতে পারছে আরো কিছু হতে চলেছে! বেশ কিছু সময় পরে দেবী হঠাৎ অস্ত্রনিক্ষেপ করলেন সোমনাথ-বিগ্রহের সুবিশাল বক্ষবরাবর। বিস্ময়ে সকলে দেখলো ক্ষিপ্রহাতে বিশ্বকর্মার পরশু তৈরী করে চলেছে সুডৌল স্তন, সুঠাম কোমর নিলো রমণীয় বাঁক, খসে গেলো মাথার জটা! আঘাতে আঘাতে বিশ্বকর্মার পরশু কুঁদে বার করলো এক কোমল নারীকে!
সেই মুহূর্তে মর্ত্যে উকিলের অফিসে বসে সুন্দরীটি। বাস্তবের পরশু ডাক্তারের অস্ত্র হয়ে কুঁদে বার করেছে তার পুরুষের খোলস ভেঙে এক জ্যোতির্ময়ী কোমল নারীকে! নবজন্ম হয়েছে তাঁর আজ।
ত্রিভুবনের সামনে অত্যাধুনিক সিনেমার পর্দার মতো স্ক্রিনটা দুভাগে ভাগ হলো। একসাথে উকিল নারীকে, দেবতারা মা দুর্গাকে প্রশ্ন করলো – “নবজন্ম সার্থক, মা! কি নাম দেবো এ সৌন্দর্য্যের?”
দুটো স্ক্রিনে পাশাপাশি মা দুর্গা ও সুন্দরীর মুখ। দুটো স্ক্রিনেই গভীর চোখের পাতা ধীরে ধীরে মেলে সুবিশাল চোখদুটো নিবদ্ধ হলো প্রশকর্ত্তার চোখে। ভুবনমোহিনী হাসি ভেঙে দুটো স্ক্রিনে একসাথে উত্তর এলো
“মানবী”