ক্যাফে প্রবন্ধে রাইলী সেনগুপ্ত (পর্ব – ১)

মেঠোপথের সন্ধানে – ১

(বাংলার লোক সংস্কৃতি বিষয়ক)

“মাস্টর বললেক, পলাশ ফুলের গাছটা না হয় বুঝলাম
গাছের তলায় মাটির ভিতরে
তুই ই সব আঁকিবুঁকি কি আঁকলি?
বললম,উগলা শিকড় বঠে হে মাস্টর
চিনতে লারছ….”
-শিকড়/দেবব্রত সিংহ
বাস্তবের রূঢ়তা ও তথাকথিত আধুনিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় বর্তমানে বাংলার সেই শিকড় এখন বিপন্ন। যান্ত্রিক সভ্যতার আবহমানেওস্নিগ্ধতা ও শ্যামলিমায় পরিপূর্ণ প্রাণের ভাষা ও দরদে গ্রাম বাংলার রূপ- রস -গন্ধ -স্পর্শ বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাদের ফেলে আসা শিকড়ের টানে- সেই সংস্কৃতির কাছে। গ্রামবাংলার মানুষের সহজ সাধারণ জীবন যাপনে স্মৃতির জীবাশ্মে থাকা যে ধারাবাহিকতা দরদে মাখা আবেগে বিচিত্রভাবে প্রকাশিত হয় তাই হল লোকসংস্কৃতি। স্যার ই.বি.টাইল-এর মতে,”জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার- বিশ্বাস, শিল্প-কলা, নীতিবোধ আইন -কানুনএবং অনুশীলন ও অভ্যাস এবং অন্যান্য সব সম্ভাবনা যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসাবে সংগ্রহ করে তাই সংস্কৃতি”[সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি তত্ত্ব]। কোন দেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে নগর সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি – এই দুই ধারায় বর্ণনা করা যায়।
সরলতা ও অকৃত্রিমতায় পূর্ণগ্রামবাংলার মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক, বিশ্বাস ও আচার-আচরন, জীবনধারা ও বিনোদন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে লোকসংস্কৃতি। আবার নগরের জনগোষ্ঠীর শিক্ষাদীক্ষা, বৃত্তি পোশাক, আহার-বিনোদন, যাতায়াত ও উৎপাদন ইত্যাদি সহযোগে গড়ে ওঠে নগর সংস্কৃতি। বাংলার রূপ-রস গন্ধে-স্পর্শে চিরভাস্বর হয়ে ওঠে লোকসংস্কৃতি। গঠন অনুসারে সাধারণত এই লোকসংস্কৃতি কে দুটি ভাগে বর্ণনা করা যায়-১. বস্তু নির্ভর অর্থাৎ যে লোকসংস্কৃতিতে লেখ্য কোন সাহায্য ছাড়াই মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির রূপায়ণ হয়। যেমন- পোশাক, কুটির শিল্প ,দেওয়াল চিত্র ইত্যাদি। অপরদিকে, লোকসাহিত্য অবস্তু নির্ভর লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ বাংলার মাটির টানে, মাটির স্পর্শে প্রাণের ভাষা ও বাঙালির আবেগ রাঙ্গামাটির ঘ্রাণে, বহুপ্রতীক্ষিত গল্প কথায়, কখনো মাদলের তালে কখনও ছৌ-এর মুখোশে, কখনো ভাদু- টুসুর পরবে, সঙ্গীত-সাহিত্য-নৃত্য-চিত্র- উৎসব-সংস্কার-ধর্ম-শিল্প সবকিছুর পসরা সাজিয়ে স্মৃতি ও আবেগের টেরাকোটায় বাঙালির মননে ও স্মরণে প্রতিভাত হয় বাংলার লোকসংস্কৃতি।

||লোকগান||

ধামসা মাদলের অকৃত্রিম মাটির সুরে, আঞ্চলিক ভাষার মাধুর্যে,গ্রাম বাংলার স্নিগ্ধতায়, সুর,ছন্দ ও কথার মেলবন্ধনে প্রকাশিত হয় লোকগান। মৌখিক পরম্পরা নির্ভর, আঞ্চলিক ভাষায় স্পন্দিত এই লোকগান সম্পর্কে পাশ্চাত্য সমালোচকের মতে,
“Whatever the sources, however, it is oral circulation that is the best general criterion of what is a folk song.”
মাটির টানে, নান্দনিকতার সন্ধানে লোকসংগীত শিল্পীদের ঐকান্তিক সাহচর্যে বিভিন্ন ধারার লোকসংগীত স্বতন্ত্র্য ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে শ্রদ্ধেয় অভিজিৎ বসু, তপন রায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব,শ্রদ্ধেয় কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য-এর ‘দোহার’ এবং নারীকেন্দ্রিক ও আরো অন্যান্য লোকগানের দল স্বকীয়তার দাবি রাখে। ৩০-৪০দশকে আবাস উদ্দিন,অনন্তবালা বৈষ্ণবী, শচীন দেব বর্মন, আব্দুল করিম শাহ, পরবর্তীতে পূর্ণ দাস বাউল, ভূপেন হাজারিকা, নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং সত্তর-আশির দশকে গোষ্ঠ গোপাল, রুনা লায়লা, অমর পাল প্রমুখ ব্যক্তিরা ‘ফোকো মডার্ন’ ধারাকে প্রচলন করেছিলেন। তারও পরে স্বপন বসু, সনজিৎ মন্ডল, সুকন্ঠ অধিকারী, প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারী, পরীক্ষিত বালা, অভিজিৎ আচার্য প্রমুখ ব্যক্তিরা এই গানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বর্তমানে লোকগানের মন মাতানো মেঠোসুরের সাথে নাগরিক সভ্যতার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে নানান ফোক ব্যান্ড। একদিকে দোতারা, বাঁশি, ঢোল, পাখোয়াজ, তবলা, খঞ্জনি ইত্যাদি দেশীয় যন্ত্র ও অন্যদিকে এর পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহারে লোকসংগীতে ক্রমশ পরম্পরার সঙ্গে আধুনিকীকরণের মিশেল ঘটেছে।
“লোকসংগীত অনেকটা আটপৌরে মা”- শ্রদ্ধেয় গবেষক শুভেন্দু মাইতির উক্তি লোকসংগীতের ধারা ও বৈচিত্র্যকে নিয়ে সাংস্কৃতিক উঠোনে বারংবার স্নেহের পরশ রেখে যায়-
১. বৈষ্ণব পদাবলী-
চতুর্দশ শতকে বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস-এর হাত ধরে সাধারণত পাঁচ প্রকার রসের(শান্ত,দাস্য,সখ্য, বাৎসল্য,মধুর) সমন্বয় রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে এই ধর্মসংগীত এর সূচনা হয়। শ্রীকৃষ্ণের ভগবান রূপ থেকে মানব রূপের পরিবর্তনে ব্যক্ত হয় এই পদাবলীর প্রতিটি রস। নরহরি সরকার, বাসু ঘোষ,লোচন দাস,জ্ঞান দাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ ব্যক্তিরা ব্রজবলি ও বাংলা ভাষায় রচিত এই বৈষ্ণব পদাবলীকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই সংগীতে যমুনা, কদম্ব কানন, বংশী ধ্বনি ইত্যাদি বারবার প্রকাশ পায়। শ্রীচৈতন্যদেব একে ধর্মীয় আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভানুসিংহের পদাবলী'(‘গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে’,’মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’ ইত্যাদি)-এর বিভিন্ন গান বৈষ্ণব পদাবলীর অনুপ্রেরণায় রচিত।
২.তত্ত্ব সঙ্গীত-
এই সংগীতে অন্তর্নিহিত ভাব সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত না হলেও এর মধ্যে সাহিত্যিক রসের অভাব বোধ হয় না। এক্ষেত্রে উপমা রূপক ও অন্যান্য অলংকারে গানের কথা প্রকাশিত হয়।রামপ্রসাদের শ্যামা সঙ্গীতে এই ধরনের ভাব প্রকাশিত হয়।
৩.ব্যবহারিক-
পারিবারিক জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে এই ধরনের গান বা মেয়েলি সংগীত গাওয়া হয়। বিবাহ, পঞ্চামৃত ,সাধভক্ষণ, গর্ভাধান অন্নপ্রাশন, উপনয়ন , শোক ইত্যাদির মতো এবং দীর্ঘ দিন ব্যাপী যেকোনো অনুষ্ঠানে এই সংগীত পরিবেশিত হয়।
যেমন: বিবাহের সাজ-
“সাজো সুন্দরী কইন্যা….”
জলভরা-“আমি কি হেরিলাম যমুনার কূলে….”
দ্বিরাগমন বা বিয়ের পরের দিন- “তোমরা শুনছনিকো রাই….”
৪.আনুষ্ঠানিক:
কোন পার্বণ উপলক্ষে এই ধরনের সংগীত গাওয়া হয়। পারিবারিক বা ব্যবহারিক সঙ্গীতে নির্দিষ্ট দিন থাকেনা কিন্তু আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতে পূর্ব নির্ধারিত সময় থাকে। পুরুষ ও নারী উভয় অংশগ্রহণ করে। মেয়েলি ব্রত নারীরা, গাজনে পুরুষরা, মাঘ মন্ডলের মত কুমারী ব্রতে কুমারিরা এবং লৌকিক দেব দেবীর পূজায় ছেলেরা অংশগ্রহণ করে। জারি, বোলান, পৌষ পার্বণ, নীল পূজা, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই আনুষ্ঠানিক গান করা হয়।
ক. জারি: পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলায় মুসলিম সমাজের বয়াতিরা তাঁর সঙ্গী বা দোহারের সমাবেশে এই ক্রন্দনরত গান পরিবেশন করেন। কারবালার যুদ্ধ হাসান হোসেন ও অন্যান্যদের বেদনা নিয়ে আহাজারি সুরে এই গান পরিবেশিত হয়।
খ.কৃষি: কৃষি প্রধান দেশ বাংলায় কৃষিকাজ বাইরের কাজ হলেও নারী-পুরুষ উভয়ের সহায়তায় এটি সম্পন্ন হয়। পারিবারিক সঙ্গীতে জীবনের প্রয়োজনীয়তা অবলম্বনে গান হয় কিন্তু এক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে বৃহত্তর ব্যবহারিক মূল্য সাধিত হয়। যেমন কৃষি ও ফসল কাটার অনুষ্ঠান ‘পুণাহ অরনা’ এবং’নবান্ন’, ‘করম কুমারী ব্রত’ ও ‘জিতিয়া বিবাহিত নারী ব্রত'(উর্বরতা, প্রজনন ও কৃষি সম্পর্কিত), কার্তিক মাসে ‘সোহরাই দেবতার পূজা’, অঘ্রানে ‘গ্রামবান্ধা’ পূজা,বসন্তে ‘ফারহুল’, আষাঢ়ে ‘আষাঢ়ি’, ‘কার্তিক ব্রত’ইত্যাদি উৎসবে কৃষিকেন্দ্রিক গানে আন্দোলিত হয় সাধারণ জীবনের উল্লাস। দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকার কৃষকরা বীজ বপনের সময় চোকচুন্দ্রী নামক গান করে থাকেন।
গ.বোলান: নদীয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ জেলায় গায়ক ও বাদকদের সমন্বয়ে বন্দনা ও পাঁচালী সহযোগে এই গান করা হয়। বিভিন্ন লৌকিক প্রিয়া কার্য এই গান পরিবেশিত হয়।
ঘ.ঝাঁপান: শ্রাবণ সংক্রান্তিতে এই গানের সাহায্যে সাপুরিয়া সাপের বিষ দূর করার কৌশল গ্রহণ করেন।
ঙ.অষ্টক ও গাজন: চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে তিন দিনব্যাপী এই গান গাওয়া হয়। গাজনের উৎসবে এই গানের চর্চা দেখা যায়।
তাছাড়া জন্মাষ্টমী, পৌষ পার্বণ, দোল উৎসব ভাইফোঁটা, দুর্গোৎসব ইত্যাদি নানান পার্বণে আনুষ্ঠানিক গান করা হয়।
৫.আঞ্চলিক গান:
বাংলার প্রান্তবর্তী অঞ্চলে লোকসংস্কৃতি অক্ষুণ্ন থাকলেও মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিভিন্ন কারণে বারংবার তা পরিবর্তিত হয়েছে। এর নিরীখে এই অঞ্চলকে চারটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়-
পশ্চিম (মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান, মানভূম, বীরভূম), উত্তর (মালদা, দিনাজপুর ,জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, রংপুর ), উত্তর পূর্ব (পূর্ব মৈমনসিংহ, পশ্চিম শ্রীহট্ট, উত্তর ত্রিপুরা) এবং দক্ষিণ-পূর্ব (নোয়াখালী, চট্টগ্রাম)।
ক.পটুয়া:পশ্চিমের কিছু লোকেরা পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে পট আঁকেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেন, যাকে পটুয়া সংগীত বলে। কিছু পটুয়ার সাপুড়ের ব্যবসা গ্রহণ করলে তাড়াতাড়ি মনসার গান করেন। কখনো পথে শ্রীকৃষ্ণের ছবি অঙ্কন সহ গান করা হয়।
খ.করম পরব:রাঢ়বঙ্গের আদিবাসীরা প্রচুর ফসলের আশায় সারারাত ধরে লৌকিক কাহিনীর সাথে নাচের সমন্বয়েএই গান গায়।
গ. ঘাটু: মূলত বর্ষাকালে নারী বেশে নৌকায় বসে সুদর্শন বালকরা বালিকার বেশে এই গান গায়। গ্রামের ঘাটে ঘুরে ঘুরে এ গান গাওয়া কে ঘাটু বলে। মনসার ভাসান, বিজয়া ইত্যাদি উপলক্ষে সমবেত ও বৈঠকি এই দুই ধারায় এই গান করা হয়। এই গানের কথার চেয়ে সুখ বেশি প্রাধান্য পায়-
“আমার দুঃখের কথা কারে জানাই,লো সই….”
ঙ.জাগ: রংপুর, রাজশাহী, পাবনা অঞ্চলে সাধারণত পৌষ মাসে রাত জেগে এই গান গাওয়া হয়।উত্তরবঙ্গের এই গানের সোনাপীরের কীর্ত্তন শোনা যায় ।এতে কোনো সুবিন্যাস্ত কাহিনী থাকে না।
চ.আলকাপ: মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদীয়া ইত্যাদি অঞ্চলে রাধাকৃষ্ণের প্রণয় ও ঘটনার সংমিশ্রণে মুসলিম কৃষকগণ এ গান করেন। ১০-১২ জন শিল্পীর সহযোগে ‘গুরু’, ‘ছোকরা’, ‘দোহার’দের সহযোগে পাঁচটি অংশে তথা ‘আসর বন্দনা’, ‘ছড়া’, ‘বৈঠকি গান’, ‘খেমটা পালা’ এর মাধ্যমে পরিবেশিত হয়।
ছ. ক্ষণ গান: দক্ষিন দিনাজপুর এলাকার লোকেরা নিজস্ব রীতিতে গান পরিবেশন করে।
জ.লেটো: পালাগানের আকারের রচিত এই গান বর্ধমান জেলায় নৃত্য-অভিনয় সহযোগে পরিলক্ষিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবে এই লেটোর দলে যুক্ত ছিলেন।
ঝ.কাজরী: ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা তিথিতে উত্তরপ্রদেশে কাজলি দেবীর উদ্দেশ্যে এই গান গাওয়া হয়।
ঞ.রাখালিয়া: রাখাল বালকেরা মাঠে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গোচারণের সময় এই গান করেন।
ট. বিহু: মূলত বৈশাখ মাসে ‘বহাগ’, ‘কাতি’ ও ‘মাঘ’ এই তিন প্রকার বিহু সাধারণত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উদযাপিত হয় এবং এই বিহু উৎসবেই নাচের সাথে পরিবেশিত হয় বিহু গান।
ঠ.মারফতি:চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা ইত্যাদি অঞ্চলে এই গানের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার ভাব ব্যক্ত হয়।
এই গানে অঞ্চলভেদে শব্দের রূপভেদ লক্ষ্য করা যায়।
ড. কবিগান-তাৎক্ষণিক সুরের প্রয়োগে কবিয়ালদের মাধ্যমে লোকো কবিদের প্রতিযোগিতা হত। গোঁজলা গুঁই টপ্পা রীতিতে কবি গান করতেন। পরবর্তীতে কেষ্ট মুচি, রঘুনাথ দাস, নিত্যানন্দ বৈরাগী, শম্ভুনাথ মন্ডল, কবি মুকুন্দ দাস এবং জন্মসূত্রে পর্তুগিজ এন্টনি ফিরিঙ্গি প্রমুখ কবিয়ালরা এই গানের উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন।
ঢ.আখড়াই-২২ টি যন্ত্রের মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে কৃষ্ণনগর,শান্তিপুর, কলকাতায় এই গানের প্রচলন দেখা যায়। বৈষ্ণব দাস, রামজয় সেন, দুর্গা প্রসাদ বসু, পার্বতী চরণ বসু, নিধুবাবু প্রমুখ ব্যক্তির সহায়তায় এই সকল গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল-
“মনের যে সাধ মনেতে রহিল!
তোমার সাধনা করি সাধ না পুড়িল….”
ণ. ভাটিয়ালি-
“ও পদ্মা নদীর নাইয়া রে/ঢেউয়ের দোলায় নৌকা তোমার/ চলছে ধাইয়া ধাইয়া রে….” সূর্যের রক্তিম আভা, নৌকার মন্থর গতি ও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সাথে প্রেম- প্রীতি- ভালোবাসা,
আকুলতা,বিরহ সব মিলেমিশে এক সুরে ব্যক্ত হয় এই গানে। নদীমাতৃক সভ্যতায় মাঝি-মাল্লাদের এই গানে প্রকাশিত হয় এক গভীর অনুভব অকৃত্রিম সুর। কবি নিবারণ পন্ডিত রশিদ উদ্দিন, আব্বাস উদ্দিন,জসীম উদ্দিন, শাহ আব্দুল করিম প্রমুখ ব্যক্তির সহায়তায় এই গান আজও মনোগ্রাহী।
ত. ভাওয়াইয়া-
জলপাইগুড়ি কোচবিহার রংপুর অঞ্চলে কামরূপী ভাষা এই গান ‘গাড়োয়ালি'(গরু-মোষের গাড়ির চালক),’মৈষলে'(প্রেমিকের উদ্দেশ্যে),’চটকা’ (রসিকতা) প্রভৃতি ভাগে মূলত দোতারা সহযোগে গাওয়া হয়।’বাউদিয়া’ তথা এই গানের গায়করা সাধারণত বিবাগী হয় এবং এটি একটি দৈব প্রসঙ্গহীন প্রেম-বিরহের উপাখ্যান। কবি জসীমউদ্দীনের সেই গান ভাওয়াইয়ার আদলকে বারংবার মনোগ্রাহী করে তোলে-
“বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে….”
থ.ভাদু গান:
দক্ষিণবঙ্গের কিছু অঞ্চলে সারা মাস সারা ভাদ্র মাস জুড়ে চলে ভাদু উৎসব। অনেক সময় ভাদ্র মাসে ভাদু প্রতিমা নিয়ে দরিদ্র মানুষেরা পয়সার বিনিময়ে নাচ গান দেখাতো। ভাদ্র মাসের শুরু হয়ে এই উৎসব শেষ হয় ভাদ্র সংক্রান্তির বিকেলে ভাদু প্রতিমার বিসর্জনের মাধ্যমে। ভাদু আসলে রাঢ়বঙ্গের লোক জীবনে জড়িয়ে থাকা মেয়েদের কাহিনী। অনেকের মতে, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কাশীপুরে নীলমণি সিংহ দেবের কন্যা ভদ্রেশ্বরীর বিবাহ অনুষ্ঠানে ডাকাতদের কবলে পড়ে বর মারা যান এবং সেই শোকে আত্মঘাতী হন ভদ্রেশ্বরী। আর সেই স্মৃতিতেই ভাদু গানের উৎসব। আবার অনেকের মতে, ভাদু হলেন লক্ষীদেবী, অনেকে মনে করেন ‘পুন্যি পুকুর’- এর মত ইহাও এয়োস্ত্রীদের এক ব্রত। ভাদু গান ‘ভাদু উৎসব’- এর আগমনী, স্থাপন, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা,নিন্দা ও প্রত্যুত্তর, বিবাহ, বিদায় ইত্যাদির মাধ্যমে গানের সাথে ভাদু দেবীর মাটির মূর্তিকে পুকুর বা নদীর ধারে নিয়ে পূজার শেষ হয়, যা বিজয়ারীতির সঙ্গে মিল যুক্ত। ভাদু সুরে থাকা এই গানগুলো দেবীর আগমন ,স্থাপন, বিদায় সবকিছুতেই ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। ভাদু হয়ে ওঠে তাদের ঘরের কন্যা, তাই বিদায় গানে প্রকাশিত হয়-
“প্রাণের ভাদু বিদায় দিই কেমন করে….।”
বেশিরভাগ ভাদুঘর লোকসঙ্গীতের ঘরানায় থাকলেও পঞ্চগড় রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এক অন্য ভাদু গান তৈরি হয়েছিল।
দ. টুসু:
অগ্রহায়নের শেষ থেকে পৌষ সংক্রান্তি শেষ পর্যন্ত রাঢ়বঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে বাহনহীনা হলুদাভ মূর্তি পূজার সাথে সামাজিকতা ও লৌকিকতার বন্ধনে নারীর কলহ, দ্বেষ, দুঃখ সুখ ইত্যাদির মাধ্যমে টুসু গানকে পরিবেশন করা হয়। সবশেষে জলে দেবীর বিসর্জন এর মাধ্যমে দেবীকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো হয়-
“জলে হেলো, জলে খেল,
জলে তুমার কে আছে।
আপন মনে ভেবে দেখ
জলে শ্বশুর ঘর আছে।”
ধ. ঝুমুর:
রাধা কৃষ্ণের বিরহ-মিলন, লৌকিক বিষয় প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম ,সাঁওতাল পরগনা, ময়ূরভঞ্জ, সম্বলপুর, হাজারীবাগ ইত্যাদি অঞ্চলে সাধারণত ধামসা মাদল সহযোগে এই গান পরিবেশিত হয়। পশ্চিমবাংলা পশ্চিম সীমান্তে দোভাষী সাঁওতাল সম্প্রদায় নিজেদের উৎসবের রচনা করে থাকে। লোকসংস্কৃতি গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে এর নানা ভাগ করেছেন- কৃষ্ণলীলা ঝুমুর, রামলীলা ঝুমুর,সাঁওতালি ও টপ্পা। শ্রদ্ধেয় বিনয় মাহাতো লৌকিক, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক, পৌরাণিক, দরবারি, টাইড় প্রভৃতি ভাগে আবার সুবোধ বসু রায় উচ্চাঙ্গ ,লৌকিক, মেঝাইল ভাগে বিভক্ত করেন। শ্রদ্ধেয় সুধীর করণ ঝুমুর নাচের ভিত্তিতে একে দাঁড়,টাইড়, কাচি নাচের ঝুমুর, নাচনি নাচের ঝুমুর হিসেবে বিভক্ত করেন। তাছাড়াও ঋতুভিত্তিক ঝুমুরের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন ভাদ্র মাসে পয়ার ছন্দে রচিত ভাদরিয়া, আশ্বিন মাসে ডাঁইড় ইত্যাদি। বর্তমানে প্রকৃতির সাথে মননের সেতু বন্ধন গড়ে উঠেছে শ্রদ্ধেয় সুনীল মাহাতো, সলবৎ মাহাতো, কুচিল মুখার্জি, কৃত্তিবাস কর্মকার প্রমুখ কবি শিল্পীদের হাত ধরে। নাগরিক কোলাহল আজও মুগ্ধ হয় দূর থেকে শোনা ধামসা মাদলের তালে সেই সব গানে-
” শাল তলে বেলা ডুবিলো….
দিদি লিলো লো….”
ন.সারি: শ্রমিক ও কর্মজীবীরা কর্ম ছন্দের তালে দলবদ্ধভাবে শ্রম লাভের জন্য এই গান করে থাকেন। নৌকা বাইচে, গাছ কাটা , ফসল তোলা, ছাদ পেটানোর তালে, বিভিন্ন লৌকিক বিষয়কে কেন্দ্র করে কখনো ঢোল, কাঁসি ইত্যাদি সহযোগে চিত্র বিনোদন মূলক এই গান মূলত রাজশাহী, দিনাজপুর ইত্যাদি অঞ্চলে গাওয়া হয়। নৌকার হাল ধরা মাঝে অর্থাৎ ‘বয়াতী’ গানটি শুরু করেন এবং অন্য মাঝিরা তথা ‘দোহার’ একই সুরে গানটি করতে থাকেন। কখনো দেবদেবী, কখনো লৌকিক নায়ক-নায়িকার কাহিনী নিয়ে দ্রুত তালের এই গান গাওয়া হয়।ছাদ পেটানোর সময় ভারী বস্তু তুলতে শায়িব সারি গান এবং বাইচের সারি ফসলের শাড়ি প্রভৃতি গানের সুর ও বৈশিষ্ট্যের থেকে পৃথক হয়। এই গানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় কবি বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’-এ।
প. হাপু: “একই বিলে চরে পাখি, অন্য বিলে না ….”
মিঠুন চৌধুরীর গান মূলত মন্দিরা বা গুপীযন্ত্র হাতে একজন এবং লাঠি হাতে অপরজন মিলে হয়।
ফ. গম্ভীরা:
মালদা জেলায় উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সামিয়ানা টানিয়ে এই গান গাওয়া হয়। পরবর্তীতে গম্ভীরা নামক চারদিনের শিব ঠাকুরের উৎসব তথা ‘ঘরভরা’, ‘ছোট তামাশা’, ‘বড়ো তামাশা’, ‘আহারা’ এর মাধ্যমে মুখোশ ও নাচের সহযোগে গান পরিবেশিত হয়।
ব. আগমনী ও বিজয়া গান: রামপ্রসাদ দাশুরথী প্রমুখ ব্যক্তিদের সহায়তায় আগমনী ও বিজয়া, শাক্তপদাবলী ইত্যাদি গান লোকসংগীত স্থান নিয়েছে। গানের ভাষা কখনো দেবী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে,তাই কখনো ধ্বনিত হয় আকুতি-“আর কবে গিরি আনিবে কুমারী….”
সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের ধামাইল গান আগমনী গানে প্রকাশিত হয়।
৬.কীর্ত্তন:
আদিবাসী লোকসংগীত এর উপর ভিত্তি করে হলেও কীর্তন বর্তমানে কিছুটা পৃথক হয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাংলা ভাষার অভিধান’-এ ইহাকে কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত গান হিসেবে বলা হয়েছে। ‘কীর্ত্তন’ শব্দটি সংস্কৃত ‘কীর্তি’ থেকে এসেছে। ইহা মূলত প্রেম বিষয়ক খন্ড গীতি।
চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রমুখ কবিরা এই গান রচনা করেন।১৫০০ শতকে চৈতন্যদেব এই গানের উন্নয়ন ঘটান এবং তাঁর মৃত্যুর পর লীলা কীর্তন গাদানহাটি,মনোহর্ষী,রেনেটি,মান্দারনি,ঝাড়খন্ডি প্রভৃতি ধারায় বিভক্ত হয়। নরোত্তম দাস, জানান দাস,বিপ্রদাস ঘোষ, মনোহর, মান্দারান সরকারের সহযোগিতায় যথাক্রমে গাদানহাটি,মনোহর্ষি,রেনেটি ও মান্দারনি ধারার প্রচলন করেন। সাধারনত নাম কীর্তন ও লীলা কীর্তনে ইহা বিভক্ত হলেও এর পরিধি ব্যাপক বিস্তার করেছে। কবি নজরুলের কীর্তন গান শান্তির বারিধারায় হৃদয়কে অভিসিঞ্চিত করে –
“সখি সাজায়ে রাখলো বাসর/তেমনি করিয়া….”
৭. গীতিকা:
নাটকীয়তা ও সংলাপধর্মীতায় লৌকিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আখ্যানধর্মী গানকে গীতিকা বলে। বাংলাদেশের গীতিকাকে ‘পূর্ববঙ্গ’ ও ‘নাথ’ গীতিকায় বিভক্ত করা যায়। দীনেশচন্দ্র সেন,ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চলে ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’, ‘চন্দ্রাবতী’ ইত্যাদি গীতিকার প্রচলন করেন। আবার ঐতিহাসিক বিষয়ে অবলম্বনে রচিত হয়েছিল নাথ গীতিকা।
৮.বাউল:
বাংলা লোকসাহিত্যে উনিশ শতকে লালন সাঁইজির হাত ধরে বাউল গানের প্রসার ঘটে। বাউল ওরা মূলত ছিল মানবতাবাদী তাদের এই সাধনার মাধ্যমে সহজিয়া ও সুফির মেলবন্ধন হয়েছে। সুফি সাধনায় পরমারাধ্যদের অবস্থান তার মনের মধ্যেই মনে করা হয়। বাউল গানের প্রবক্তা লালন শাহ,সিরাজ শাহ ইত্যাদি ব্যক্তিরা। খমক, একতারা, ডুগডুগি, দোতারা, সারিন্দা ইত্যাদির মাধ্যমে বাউল গান পরিবেশিত হয়। বাউল সাধনা ছিল পরমারাধ্যার রূপ দর্শনের সাধনা, যা তার মনেই অবস্থিত। তাই বাউলেই প্রকাশিত হয়-
“বাড়ির কাছে আরশী নগর সেথা এক পড়শি বসত করে। আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে….”
বর্তমানে ভিন্ন পদ্ধতিতে লোকসঙ্গীতের আধুনিকীকরণের পাশাপাশি তাকে সঞ্চারিত করার ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। নাগরিক সভ্যতার ব্যস্ততায় তথাকথিত আধুনিক যুগের যান্ত্রিকতায় কখনো লোকসংগীত ম্রিয়মান হয়ে পড়লেও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শিকড় প্রোথিত রয়েছে লোকগানের আবেগমাখা শব্দ বন্ধনে। পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ রোদে, পাখিদের ঘরে ফেরার গানে, মাদলের তালে শব্দ যবনিকার আড়ালে লুকিয়ে থাকে হারানো মাটির টান,মাটির গান।
ঋণ: বাংলার লোক – সাহিত্য – শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।