ক্যাফে গদ্যে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল

২০২০ সালের ওপর অনেকেই বেশ রাগ করেছেন। কোভিড যোগের জন‍্য। অসুখ যে পৃথিবীতে আগে ছিল না, তা তো নয়। এশিয়াটিক কলেরা ছিল। বিউবোনিক প্লেগ ছিল। আর ছিল ম‍্যালেরিয়া। ছিল গুটি বসন্ত। জলাতঙ্ক, নিউমোনিয়া। মানুষ লড়াই করে এগুলিকে বাগে এনেছে। কোভিডের কাছে সে হার মানবে কেন?
পৃথিবী সূর্যকে পাক খায়। সূর্যকে এক চক্কর খেতে তার যে সময়টা লাগে, তাকে এক বছর বলি। আগে তো পৃথিবীটা সবার সামনে দৌড়াত না। গ‍্যাঁট হয়ে বসে থাকত। তাকে ঘিরে ঘুরত চন্দ্র তপন। তাকে দৌড় করালেন গ‍্যালিলিও। করিয়ে নিজে জেলভোগ করলেন। অনেকেই ভেতরে ভেতরে জানতেন পৃথিবী ঘোরে, কিন্তু অমন পেট আলগা কেউ ছিল না। ভাল লোকেরা পেট আলগা হন। আলগা গায়ে ইউরেকা বলে বেরিয়ে পড়েন। বুদ্ধিমান রাজাগজার মর্জি মেজাজ সমঝে কথা বলে। ইনাম জোটে।
তো গ‍্যালিলিও সাহেবের পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ছুটে বেড়িয়ে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের কিছু বেশি সময়ে বছর গড়ে। বারো মাসে বছর গড়ে। বাহান্ন সপ্তাহে বছর গড়ে। যা ব্বাবা, দিন মাস সপ্তাহের সব হিসেব তো এক নয়। মাসে ত্রিশ দিন হলে বারো মাসে যা হয়, সপ্তাহে সাত দিন হলে বাহান্ন সপ্তাহে ঠিক সেটুকু হয় না। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের ওপর আরো ছটা ঘন্টা চাপালে তবে ঠিক হয়? তাহলে চার বছর অন্তর একদিন করে বাড়িয়ে দাও। ওকে বোলো লিপ ইয়ার। বাড়তি দিনটা দিও ফেব্রুয়ারির পকেটে। বেচারা ফেব্রুয়ারি রোমান সম্রাটদের দাপটে ফকির হয়ে গিয়েছে। জুলিয়াস সিজার নিজের জন্মমাস জুলাইকে গৌরব দিতে বানালেন একত্রিশ। ফেব্রুয়ারির ঘর থেকে একটা দিন খামচে বের করে আনলেন। অগাস্টাস সিজার কম যাবেন কেন? তিনিও মহাজন যেনঃ গত .. আগস্ট মাস তাঁর জন্মমাস। তাকে গৌরবান্বিত করতে তাকেও একত্রিশ দিনে করো। কোপ ফেলবেন কার ঘাড়ে? সব ব‍্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব‍্যাটাকে ধর। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আরেকটা দিন খামচে তুলে নিলেন। চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারিকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে একটা দিন দেওয়া হয়।
এত করেও হিসাব মেলে না। তখন আবার একটা কায়দা ভাবো!
পৃথিবী যেমন সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরছে, তেমনি ঘুরছে অন‍্য গ্রহগুলো। শুধুমাত্র গ্রহ? গ্রহাণুরাও ঘুরছে। খান কতক বামনগ্রহ আছেন। তাঁরাও ঘুরছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছে ধূমকেতুর দল। তবে কিনা, গ্রহগুলো উপবৃত্তাকার পথে দৌড়ে বেড়ায়। আর ধূমকেতু দৌড়োয় অন‍্য ছকে।
মঙ্গল গ্রহ সাড়ে চার পার্থিব বছরে, বৃহস্পতি বারো বছরে, শনি ঊনত্রিশ বছরে সূর্যকে পাক খায়। পাক খায় ইউরেনাস আর নেপচুন। প্লুটো, জাত খুইয়ে বামন, সে পাক খায় তিনশো আটাত্তর বছরে। তার অনেক পরে কুইপার বেল্ট। সেখানে ধূমকেতুদের বাসা, তার‌ও ঢের পরে উর্ট ক্লাউড। তার‌ও অনেক পরে হেলিওপজ। এই অ্যাত্ত বড়ো সৌরজগত‌ও পাক খায়। পাক খায় আমাদের মিলকিওয়ে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ গ‍্যালাকসি। পাক খায় প্রতিবেশী অ্যাণ্ড্রোমীডা। পাক খেতেই হবে। পাক খাওয়াই নিয়ম। গ‍্যাঁট হয়ে বসে থাকা নয়।
পৃথিবী সাড়ে তেইশ ডিগ্রি ঝুলে পাক খায়। তার আকাশে চাঁদ একটা। মঙ্গলের ছোট ছোটো দুটো। ডিমোস আর ফোবোস। বৃহস্পতির চারিচন্দ্র খুঁজে বেমক্কা জেলে গেলেন গ‍্যালিলিও। ইওরোপা, ক‍্যালিস্টো, আইও আর গ‍্যানিমিড। এরা গ‍্যালিলিওর চাঁদ। তবে বৃহস্পতি আর শনির চাঁদের সংখ‍্যায় মা ষষ্ঠীর প্রবল কৃপাদৃষ্টি। শুক্রের চাঁদ নেই। তিনি শুয়ে শুয়ে ঘোরেন। আর ঘোরাটা উলটো বাগে। বুধের ঘোরাও অন‍্য ধাঁচের। তিনি সূর্যকে যত দিনে ঘোরেন, তার চেয়ে বেশ বেশি সময় লাগে নিজেকে ঘুরতে। তার মানে ঘোরাটা নিয়ম হলেও সবার ঘোরা সমান নয়।
মাসের নামে অগাধ বৈচিত্র্য। বৈশাখ এল বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকে। জ‍্যৈষ্ঠ এল জ‍্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম থেকে। চিত্রা, কৃত্তিকা, পুষ‍্যা, মঘা নক্ষত্রের নামের সূত্রে এক একটা বাংলা মাস। অগ্রহায়ণ ছিল শুরুর মাস। হায়ণ হল বৎসর, আর অগ্র মানে শুরু। তা গেল বদলে। অগ্রহায়ণের নামটুকু র‌ইল। ফার্স্ট বয়ের গ্ল‍্যামার গেল কাটা। মুসলমানের মাস মহরম, রমজান, শাবান, রবিউল আউয়ল, রবিউস সানি, জমাদিয়ল আউয়ল, জমাদিয়স সানি…আর খ্রীস্টানের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি নামের ছন্দ এক। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর‌ও একটা ছন্দ মেনে।
সাল কথাটা এসেছে শরৎ থেকে। সেকালে শীতকালের প্রাধান্য ছিল। ইরানী থর্দ শব্দ থেকে শরৎ। ওই ছিল শীতের কাল। সর্দি শব্দে শরৎকালের ছাপ আছে। শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র অকালবোধন করে দিলেন। হাইবারনেশন শীতঘুম গেল টুটে।
মাস কথাটার তুল‍্য হল মাহ। এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন‍্য মন্দির মোর। মাহ থেকে মাহিয়ানা বা মাহিনা বা মাইনে। মাসে মাসে পেতে পেতে অভ‍্যাস হয়ে যায়। সপ্তাহ থেকে হপ্তা। হপ্তা পাবার দিনে শুঁড়ি বাড়ি গড়াগড়ি। ইন্দো আর্য রোচস্ থেকে রোজ এসেছে। দৈনিক মজুরিকে রোজ বলে। দৈনন্দিন ডায়েরি লেখাকে রোজনামচা বলে। ডায়েরি কথার মানে দিনলিপি।
নতুন বছরে ডায়েরির সাথে ক‍্যালেণ্ডার পেতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু ক‍্যালেণ্ডার মান্থ মানে তিরিশ দিনের মাস।
বর্ষ মানে দেশ। বর্ষং তদ্ ভারত নাম… আবার বর্ষ মানে বছর। বর্ষে বর্ষে দলে দলে। বর্ষ থেকে বার্ষিকী। অ্যানিভারসারি। কেউ বলত ইয়ার্লি পরীক্ষা, কেউ বলত অ্যানুয়াল।
অব্দ নামে শব্দ ছিল। শত অব্দের সমাহার ছিল শতাব্দী। খ্রীস্টাব্দের মতো শকাব্দ, বঙ্গাব্দ, বিক্রমাব্দ, এমনকি চৈতন‍্যাব্দ।
বিসি ছিল। ওর মানে বিফোর ক্রাইস্ট। আর ছিল এডি। আন্নো দোমিনি। খ্রীস্টের জন্মের পরে। খ্রীস্ট জন্মালেন কবে? তিন বিসি তে? তারিখ কবে? পঁচিশ ডিসেম্বরে না সাত জানুয়ারিতে?
কে জানে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, পুরাতন বৎসরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি, কেটে গেল ওরে যাত্রী।
শুভমস্তু।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।