গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

জামাই ষষ্ঠী

বগার এই প্রথম জামাই ষষ্ঠী। শ্বশুরমশাই নিজে এসে বগার মা’র কাছে নেমন্তন্ন করে গেছেন। অষ্টমঙ্গলায় যা কেলোর কীর্তি ঘটিয়েছিল,তাই বগা এবার ঠিক করেছে আর কোনো ঝামেলায় যাবে না। সিদে শ্বশুরবাড়ি যাবে আর ফিরে আসবে।
বগা ইচ্ছে করেই আজ সন্ধ্যায় চায়ের ঠেকে যায়নি।জামাইষষ্টি নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করবে,তাই ফিরে এসে দেখা করবে। বগার বন্ধুরাও কম যায় না। সন্ধ্যা গাঢ় হতেই সবাই বগার বাড়র সামনে এসে হাজির। পটলা শুরু করলো,“ বগা,এই বগা! কই গেলি রে ভাই? বগা,ও আমাদের বগুগুগু–।” এরপর ফন্টে ডাক শুরু করলো,“ এই বগা,বগা। তুই কি এখনি রেডি হয়ে গেলি? জামাইষষ্ঠী তো কাল। আজ একটু চল,যাই ঠেকে।” বেগতিক দেখে বগা বিচুটিকে ডেকে বলল,“ তুমি যাও,গিয়ে ওদের বলো আমার শরীরটা ভাল নেই। আমাশা হয়েছে। অবস্থা ভালো না।” বিচুটি বেরিয়ে এসে বলল,“ ও পটল ঠাকুরপো,বগার শরীরটা ভালো নেই।” সঙ্গে সঙ্গে ফন্টে,“কেন,কি হয়েছে বৌদি? আমাদের জানাবেন তো। জনগণের সেবায় আমরা সব সময় আছি বৌদি। আর বগা তো আমাদের ঘরের ছেলে।” বিচুটি ঠোঁটের কোনে হাসি চেপে রেখে বলল,“ তা কী আর জানিনে ঠাকুরপো! তোমরা আছো বলেই তো আমি নিশ্চিন্তে থাকি। তবে এবারে তেমন কিছু নয়,ঐ একটু আমাশা হয়েছে। বারেবারে যাচ্ছে আর আসছে।” পটল,“ এই রে! কাল তো জামাইষষ্ঠী,তাহলে কি হবে?” “ কি আর হবে ঠাকুরপো? তেমন হলে আর যাওয়া হবে না। আমার কপাল মন্দ,বুঝলে?” “ না না বৌদি, কোন রকম সমস্যা হলে আমাদের জানাবেন। এই তো পাড়ার মোড়ে আমরা থাকি। একটা হাঁক দিলেই আমরা সবাই চলে আসব।” “ আচ্ছা”,বলেই বিচুটি দরজা বন্ধ করে দিল। বগা বিছানা ছেড়ে বিচুটিকে জরিয়ে ধরল। আদর করে বলল,“ সোনা আমার। আজ তোমার জন্যই ওদের হাত থেকে রেহাই পেলাম। ”

এবারে বগা আগে থেকেই একটা গাড়ি ভাড়া করে রেখেছে শ্বশুর বাড়ি যাবে বলে। সকাল- সকাল বিচুটি আর বগা রেডি। গাড়ি এসে হর্ন দিতেই। দুজনে বেড়িয়ে পড়ল। বগার মা, “দুগ্গা দুগ্গা বলে” দরজা বন্ধ করলেন।
বিচুটির আজ বেশ ভালো লাগছে। অনেকদিন পর বাপের বাড়ি যাচ্ছে রাস্তায় কত লোকজন! সব সাজুগুজু করে মিষ্টি,আম,লিচু নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। বিচুটির ভায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। কতদিন হয়ে গেল ওর সাথে দেখা হয়নি। মা-বাবা,বন্ধুরা,সবার সাথে আজ দেখা হবে। বগার ডাকে বিচুটি ফিরে তাকালো। “ এই শোনো না,তোমাদের ইটালিতে তো এসেই গেছি কিন্তু এই তিন মাথার মোড়ে এসে সব গুলিয়ে যায়। বলোনা কোন দিকে যেতে হবে?” বিচুটি ইশারায় ডানদিক দেখিয়ে দিল। গাড়ি একটা সরু মাটির রাস্তার সামনে এসে থেমে গেল। আর গাড়ি যাবে না। দু’দিকে পুকুর। গাড়ি ঘোরানোর জায়গায় নেই। এখন ১১ নম্বরেই যেতে হবে।

বগা আগে থেকেই ঠিক করেছে এবার আর বাড়ির বাইরে কোথাও যাবে না। চুপচাপ শ্বশুরবাড়ি ঢুকতে যাবে এমন সময় মাইকের আওয়াজ কানে এলো — আজ রাত ১২ ঘটিকায় শুরু হবে যাত্রাপালা-কলঙ্কিনী রাধা। রাধার ভূমিকায় রাত্রি দাশগুপ্ত।
বগা হোঁচট খেয়ে এক্কেবারে শাশুড়ি মায়ের পায়ের সামনে পরল। এক্কেবারে শস্টাঙ্গে প্রণাম ।শাশুড়ি,জামাইয়ের এমন ভক্তি দেখে গদগদ। দুই হাত দিয়ে জামাইকে টেনে তুললেন। বললেন,“ থাক বাবা থাক। দীর্ঘায়ু হও। আমার বিচুটিকে ভালো রেখো।” বগার কান তো যাত্রাপালার প্রচারের দিকে। এতক্ষণের প্রতিজ্ঞা পুরো ভুলে মেরে দিয়েছে।
পালাটা কোথায় হচ্ছে সেটা ঠিক শুনতে পাইনি তাই মনটা কেমন ডানা ঝাপটাছে।দইয়ের ফোঁটা ফলার সবই চলছে বগা ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। দুপুরে শ্বাশুড়ি মা তালপাতার পাখার বাতাস করছেন আর বগা ঝাল ঝাল পাঁঠার মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছে। শেষে আম,কাঁঠালের পায়েস,বগার তো অবস্থা শোচনীয়। খাবার ছাড়তে পারছে না আবার উঠতেও পারছে না। শেষের দিকে বিচুটি এসে হাল ধরে।
সন্ধ্যায় বিচুটি পাড়া বেড়াতে বেরোলেই বগাও ফুলবাবু হয়ে বেরিয়ে পড়ল। পাশেই শীতলা মন্দিরের চাতালে একদল ছেলেছোকরা আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ সেখান থেকে আওয়াজ এলো- “ ও জামাই,কি খবর? পা কেমন আছে? আজ থাকা হচ্ছে তো?”
বগা পিছন ফিরে দেখে বিচুটির কাকার ছেলে। বগা হেসে বলল,“ সব ঠিকঠাক আছে শালাবাবু। তোমার খবর কি?” “ আর কি বলব জামাই! জল ছাড়া মাছের মতন। দুজনেই হেসে ওঠে। আজ রাতে রেডি থেকো। বল খেলার মাঠে যাত্রাপালা দেখতে যাব। যাবে তো?”
“ সে আর বলতে। বিচুটিকে কিছু বলার দরকার নেই। সবাই ঘুমোলে আমরা রাতে দু’জন বেরিয়ে পড়বো। মেয়েরা পিছু ধরলেই মুশকিল। এবার একাই যাবো।”
গ্রামে রাত্রি এগারোটা মানে মধ্যরাত্রি। বগা চুপচাপ রান্না ঘরের পাশ দিয়ে পিছন দিক দিয়ে বের হতে গেল। ব্যাস,জড়ো করা জ্বালানির উপর পড়ল। শুকনো পাতা কাঠ সব মিলিয়ে একটা বিচ্ছিরি আওয়াজ হলো। কোনোক্রমে উঠেই শুনতে পেল শাশুড়ির গলা— “ পোড়ারমুখু,হুলোটার কীর্তি দেখছো! সারাদিন ছোঁকছোঁক করছে রাতেও একটু শান্তি নেইগা। কাল উঠি তোর ব্যবস্থা করব।” বগা সময় নষ্ট না করে দৌড় লাগালো শীতলা মন্দিরের দিকে।
“ আরে জামাই অমন দৌড়াচ্ছ কেন?” “ শালাবাবু,সাধে কী দৌড়াচ্ছি। ধরা পরতে পরতে বেঁচেছি। তাড়াতাড়ি চলো,প্রথম থেকে না দেখলে ঠিক জমবে না।” “ দাঁড়াও,
পাটকাঠি জ্বালিয়ে নিই। নিশুতি রাত,বলখেলার মাঠ অব্দি যেতে একটা বাঁশ বাগান আরেকটা সাঁকো পার হতে হবে। ওই বাঁশবাগানে শাকচুন্নি,পেত্নী সব আছে। আমাদের কিছু করে না। তবে হ্যাঁ নতুন লোক দেখলে একটু—” বগার তো সব শুকিয়ে যাচ্ছে। “ নতুন লোক দেখলে কি করে?” “ বেশি কিছু না,বাঁশ ফেলে রাখে আর তুমি যেই ওই বাঁশ পেরোতে যাবে,তুমি শূণ্যে। খবরদার! মাটিতে পড়ে থাকা বাঁশ কিন্তু পেরোবে না।” বগা তো চমকে চামচিকির মত অবস্থা। পাট কাঠি জ্বালিয়ে ধান কাটা মাটির উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। বাঁশবন,সাঁকো পেরিয়ে পৌঁছালো যাত্রার মাঠে।
সেখানে পৌঁছে কে বলবে এখন রাত্রি বারোটা। বিশাল প্যান্ডেল, প্রচুর ভিড়। মাটিতে খড় পেতে যে যার মত বসে পড়েছে। যাত্রা শুরু হবে। মিউজিক বেজে উঠছে। লাইন দিয়ে ঢুকতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। তাই ফাঁকফোকর খুঁজতে গিয়ে দেখে এক দাদু ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকছে। বগা আর দেরী করলো না। দাদুর পিছনে হামাগুড়ি দিল। লাইন থেকে লোকজন হৈ হৈ করে উঠল। দাদু আর বগা কোনরকমে ফুটবলের মতো গড়িয়ে ভিতরে ঢুকে বসে পড়ল। কিন্তু শালাবাবু ঢুকতে পারল না। তার আগেই লাইন থেকে লোক তেড়ে এসেছে। বগা তো যাত্রা দেখার নেশায় কোনরকমে দাদুর পাশে ঠেসে মাটিতে বসলো। পালা যখন বেশ জমে উঠেছে,কৃষ্ণ গোপিনীদের পোশাক নিয়ে মগডালে আর সখীরা জলকেলিতে মত্ত ঠিক তখনই বগা অনুভব করল দেখল- এমা প্যান্ট তো পুরো ভিজে গেছে। দাদুর দিকে তাকাতেই দাদু বলল,“ কি করবো নাতি,এখন যদি বাইরে যায় আর ঢুকতে পারবো না। কলঙ্কিনী রাধা আর দেখা হবে না। তাই এখানেই করে ফেলেছি।” “ দাদু,আমি শ্বশুর বাড়িতে এসেছি। এখন ফিরব কি করে? বিচুটি তো বিষ ঝেড়ে দেবে। দাদু,আমি কি করবো?”
“ তোমার ঠাকুমাও একই কাজ করবে। তুমি অনেকদিন বাঁচবে নাতি। আমার তো সময় হয়ে এসেছে। পরেরবার পালাটা দেখো। চুপ করে বসো না হয় বাড়ি যাও। কারণ আমার ধুতি তো ভেজেনি।” বগা লাফ দিয়ে উঠলো। পিছন থেকে এমন চিৎকার উঠলো যে আবার হামাগুড়ি দিয়ে সেই ত্রিপলের ফোঁকর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
গা ঘিনঘিন করছে। কি করবে? বাইরে এসে মনে হল,বেরিয়ে তো পড়ল কিন্তু এখন শালাবাবু কে পাবে কোথায়? রাস্তা তো চেনে না। বাড়ি ফিরবে কি করে? পেছন থেকে শালা কে খোঁজাও সম্ভব নয়। অগত্যা মাঠ ধরে হাঁটতে শুরু করল। দক্ষিণ কলকাতার ছেলে অত ভূতটুতে ভয় করলে চলে,এই ভেবে এগোতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর সেই সাঁকোটা পেয়ে গেল। এবার নিশ্চিন্তে বাঁশবন পার হলেই হয়ে যাবে।
সাঁকোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাঁশবনের দিকে তাকাতেই দেখল সাদা কাপড় পরা একটা ছায়ামূর্তি বাঁশ বাগান থেকে বেরিয়ে সাঁকোর দিকে এগিয়ে আসছে। বগা বাবাগো মাগো বলেই একেবারে খালের ঘোলাজলে।
বগার যখন জ্ঞান ফিরল দেখল খাটে শুয়ে আছে। বিচুটি পাখার বাতাস করছে। চোখ খুলতেই বিছুটি চেঁচিয়ে উঠল,“ বাবা তোমার জামাই তাকিয়েছে!”বগা ক্ষীণকণ্ঠে বলে উঠলো,“ আমি কোথায়? ” শ্বশুরমশাই ঘরে ঢুকেই বললেন,“ আমিতো তোমাকে খুঁজতে গেছিলাম আর তুমি আমাকে দেখে বাবা গো মা গো বলে খালে ঝাপ দিলে।” “ কই না তো! পা টা একটু পিছলে গেছিলো?
বিচুটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।