“বিভূতির পথে অপুর সাথে” পথের গল্প না পাঁচালী -তে শাশ্বতী ভট্টাচার্য

আলোর আড়ালে 

সালটা ২০০৩। তখন কলেজ পাশ করে সবে ইউনিভার্সিটি, ১ম বর্ষ। কলেজে পড়া কালীন আমার সব বন্ধুদের বাড়িতে তখন যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ল্যান্ডলাইন। তাও তার খরচ ও সময়সীমা নির্দিষ্ট। হ্যাঁ, পাড়ার এক কাকুর হাতে একটা মোবাইল ফোন দেখতাম বটে, কালো, বেশ বড়োসড়ো, চওড়া, মাথায় আবার একটা শিং মানে অ্যান্টেনা, ছুঁড়ে মারলে মাথা ফাটার সম্ভাবনা ছিল প্রবল আর সেই ভয়ে আমরা কেউ সেই কাকুর কাছে ঘেঁষতাম না। কাকুটি রোজ নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে মোবাইলে কথা বলতে বলতে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে যেতেন। পরে কলেজে ভর্তি হয়ে এক স্যারের হাতে একইরকম মোবাইল দেখে জেনেছিলাম মটোরোলা কোম্পানির নামটা।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার বেশ কয়েকদিন পর এক বন্ধুর হাতে মোবাইল দেখে সে কী উত্তেজনা আমাদের । Nokia 3310 নামক অতিসাধারণ একটা মোবাইলের জন্য বন্ধুর আনন্দে আত্মহারা বাকিরা। টিফিন ব্রেকে আমরা কয়েকজন একপ্রকার মোবাইলটা ছুঁয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। সেই প্রথম মোবাইল ছুঁয়ে দেখা। তারপর ধীরে ধীরে বেশ কয়েকজন বন্ধুর হাতে মোবাইল দেখা গেল। বন্ধুদের আলোচ্য বিষয় ধীরে ধীরে অর্থনীতি, বয়ফ্রেন্ড, প্রথম প্রেম, টিচার্সদের ছেড়ে মোবাইলে গিয়ে ঢুকতে শুরু করলো। কম্পিটিশনটাও শুরু হল মোবাইলের নতুন নতুন ফিচার্স নিয়ে। কার মোবাইলে কটা বেশি ফিচার্স আছে সেটা বইয়ের সিলেবাসের থেকে বেশি জরুরী হতে শুরু করলো। এটাই বোধহয় ছিল পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। তারপর শুরু হল চাকরীজীবন। প্রথম মাসের মাইনের একাংশ দিয়ে নিজের জন্য কমদামী একটা অতি সাধারণ মোবাইল কিনেছিলাম, উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখা। অথচ দেখতাম এই মোবাইলের চক্করে পড়ে বাসে, ট্রেনে মানুষের সাথে মানুষের আলাপচারিতাই সবার আগে কমতে লাগলো, মোবাইলে হেডফোন লাগিয়ে কানে গুঁজে গান শোনার ফ্যাশন বাড়তে থাকলো। ভালো, গান শোনা ভালো অভ্যাস। এরপর এলো মোবাইল ক্যামেরার দিন। সাথে বেশ কয়েকটা নতুন মোবাইল কোম্পানি । অর্থনীতির ছাত্রী হিসেবে বেশ বুঝতে লাগলাম যে পিওর মোনোপলি বলে কিছু হয় না। ফাইনালি মোনোপলিস্টিক কম্পিটিশন এর উদাহরণ চোখের সামনে দেখতে লাগলাম। নতুন নতুন ব্র্যান্ড, নতুন নতুন ফিচার্স, টিভিতে নতুন মোবাইলের চকচকে বিজ্ঞাপন, সুন্দর ছোট বড় দাম। হযবরল এর মতো কোনো মোবাইল সাদা কালো জামা ছেড়ে রঙিন জামা পরছে, কেউ গান শোনাচ্ছে তো কেউ রেডিও, কেউ ছোট তো কেউ বড়। কারুর ক্যামেরা আছে তো কারুর গেমস, কারুর ইনফ্রারেড তো করুর ব্লুটুথ, কারুর ভিডিও ক্যাম তো কারুর মেমরি কার্ড। একটার পর একটা প্রলোভন, আর মোবাইল বাজারে মুনাফার গ্রাফের উর্দ্ধগামী ভবিষ্যৎ। এভাবেই মানুষ ব্যস্ত হতে থাকে একটা ছোট্ট স্ক্রিনে আর কয়েকটা বোতামে। নোকিয়া, স্যামসাং, সোনি এরিকসন, মাইক্রোম্যাক্স থেকে শুরু করে নতুন নতুন সব নাম, নতুন নতুন তাদের ফ্যাশন। কখনো স্লিম, কখনো ফ্লিপ, কখনো আবার স্লাইডিং। মানুষ সাহিত্য, সংস্কৃতিতে অভিনবত্ব ছেড়ে মোবাইলে অভিনবত্ব খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে মোবাইল ধনীর বিলাসিতা থেকে একটা নেশায় পরিনত হতে শুরু হল। আমরা চিঠি লেখা ছাড়লাম, পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড ভুলে যেতে শুরু করলাম। দশটা নম্বর ডায়াল করলেই দূরের কন্ঠ কাছের হতে লাগলো। এমনকি উন্নতির সাথে সাথে ইন্টারনেট এবং ভিডিও কলিং এর জানলা খুলে গেলে সারা পৃথিবী এসে গেল হাতের মুঠোয় । দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট ডিভাইসে ঢুকে গেল পিসিও বুথ, ল্যান্ডলাইন, টেলিগ্রাম, পোস্টকার্ড, রেডিও, মিউজিক সিস্টেম,  ভিসিডি প্লেয়ার, ক্যামেরা, ভিডিও ক্যাম, খেলার মাঠ, কম্পিউটার, ভিডিও কলিং, বাজার, শপিংমল, টেলিভিশন, সিনেমা হল, এমার্জেন্সি, আলাপচারিতা, বন্ধুত্ব, পড়াশুনো, ক্লাসরুম , রান্নাঘর, অবসর সব। মোবাইল হয়ে উঠলো নেসেসিটি, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। আমরা কখন, কিভাবে যে বদলে যেতে শুরু করলাম বুঝতেই পারলাম না। চাহিদার রেখচিত্র অস্থিতিস্থাপক হতে শুরু করলো।
এখন ২০২০। আমরা অনেক অনেক উন্নত। সভ্যতার অনেক সিড়ি পেরিয়ে এসে আমরা যতটা আধুনিক, ততটাই ব্যস্ত নাগরিক। আমাদের পরিবারের জন্য সময় নেই, মা বাবার সাথে সময় কাটানোর সময় নেই, সন্তানের সাথে খেলার সময় নেই, শিশুরা আজকাল খেলার মাঠের থেকে গেমস পার্লারে অনেক বেশি সাবলীল এবং খুশি। ফেলুদা, শার্লক হোমস, শুকতারা,চাঁদমামা, আনন্দমেলা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। শক্তিমান, হিম্যান, জনি সোকো অ্যান্ড হিস ফ্লাইং রোবট এর পরিবর্তে এসে গেছে ডোরেমন, সিঞ্চন, অগি আরো কত কি। টিভির অনুষ্ঠানরা গিয়ে ঢুকেছে মোবাইলে ইউ টিউব, হটস্টার বা জিফাইতে। মানুষ মানুষের সাথে কথা বলতে ভুলে গেছে, বন্ধুরা এক জায়গায় বসে সটান আড্ডা দিতে ভুলে গেছে। মা বাবা সন্তানদের সাথে খেলতে ভুলে গেছে। সন্তান মা বাবাকে নিয়ে আনন্দ করতে ভুলে গেছে। প্রেমিক প্রেমিকা পার্কে বসে ভালোবাসার কথা বলে না বরং কে কোন ব্র্যান্ডের কত দামী মোবাইল ব্যবহার করে এবং কার সেলফি ক্যামেরা কত মেগপিক্সেল, তার উপর নির্ভর করে দুজন দুজনকে কত মেগাপিক্সেল প্রেম দেবে। সেলফিতে চুমু খাওয়ার ফটোটা শুধু তুললে হবে, সেটাকে প্রচারে এনে সবাইকে দেখাতে হবে তো । আর প্রেমিক প্রেমিকাকে নিয়ে কত দামী রেস্তোরায় ট্রিট দিচ্ছে সেটাও তো সবাইকে জানান দিতে হবে আর তারজন্যই তো রয়েছে সোশাল মিডিয়া। হ্যাঁ অরকুট ছেড়ে আমরা এখন হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্তাগ্রামে সারাদিন বন্ধুত্ব বানিয়ে চলি। চেনা বন্ধুর থেকে ফেসবুকে অচেনা বন্ধুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। সাথে আমাদের প্রতিবাদী সত্তা, ভেতরের পন্ডিতি, পড়াশুনো, প্রতিভা সব সব সব খুঁজে পাই এই মুখবইতে। এই বইটির অভিধানে লজ্জা, সম্ভ্রম, সংযম, সচেতনতা প্রভৃতি শব্দগুলো প্রায় ব্রাত্য। এখানে প্রায় সবাই একে অপরের বিরোধীপক্ষ, যে কোনো বিষয়ের বিরোধিতা করাটাই এখানে প্রতিবাদ। আর এই সোশাল মিডিয়ার যুগে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হল সেলফি / গ্রুফি তুলে পোস্ট করা। শুধু ফটো তোলাই নয় তাকে এডিট করার উন্নত প্রক্রিয়ায় কালো হয়ে ওঠে সাদা, মোটা হয়ে যায় রোগা বা উল্টোটা। বয়স কমে যায় অন্তত দশ বছর। এভাবে একটা কৃত্রিম পরিকাঠামো গড়ে তুলছি আমরা। প্রযুক্তিগত উন্নতির আলোর পিছনে জমাটবদ্ধ অন্ধকারটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এই প্রযুক্তির বোতাম টিপে আমরা হয়তো এক দশকে ত্রিশ চল্লিশ বছর এগিয়ে গেছি। সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় ভরে ফুটবলের মতো খেলে চলেছি। এমনকি সঠিকভাবে ব্যবহার করে জ্ঞানের বিপুল অধিকারী হতে পেরেছি কেউ কেউ। কারুর ছাইচাপা প্রতিভা প্রকাশ পেয়েছে মোবাইলকে কেন্দ্র করে, কারুর জীবিকা গড়ে উঠেছে সোশাল মিডিয়ায় । কিন্তু আমাদের মানসিক শিক্ষার মণিকোঠা যে অনেকটাই খালি হয়ে গেছে সেটা এই উন্নতির আলোয় লক্ষই করিনি। আমরা কতটা হারিয়েছি সেটা একবারও ভেবে দেখিনি। আমরা সংযম হারিয়েছি, ধৈর্য হারিয়েছি। হারিয়েছি আমাদের লজ্জা, বিনয়, শ্রদ্ধা । দেখনদারি সর্বস্ব আমরা হারিয়েছি আমাদের মূল্যবান সময়, খেলার মাঠ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার চোখ আর মন। হারিয়ে ফেলেছি আত্মীয় পরিজনের সঙ্গ, নির্মল বন্ধুত্ব। আরো হারিয়েছি শারীরিক সুস্থতা। মানসিক দৈন্য একটু একটু করে আমাদের ঘিরে ধরছে, আমরা বুঝতে পারছি না। এরপর এভাবেই ধীরে ধীরে আমরা একটা অবসাদের পৃথিবীতে ডুবে যাব। আত্মপ্রচারসর্বস্ব হামবড়াই একদিন মানসিক ক্লেদ আর আত্মগ্লানির অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকবে। তখন হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের তুলে আনার জন্য কি এগিয়ে আসবে আমাদের সেলফি আর গ্রুফির দল? টুইটারে কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমাদের বলবে কি – “আমি আছি, হাত বাড়াও”… সেদিন কোনো ফেসবুকীয় প্রতিবাদী বন্ধু প্রতিবাদের ঝড় তুলবে কি এই ভয়ানক প্রগতিশীল প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে? প্রশ্ন থাক আমার, উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ …
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।