সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে নীলম সামন্ত (পর্ব – ২)

মহাভারতের মহা-নির্মাণ ( সত্যবতী)

ভাগ্যিস সত্যবতী সংস্কারি নয়। নইলে এতবড় মহাভারত শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে যেত হয়তো।

বালাইষাট এমন আলটপকা কথা ভাবতেও নেই। মহাভারত যে পৃথিবী বিখ্যাত সে কথা ভুললে চলবে কি করে? মহাভারত- ভরত বংশের গল্পকথায় ভরা৷ কে ছিল এই ভরত? সকলেরই জানা তাও বলি ৷ রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র ভরত৷ এই ভরত-বংশের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হলেন সত্যবতী৷ শকুন্তলার বেশ কয়েক প্রজন্ম পর পুনরায় এই রমনী বিবাহিত সম্পর্কের হাত ধরে রাজসিংহাসনে আসীন হন৷ কথায় আছে না জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে। অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে এই সম্পর্কে আমরা আগে থেকে কিছুই জেনে যাই না। সবই সৃষ্টিকর্তার নিজের নিয়মে চলে। সত্যবতীকেই যদি উদাহরণ হিসেবে ধরি তাহলে দেখা যায় তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিবাহ এবং মৃত্যু যেন বিধাতার নিয়মেই নিজের মতো এগিয়ে গেছে।

প্রথমে তার জন্মটাই বলি, চেদীরাজ উপরিচর বসু মৃগয়াকালে তাঁর স্ত্রী গিরিকাকে স্মরণ করে কামবিষ্ট হন। তার স্খলিত শুক্র এক শ্যেনকে দিয়ে রাজমহিষীর কাছে পাঠান। কিন্তু রাস্তায় অন্য এক শ্যেনের আক্রমণে এই শুক্র যমুনার জলে পড়ে যায় এবং ব্রহ্মশাপে মৎসীরূপিণী অদ্রিকা এই জল পানের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তারপর দশ মাসে এক ধীবরের জালে আটক পড়ে সেই মৎসরূপিণী অদ্রিকা। ধীবর এই মৎসীর উদরে একটি পুরুষ ও একটি কন্যাশিশু পায়। ধীবরও শাপমুক্ত হয়। এই পুত্র-কন্যার নাম হয় যথাক্রমে মৎস্য ও সত্যবতী। কিন্তু মৎসীরূপিণীর গর্ভে বেড়ে ওঠার কারণে এই কন্যার গায়ে মাছের ভীষণ গন্ধ ছিল তাই নামকরণ করা হয় মৎস্যগন্ধা।

ভেবে দেখুন চেদীরাজের সন্তান কোথায় রাজ প্রাসাদে বেড়ে ওঠার কথা, বেড়ে উঠল সাধারণ জেলে ধীবরের ঘরে। পরিচয় হল জেলেনি। এই মাছের গন্ধের কারণে ধীবর তাকে অন্য কাজে লাগাতে পারেনি বলেই পারানির কাজে নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন।

কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন সত্যবতী চরিত্রের ওপর যে বিরাট আলো ফেলেছেন তা বলা যায় না৷ তবে ওই স্বল্পেই বোঝা যায় তাঁর সাহস ও দৃঢ়তার কথা। একটি শিশু জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোনটাই নিজের দায়িত্বে ঘটায় না তবে তার কর্মের দায় তারই থাকে। তৎকালীন সমাজে একটি মেয়ে পারানীর কাজ করছে এটি কি কম সাহসের কথা? যেখানে মেয়েরা সব দিনই গৃহস্থালির কাজের মধ্যে নিজেদের জীবন কাটিয়ে দেয়। ঝড় জল বিপদ আপদ মাথায় করে সে নদীর বুকে নৌকা বায়। আচ্ছা নৌকা বাইতে কি শক্তি কম লাগে? তবে সত্যবতী শক্তিশালীও ছিলেন। তাই না? পাঁচ হাজার বছর পরেও আমরা দেখি মহিলা বিমান চালিকা কিংবা নাবিক কিংবা বাস, অটো চালিকা। মেয়েরা তবে যুগে যুগেই সব পারির দুনিয়ায় বাস করে। শুধু সমাজ সংসার তাদের নানাবিধ নিয়মের বেড়াজালে তাদের আটকে রেখে অপারগ করে ফেলেছে।

সাহসী হবার পাশাপাশি সত্যবতী চরিত্রটি যে কতখানি বুদ্ধিমতী তা নানান ভাবে তুলে ধরেছেন কবি। সত্যবতীর পারানী জীবনে একদিন পর্যটনরত পরাশর মুনি তার নৌকায় ওঠেন। সত্যবতীকে দেখে তিনি কামাসক্ত হন এবং মিলনের প্রস্তাব দেন। সত্যবতী তখন অবিবাহিতা, বাবা কি বলবে, সমাজ সংসার সবকিছুর দিকে তাকিয়ে ফিরিয়ে দেন। চক্ষুলজ্জার ভয় কারই বা না থাকে যেখানে একজন মেয়ে বড় হয়েছে পালিতা বাবার আশ্রয়ে সেখানে তার তো বেশিমাত্রায় থাকাটাই স্বাভাবিক। পরাশরমুনি থেমে যান নি। সত্যবতীকে ভোগ করার লোভ থেকে পিছিয়ে না আসার উদ্দেশ্যে টোপ ফেললেন৷ বললেন ভয় না পেতে। এই মিলনের ফলে তিনি পুত্রসন্তান লাভ করলেও তার কুমারীত্ব নষ্ট হবে না। এতেও সত্যবতী রাজি হতে পারেনি। পরাশরমুনিকে অনুরোধ করলেন তার গায়ের গন্ধ যেন দূর হয়ে যায়৷ পরাশরমুনি কস্তুরি সুগন্ধ দান করলেন৷ প্রকাশ্য মিলন সত্যবতীকে অস্বস্তি এনে দিলে যমুনার ওপর কুয়াসা সৃষ্টি করে আভরণ তৈরি করলেন। এরপর সত্যবতী সম্পূর্ণ সম্মতি প্রদান করলে, পরাশর তাঁর সাথে মিলিত হন। পরবর্তীকালে সত্যবতীর সুগন্ধী গাত্রঘ্রাণ প্রাপ্তির কারণে ইনি গন্ধবতী নামে খ্যাত হন। আবার এক যোজন দূর থেকে এঁর গায়ের গন্ধ পাওয়া যেতো বলে, এর অপর নাম ছিল যোজনগন্ধা। এই মিলন হেতু জন্ম নেয় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন। পরবর্তীতে ব্যাসদেব নামে খ্যাত হন।

এই অংশটি বিচার করলে দেখা যায় সত্যবতী নারী চরিত্রটি যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন। অবিবাহিত অবস্থায় তাঁর কামোত্তেজনা বা মিলনের ইচ্ছে দমন করে মিলিত হতে চাননি এমন নয়৷ তার পালক বাবাকে ও সমাজকে ভয় পেতেন। সেই ভয় যখন দূর হল তখন তিনি সুযোগের সৎ ব্যবহার করে নিজের গায়ের গন্ধও দূর করে দিলেন৷ একে বলে ‘মওকে পে ছক্কা’। নিজের কাম তুষ্টও করা গেল আবার বাড়তি পাওনাও জুটল। সত্যবতীর জন্ম অলৌকিক হলেও বেড়ে ওঠার পর কাজকর্ম কোন কিছুই কতখানি অলৌকিক মনে হয় না। অলৌকিক বলছি তার কারণ শুক্র খেয়ে কোনদিন কেউ গর্ভবতী হয়নি চিকিৎসাশাস্ত্র এই ঘটনাকে সমর্থন করে না। পরাশরমুনির সাথে মিলনের পর কুমারীত্ব অটুট থাকার ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে অলৌকিক মনে হলেও তা অলৌকিক নয় কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে সতীচ্ছেদ ঘটার পর প্রায় ছ’আট মাস শারীরিক মিলন না ঘটলে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে যায় অর্থাৎ নতুন হাইমেন সৃষ্টি হয়। গায়ের গন্ধ দূর করাটাও একটা থেরাপি।

সত্যবতীকে কেন্দ্র করে পরবর্তী ঘটনাগুলি নানান ভাবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা প্রমাণ করে। ভাগ্য তাঁকে জেলের বাড়িতে বড় করলেও একেবারে পথে বসিয়ে দেয়নি। পারানির জীবন পার করে তিনি সম্রাজ্ঞী হয়েছিলেন। হস্তিনাপুর রাজা শান্তনুর দ্বিতীয় স্ত্রী। সে ঘটনাও বেশ অভিনব।

যোজনগন্ধা হওয়ার পর সত্যবতীর গায়ের গন্ধ দূর দূর থেকে পাওয়া যেত। একদিন রাজা শান্তনু সেই গন্ধ অনুসরণ করে পৌঁছে গিয়েছিলেন সত্যবতীর বাসস্থানে এবং দেরি না করে সরাসরি বিবাহ প্রস্তাব দেন। ধীবরপল্লী কখনই রাজাদের ভ্রমনস্থান নয়। শান্তনুর গঙ্গাদেবীকে হারিয়ে সর্বহারার মতো বনে বনে ঘুরে বেড়ানোর পর এই ঘটনা পাঠকবর্গকে আশ্চর্য করে তোলে। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন পরম প্রাজ্ঞ, পরম ধার্মিক, পরম ধীমান, দেবর্ষি ও রাজর্ষিদের সম্মানভাজন; যাঁর ধার্মিকতা দেখে অন্যান্য নৃপতিরা তাঁকে সম্রাটপদে অভিষিক্ত করেছিলেন, সারা পৃথিবীর অধিপতি হবার যোগ্যতা যেই রাজার সেই রাজা কস্তুরি গন্ধের টানে ধীবরপল্লীতে! এ যেন অভাবনীয়। অসম্ভব আশ্চর্য। কেন জানেন? ধীবর মানেই নিষাদ অর্থাৎ অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য। এই নীচুজাতির প্রতি তৎকালীন রাজাদের কি নজর ছিল তা শাস্ত্রে, মহাপুরাণে, মহাকাব্যে কোথাও আবছা নয়। তাই বিস্ময় বহুগুণ বেড়ে যায়। তবে কি শুধু মাত্র সুগন্ধ তাকে টেনে নিয়ে গেল!

সত্যবতীর পালক পিতা যে তাঁর প্রতি যত্নশীল ছিল সেই দিকটাও এখানেই স্পষ্ট হয়৷ হস্তিনাপুর অধিপতি পাটনী কন্যার হাত চাইছে এ ঘটনা ধীবরপল্লীতে চাঁদ ধরার মতো। এমন সৌভাগ্য আর কিই বা হতে পারত? তবে উনি স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। বুদ্ধি করে রাজা শান্তনুর কাছে শর্ত রেখেছিলেন সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তানই হবে সিংহাসনের পরবর্তী দাবীদার৷ শর্তে রাজি না হওয়াতে রাজাকে প্রত্যাখ্যাতও হতে হয়েছিল। ধীবর পাটনীর এই দৃঢ় চরিত্র ভীষণ নজর কাড়ে৷ কেন জানেন? একটা অত্যন্ত সাধারণ বাড়ির মেয়ের জন্য এমন প্রস্তাবে লোভ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পালিতা মেয়ে হলেও তার জন্য পাকাপোক্ত ব্যবস্থা চাইতে সে তার বাবাসুলভ মস্তিষ্কের অপব্যবহার হতে দেয়নি।

রাজা মর্মাহত ও বিমর্ষ হয়ে ফিরে এলেন।কারণ তাঁর আর গঙ্গার পুত্র দেবব্রত পুত্র যুবরাজ হিসেবে তখন অভিষিক্ত হয়েছিলেন। এদিকে শান্তনু এই প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেনি। প্রচন্ড বিরহে মুষড়ে পড়েছিলেন৷ যা তার কাছের মানুষদের থেকেও তিনি গোপন রাখতে পারেননি। পিতার এই কষ্ট দেবব্রতকে কষ্ট দিচ্ছিল। তিনি এক মন্ত্রীর কাছ থেকে সেই ধীবরের শর্তের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ সেই ধীবরের কাছে উপস্থিত হন এবং পিতার হয়ে সত্যবতীকে প্রার্থনা করেন। ধীবর পুনরায় তাঁর শর্তের কথা জানিয়ে বলেন,যদিও শান্তনুই তাঁর কন্যার জন্য উপযুক্ত, তাই তাঁরা ব্রহ্মর্ষি অসিতের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন। দেবব্রত রাজী হয়ে যান। কিন্তু ধীবর সুস্পষ্ট ভাবেই বলেন দেবব্রত সিংহাসন ছাড়লেও তার সন্তানরা ছাড়বে কেন? ধীবরকে আস্বস্ত করার জন্য দেবব্রত দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা করে বলেন যে, উনি কখনো বিবাহ করবেন না। এরপর সত্যবতীর সাথে শান্তনুর বিবাহ হয়। এই বিবাহের ফলে সত্যবতী’র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুটি পুত্র জন্মে।

দেবব্রত ত্যাগের ফলে ভীষ্ম হলেন৷ কিন্তু এই ঘটনা কোথাও গিয়ে মনে করাতে বাধ্য করে যে, সত্যবতী হস্তিনাপুর রাজসিংহাসনে শান্তনুর মৃত্যুর পর স্বীয় বংশ ছাড়া অন্য কোন রক্ত রক্তের চিহ্ন রাখবেন না৷ অর্থাৎ সত্যবতী আটঘাট বেধেই এসেছিলেন রানী হয়ে। মহাভারতের অজস্র ঘটনা রয়েছে তার মধ্যে এই ঘটনায় কবি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও এর ফল কিন্তু সুদুরপ্রসারি।

.
.
চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।