সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ১)

রহস্য উপন্যাস

সুন্দরী মাকড়শা

মাঝরাতে আজও ঘুম ভেঙে গেলো ঋষির। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো ও। সারাগায়ে কুলুকুলু করে ঘাম ঝরে পড়ছে। যদিও ঘরের এয়ার কন্ডিশন মেসিনটাকে আজও আঠেরোতে রেখেই ঘুমিয়েছিলো ও, কিন্তু সেটা চলছে না। অথচ গত কদিনের মতো আজও, এখনও মাথার ওপর ফ্যানটা সমানে ঘুরেই যাচ্ছে।
এই মেসে সবে মাস চারেক হলো এসেছে ঋষি। দক্ষিণ কলকাতার উপকন্ঠে টালিনালা পেরিয়ে একটু ভেতরে এই মেসবাড়ি। বাঁশদ্রোনী থেকে অটোতে মিনিট দশেক লাগে। কিন্তু অটোর লাইনে দাঁড়িয়েই কেটে যায় আধাঘণ্টা। এলাকাটায় একেবারে পিলপিল করে মানুষ।

বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। ধানবাদ না কোথায় যেন থাকেন ঋষি ঠিকমতো জানে না। দোতলা বাড়ির ওপরনীচ মিলিয়ে পাঁচটা ঘর। দোতলায় দুটো আর একতলায় একটা। বাড়িটা,সাবেক কালের। মালিক থাকেনা বলে সংস্কারের কাজও সেরকম একটা হয় না। বাড়িটা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে। অন্তত দশ বারো কাঠা তো হবেই। আগে কাঠের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হতো। সেই দরজার ফ্রেমটা এখনও আটকে আছে দুদিকের পিলারের গায়ে। ফ্রেম থেকে একটা জং ধরা গ্রিল গেট লটকে আছে। সেটা এমনভাবেই লটকে আছে যে খোলাও যায় না, অথবা বন্ধও করা যায় না। খানিকটা খোলা অবস্থায় ঝুলে আছে।

বাড়ির চারদিকটাতে এককালে দেড় মানুষ সমান দেওয়াল ছিলো, ছিলো বলাটা এ জন্যই যে, বেশীরভাগ অংশই ভেঙ্গেচুরে গেছে। কিছু জায়গায় এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তো কিছু জায়গায় কেউ যেন ঘাড় মটকে ভেঙে দিয়েছে। মাটির ওপরে মাত্র তিন চার সারি ইট মুখব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও আবার দেওয়ালটার মাঝখানেই একটা অতিকায় হাঁ করা শূন্যতা।
গেট দিয়ে বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটুকু এখনও ঠারেঠোরে জানান দেয় যে রাস্তার বুকে কখনও নুড়ি বিছানো ছিলো। দুপাশে ছিলো কেয়ারি করা ফুল গাছের সারি। দু একটা টগর, কাঞ্চন আর গোলাপ জেদি মেয়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়ানো। কতোদিন ধরে যে ওদের দিকে তাকায় নি কেউ কে জানে।
গেট, রাস্তা আর বাড়ির অংশটুকু ছাড়া সারা বাড়িটা বুনো ঝোপে ছেয়ে আছে। ওরই মাঝে পূব দক্ষিণ দিকের কোণায় একটা ভেঙ্গেচুরে তুবড়ে যাওয়া কুঁয়ো যেন অনেকটা বিদ্রোহ করে উঁকি দিচ্ছে। ওই কুঁয়োটাই এ বাড়িতে এখনও জলের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। ওটার বুকে নামিয়ে দেওয়া পাইপলাইনটা ঠেলেঠুলে ওর বুকে জমে থাকা জলকে তুলে দিচ্ছে ছাদের ওপরের প্লাস্টিকের ট্যাংকিতে।
ঋষি খাওয়ার জলটা ভারীকে দিয়ে আনিয়ে নেয়। আর যখন পাম্প বিগরোয় শুধুমাত্র তখনই ঝোপঝাড় ঠেলে এগিয়ে যেতে হয়। সুন্দরবনের মানুষ ঋষি এসব কিছু দেখেশুনেই এ বাড়ির মেসে এসে উঠেছে। কারণ এতো কম পয়সায় এ তল্লাটে মেসবাড়ির খোঁজ অনেক ঘাম ঝরিয়েও ঋষি খুঁজে পায়নি।

কিন্তু এটা হচ্ছে কী? কে এসে মাঝরাত্তিরে এয়ার কন্ডিশনটাকে বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছে? যেই করুক না কেন, সেটাতে ঋষির কিছু যায় আসেনা। কিন্তু তার উদ্দেশ্যটা কী সেটাকে জানতেই হবে। এ ধরনের পুরোনো বাড়িতে একমাত্র এই ঘরটাতেই এয়ার কন্ডিশনটা আছে। আর সে জন্যই এই ঝোপঝাড় ভরা পোড়ো ভাঙা বাড়িটাকে ও পছন্দ করেছে। কিন্তু সেই এসিটাই যদি এভাবে…
ঋষি গায়ের ভিজে সপসপে গেঞ্জিটাকে খুলে নেয়। বালিশের ওপর পেতে রাখা ছোট্ট হলদে রঙা টাওয়েলটা দিয়ে গা, মাথা সবকিছু মুছে নিয়ে নেমে আসে বিছানা থেকে। সুইচ বোর্ডে হাত রেখে আলোটাকে জ্বেলে নেয় ঋষি। নাহ্, এসিটার সুইচ এখনো অন করাই আছে। দরজার দিকে এগিয়ে যায় ও, কাল রাতে ঠিকমতো বন্ধ করেছিলো তো দরজাটা?

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।