ক্যাফে গপ্পো -তে মানসী রায়

ভয়

ঘুমচোখে আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠল প্রলয়। কে এটা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে? একটা আধবুড়ো লোক, খোঁচাখোঁচা দাড়ি, চোখের দু-পাশ কুঁচকে গেছে, কপালে একাধিক ভাঁজের স্থায়ী দাগ, গালের চামড়া ঈষৎ শিথিল, কাঁচাপাকা চুলে কালোর নামমাত্র অস্তিত্ব…থুতনির নীচের চামড়ায় ঢিলে ভাব…মাত্র একটা রাতের মধ্যে চেহারার এতটা পরিবর্তন কি সম্ভব? তাও আবার তার? প্রলয় বসুর? যার ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম সবকিছুর কেন্দ্রেই তার শরীর-স্বাস্থ্য এবং চেহারা? নিজের প্রতিবিম্বকে চূড়ান্ত অবিশ্বাসের চোখে জরিপ করল প্রলয়। তার চাবুকের মতো মেদহীন শরীর, চাপা অথচ উজ্জ্বল রঙ, খাড়া নাক, সামান্য পুরু মাদকতাময় ঠোঁট, আয়ত চোখ, সযত্নে এলোমেলো করে রাখা চুল – এ সমস্ত কিছুই তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়! সেই কোন ছোটবেলায় প্রায়শই এর তার কাছে শুনত সে সুন্দর, তার একটা লেডিকিলার লুক আছে। সেগুলো যে নেহাত কথার কথা নয় স্কুলে পড়তে পড়তেই সহপাঠিনীদের কটাক্ষ আর কাঁড়ি কাঁড়ি প্রেম নিবেদনে সে ভালোই বুঝে গেছিল। তারপর কলেজে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই সেসব আরও বাড়ল। একে মফস্বলের কলেজ, তায় আগতযৌবনা প্রলয়ের মারকাটারি চেহারা তখন যে কোনও ফিল্মের হিরোকেও গুনে গুনে বেশ ক’ গোল খাইয়ে দিতে পারে, অতএব তার চারপাশে মৌমাছির অভাব ছিলনা। নিজের রূপ, চেহারা নিয়ে আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর প্রলয় তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত সম্পর্কগুলো। সেসবের বেশিরভাগ শরীর পর্যন্ত গড়ালেও প্রেম-ভালোবাসার মতো কোনও বিষয় বা অনুভূতি অন্ততঃ তার দিক থেকে ছিলনা। তবে বিছানায় যাওয়ার আগে গড়পরতা মেয়েরা যে একটু প্রশংসা বা চাঁদ-ফুল-তারা মার্কা চর্বিতচর্বণ কথাবার্তা শুনতে পছন্দ করে, সেটা না বোঝা বা প্রয়োগ না করার মতো গবেট প্রলয় নয়!
এভাবেই আস্তে আস্তে নারীশরীর তার অন্যতম নেশা এবং অভ্যেস হয়ে দাঁড়ায়। সে জানত, আর কিছু না হোক তার চেহারাই তার সহায়। শুধু মেয়েদের ব্যাপারেই নয়, কেবলমাত্র এই চেহারা আর স্মার্টনেসের জোরেই কোনওমতে কলেজের গণ্ডি ডিঙোনোর পর কলকাতায় তার একটি মোবাইল কোম্পানিতে সেলস ও কাস্টমার রিলেশনস-এর কাজ জুটে যায় এবং এই চাকরির দৌলতেই প্রলয় নিজের জায়গার বাইরে কলকাতার মতো বড় ‘প্ল্যাটফর্মে ‘ নিজের ‘বাজারদর’ যাচাই করার একটা মস্ত সুযোগ পেয়ে গেছিল। অফিসে সে এবং তার পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যে মহিলা কাস্টমারদের ‘পটানোর’ একটা অনুচ্চারিত প্রতিযোগিতা চলত – কে কত বেশি জনের সঙ্গে প্রেমের নাটক করে তাদের বিছানায় নিয়ে যেতে পারে! সেখানেও প্রলয়ের ধারে কাছে কেউ আসতে পারতনা। কিন্তু সে উপলব্ধি করত তার রূপ-যৌবন যতদিন, মেয়েরাও ততদিনই আসবে। তাই শরীর আর চেহারার প্রতি তার যত্নের ত্রুটি ছিলনা। এ ব্যাপারে তার গুরু ছিল অনিকেত। অফিসে প্রলয়ের সিনিয়র ছিল তবে দুজনের মানসিকতা মিলে যাওয়ায় কেজো আলাপটা হৃদ্যতায় গড়াতে বেশি সময় নেয়নি। অনিকেত লম্বা, চওড়া, অত্যন্ত সুদর্শন, ডিভোর্সি এবং মেয়েদের দিক থেকে কদাচিৎ চোখ ফেরায়। বয়সে প্রলয়ের চেয়ে অনেকটাই বড় অথচ দেখতে প্রায় তার বয়সীই লাগে। প্রলয় চমৎকৃত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল “রহস্যটা কী?” অনিকেতও চোখ টিপে বলেছিল, “অল্পবয়সী মেয়ে, বুঝলি? আর কিচ্ছু না! যত কমবয়সীদের সঙ্গে মিশবি, দেখবি তোর বয়সও বাড়ছেনা!”
“তুমি কি তাহলে শুধুই….?” প্রলয় নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। “নয়তো কী! আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা, বিয়ে করেছিস কি মরেছিস! বাপ হলেই দেখবি চেহারার দফারফা। তিরিশেই পঞ্চাশ মনে হবে!”
প্রলয় নিজের বিবাহিত বন্ধুদের চেহারা মনে করার চেষ্টা করছিল। ঠিকই তো! বিয়ে ফিয়ে করে সবাই কেমন যেন গ্যাদগ্যাদে টাইপের হয়ে গেছে! সে শিউরে উঠল। বিয়ের কথা তার মা-বাবা ভাবলেও সে একেবারেই ভাবেনা। কিন্তু বয়স ধরে রাখার উপায়টা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য সে প্রথমে রেলস্টেশনে বহুল বিক্রীত ‘যৌবন ধরে রাখার ১০০টি উপায়’ ও শেষমেশ রিমলিবাবার শরণাপন্ন হয়েছিল। রিমলিবাবা তাদের পারিবারিক জ্যোতিষী, জ্যোতিষচর্চার পাশাপাশি তন্ত্রসাধনাও করেন। সেইসঙ্গে বশীকরণ, দোষ কাটানো – সবেতেই তিনি পারদর্শী। এছাড়াও যাকে বাকসিদ্ধাই বলে তিনি হচ্ছেন একেবারে তাই। কোনও কার্যসিদ্ধির জন্য যা যা যেমন ভাবে করতে বলেন সেইমতো ঠিকঠাক করতে পারলেই একেবারে হাতে হাতে ফল। প্রবালের আঙুলের পোখরাজ আর প্রবালটাও তাঁরই দেওয়া। তার মা-বাবা তো ওঁকে না জিজ্ঞেস করে একটা পা-ও ফেলেন না। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওঁর পরামর্শ নেন। সেই রিমলিবাবাই তাকে সঠিক উপায়টা বাৎলে দিয়েছিলেন – কেবল অল্পবয়সী হলেই হবেনা, মেয়েটিকে কুমারীও হতে হবে। এক একটি কুমারী মেয়ের সঙ্গে পূর্ণ, সফল ও আনন্দময় রতিক্রিয়া একটি ছেলের চেহারা থেকে বয়সের ছাপ পাঁচ থেকে সাত বছর পর্যন্ত কমিয়ে ফেলতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে মেয়েটি যেন আর কুমারী না থাকে! সাফল্যটা আসলে সেখানেই।
এই উপদেশে প্রলয় যেন অমৃত লাভ করল। এতদিন মেয়েদের ব্যাপারে তার কোনও বাছ-বিচার ছিলনা। বিবাহিত, অবিবাহিত, কমবয়সী, বেশিবয়সী, কাউকেই কখনও প্রত্যাখ্যান করেনি। এর পর থেকে নিজেও একটু চেষ্টাচরিত্র শুরু করল। মানে, অন্যগুলো যেমন চলছে চলুক, পাশাপাশি দু-একটা কুমারী মেয়ের সঙ্গেও যাতে…। অফিসে, বাইরে, দোকানে, বাজারে সর্বত্র তার চোখ ঘুরত ‘সম্ভাবনাময়’ অষ্টাদশীর খোঁজে। তার চেয়ে কম হলে তো আরও ভালো হয়, কিন্তু তারা আবার নাবালিকা…কিছু গণ্ডগোল হলে যন্ত্রণার শেষ থাকবে না!
শিকার প্রচুরই ধরা পড়ত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেত তারা কুমারী নয়। সমাজে ছোট ছোট মেয়েদের এই নৈতিক অবক্ষয় দেখে প্রলয়ের আক্ষেপের সীমা থাকতনা! তবে এ বিষয়ে তার খুব সুবিধে হয়েছিল তৃতীয় চাকরিতে ঢোকার পর। সেখানে আর অফিসে বসে নয়, জেলায় জেলায় ছ-মাস, এক বছর করে থেকে ঘুরে ঘুরে কাজ। আধাশহর বা মফস্বলের দিকের স্কুল-কলেজের মেয়েরা বোধহয় কম সেয়ানা হয়। ভবিষ্যৎ স্বামীর জন্য তাদের কৌমার্য বাঁচিয়ে রাখার একটা চেষ্টা থাকে। তবে একটু স্টাইল, একটা দুর্দান্ত মোটরবাইক কিংবা ছোটখাটো হিরোগিরি দেখিয়ে তাদের মন, শরীর দুটোই জয় করে ফেলা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় আর প্রলয়ের কাছে তো নস্যি! আর এভাবে রিমলিবাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলায় সে পুরো ম্যাজিকের মতো ফল পেয়েছিল! মেঘে মেঘে বাহান্নটা বসন্ত পেরিয়ে এলেও তার চেহারা দেখে তা বোঝার কোনও উপায় নেই। দিব্যি পঁয়ত্রিশের যুবক বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কয়েক বছর আগে তার অফিস ঘুরেফিরে তাকে আবার কলকাতায় এনে ফেলেছে এবং এখানে কুমারী অষ্টাদশীদের অভাব সে ভীষণভাবেই টের পাচ্ছে। যদিও সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর বদান্যতায় একাধিক স্কুল পড়ুয়ার সঙ্গে তার নিয়মিত সেক্সচ্যাট চলে (তারা অবশ্যই কুমারী নয়, প্রলয় একশো ভাগ নিশ্চিত) এবং দু-একজন বিবাহিত মহিলার সঙ্গেও সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু তাতে তো আর বয়স কমবে না! যে মফস্বল শহরে তার বাড়ি, সেখানেও তেমন সুবিধে করতে পারেনি। অথচ আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে আর তেমন যুবক মনে হয় না আজকাল। গালের মাংস যেন একটু বেশি ভারী, মুখে কয়েকটা অতিরিক্ত দাগ…বুড়ো হলে যেমনটা হয়…তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়!
কদিন ধরেই মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিল প্রলয়। যে মেট্রোস্টেশনের পাশ দিয়ে সে অফিসে যায় সেই স্টেশনের সামনের ফুটপাথেই থাকে। উড়োখুড়ো চুল, নোংরা ফ্রক, ময়লা হাত, পা, মুখ…তবে খুব বড় বড় ঝকঝকে চোখ আর বেশ ডাগর চেহারা। প্রলয়ের অভিজ্ঞতা বলছে এর বয়স বারো-তেরোর বেশি হতেই পারেনা। তার মনে একটা লোভ মাঝে মাঝেই উঁকি দেয়। কিন্তু চাইলেই তো আর সব হয় না। সমস্ত আঁটঘাট বুঝে এগোতে হবে। এ ব্যাপারেও তার পরামর্শদাতা সেই আদি ও অকৃত্রিম অনিকেত। দুজনের কর্মক্ষেত্র বিগত বেশ কিছু বছর ধরে আলাদা হলেও সম্পর্কে ভাঁটা পড়েনি। অনিকেত তার পিঠ চাপড়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চোখ টিপে বলেছিল “সাব্বাশ! এই না হলে পুরুষমানুষ! তবে আমারও ভাগ চাই। তুই চিন্তা করিস না। আমার গাড়িতেই তুলব।”
প্ল্যান অনুযায়ী রাত দুটোয় মেয়েটাকে যখন ওরা ফুটপাথ থেকে তুলছিল মেয়েটা এবং ফুটপাথের বাকি সবাই গভীর ঘুমে। মেয়েটা তো ঘুম ভেঙে প্রথমে বুঝতেই পারেনি কী ঘটছে। প্রলয় অবশ্য গোড়া থেকেই মুখ চেপে ধরে রেখেছিল যাতে চেঁচামেচি করার সুযোগই না পায়। চালকের আসনে বসে অনিকেত গাড়ি প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল একটা খালের ধারের শুনশান জায়গায়। প্রলয় একটুও সময় নষ্ট না করে এক হাতে মেয়েটার মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে কাজ শুরু করে দিল। মেয়েটার অস্ফুট গোঙানি কাঁচতোলা বন্ধ গাড়ির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল, শুধু চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। প্রলয়ের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল এই মেয়ে কুমারী কি না। রাস্তার মেয়েদের আবার কৌমার্য! তার আগেই অন্য কেউ বা কয়েকজন হয়তো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু না! তা নয়! তা একেবারেই নয়! দীর্ঘ দিন পর বয়স কমানোর উত্তেজনায় গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে মেয়েটাকে নিজের শরীরের নীচে পিষতে থাকে প্রলয়। বুঝতেই পারেনি কখন গোঙানি থেমে গিয়ে মেয়েটা নিথর হয়ে গেছে।
“…এই, দেখি তো কী ব্যাপার…মেয়েটা চুপ করে গেল কেন?” অনিকেতের কথায় ঘোর কাটল প্রলয়ের। নিজেকে সামলে নিয়ে দেখল মেয়েটার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ। চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁটের কোণ থেকে লালার ক্ষীণ ধারা নেমেছে। “এঃ, মরে গেছে রে…” অনিকেতের গলায় তাচ্ছিল্য। প্রলয় চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটা বোধহয় কুমারীই রয়ে গেল শেষপর্যন্ত…আরেকটু যদি সময় পেত!…অনিকেতকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে আবারও মরা মেয়েটার ওপর হামলে পড়ল প্রলয়। ‘সাফল্য’ নিশ্চিত হওয়ার পর দুজনে মিলে রক্তাক্ত লাশটাকে খালের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে এসেছিল। ফুটপাথের নাম-ঠিকানাহীন একটা শহরের বোঝা মরেছে, তার জন্য পুলিশ পরিশ্রম করে খুনিদের খুঁজবে এমন দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই কিন্তু সকালে উঠে আয়নায় নিজেকে এত বয়স্ক দেখাচ্ছে কেন? যেন কত বুড়ো! বরং উল্টোটাই তো লাগার কথা! এটা নিশ্চয়ই তাহলে গতরাতের ধকল আর ক্লান্তির জন্য মনে হচ্ছে। তাই-ই হবে! তা-ই যেন হয়! নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল প্রলয়। জোরে জোরে জলের ঝাপটা দিল মুখে, পাগলের মতো সাবান ঘষল…তবু সে ভয়ে কিছুতেই আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারছিল না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।