দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৭৪)

পর্ব – ১৭৪

কলিংবেল বাজাতে উপর থেকে তাকায় বয়স্ক কাজের মহিলাটি। তারপর হাত দেখিয়ে তাকে অপেক্ষা করতে বলে। শ‍্যামলীর মনে পড়ে, প্রথম যেদিন সে এ বাড়িতে এসেছিল, তাকে দেখে ভিখিরি ভেবেছিল মহিলাটি। উপর থেকে পয়সা ছুঁড়ে বিদেয় করতে চেয়েছিল। তারপর অপদেবতা বলে মনে করে ভয় পেয়েছিল মেয়েটি। এবার অনসূয়াকে সে বারান্দায় ডেকে আনল। কুসংস্কার যেন মরেও মরতে চায় না। ভূতের ভয় তো বটেই।  দরজা খুলে দিল বাগানের মালীটা।  দোতলায় অনসূয়ার পড়ার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শ‍্যামলী বলল, দিদি আসব? অনসূয়া উঠে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, না, আসবি না, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। তারপর দুজনেই হেসে উঠল।
শ‍্যামলীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভ্রূ কুঁচকে অনসূয়া বললেন, আজ তোর কি হয়েছে রে?
শ‍্যামলী কিছু বলল না দেখে তিনি নরম স্বরে বললেন, হ‍্যাঁ রে, আমায় বলবি না কি হয়েছে?
শ‍্যামলী মাথা নিচু করে বসে থাকে। তারপর বলে, আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি দিদি।
অনসূয়া বললেন, কি হয়েছে বল্, কোনো সঙ্কোচ করিস না। দাঁড়া, কফি খেতে খেতে শুনব। তুই মুখে চোখে একটু জল দিয়ে আয়। বড্ড কালিষ্টি দেখাচ্ছে তোকে।
শ‍্যামলী বলল, দিদি, আপনার তুলনায় আমি তো কালোই।
তার চিবুক ধরে আদর করে অনসূয়া বললেন, কে বলেছে আমার বোনটা কালো? তার গায়ের রঙ পাকা গমের মতো।
শ‍্যামলী বলল, আপনার যে গায়ের রঙ হাতির দাঁতের মতো?
অনসূয়া বললেন, সে ছিল এককালে। তখন তোর মতো বয়েস। মা জ‍্যাঠিমারা জোর করে দুধে ময়দা গুলে রূপটান করে দিতেন। রবিবার সকালে পড়ছি, এমন সময় তেল আর কাঁচা হলুদ বাটা মাখাবেন বলে পীড়াপীড়ি। সে সব দিন আর নেই রে। বাজারের স্নো পমেটম দিয়ে কি আর ওসব হয় রে?
শ‍্যামলী বলল, পমেটম জিনিসটা ঠিক কি, আমি হাতে নিয়ে দেখি নি।
অনসূয়া বললেন, আমিও দেখিনি। আমার বাবা বোতল বোতল তুহিনা আনত। আমার মা ছোটবেলায় আমায় দুবেলা গোটা গায়ে তুহিনা লেপত। সেই নিয়ে বড়ো হবার পরেও মামা মাসিরা আমাকে দেখলেই তুহিনার গন্ধ পেতেন। স্নো পমেটম একটা জুড়ি শব্দ।
শ‍্যামলী বলল, একটা ব‌ই আছে জানেন দিদি, সুহাসিনীর পমেটম।
অনসূয়া বললেন হ‍্যাঁ। পড়া হয়ে ওঠেনি, তবে আমাদের লাইব্রেরিতে আছে। কমলকুমার মজুমদারের মতিলাল পাদরি আর নিম অন্নপূর্ণা পড়েছি। ওঁর কলমের ভাষার গড়নটা একেবারেই অন‍্য রকম।
শ‍্যামলী বলল, জানেন দিদি, এই কমলকুমার মজুমদার সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও আসলে তিনি ছিলেন একজন গণিতবিদ।
অনসূয়া বললেন, বলিস্ কি? গণিতবিদ? কমলকুমার মজুমদার?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ দিদি। এমনকি তিনি বাংলা ভাষায় একটা গণিত পত্রিকাও বের করতেন। আমার যদি খুব ভুল না হয়, তবে কমলকুমারের পত্রিকাটাই বাংলা ভাষায় গণিত বিষয়ে প্রথম সাময়িক পত্র।
অনসূয়া বললেন, বাপ্ রে, অঙ্কে একটু ভয় পেতাম বলেই ল নিয়ে পড়লাম। জ‍্যাঠামশাই জোর করে ইংরেজি নিয়ে বসতেন। আর ছোটকার চাপে জার্মান পড়েছি। স্প‍্যানিশ পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কিছুই আর হল না। এখন খালি আইপিসি, সিআরপিসি, এভিডেন্স অ্যাক্ট। কিন্তু সাহিত্যিক হয়ে গণিতের সঙ্গে এত গভীর সম্পর্ক? কমলকুমার আবার পড়তে হবে তো!
শ‍্যামলী বলল, বাংলা ভাষার একজন বড় কবি বিনয় মজুমদারও গণিতের লোক ছিলেন। আর ইংরেজি সাহিত‍্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তাঁর নোবেল পাবার সালটা ১৯৫০। জানেন, তিনিও উল্লেখযোগ্য গণিতজ্ঞ হিসেবে সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত। সেট থিওরি নিয়ে অরিজিনাল কাজ করেছেন। আবার ফরাসি সাহিত্যের অন‍্যতম সেরা মানুষ সিমোন দ‍্য বুভুয়া, সেকেণ্ড সেক্স আর মান্দারিন ব‌ই লিখে বিশ্বজোড়া নাম, তিনিও আদতে বড় মাপের গণিতবিদ ছিলেন। লাইবনিৎজের গণিতচর্চা নিয়ে তাঁর পড়াশুনা।
অনসূয়া তাঁর কাজের সহায়িকার দিকে হাঁক পাড়লেন, কই গো দিদি, আমাদের কফি দিয়ে যাও। আমারটা ব্ল‍্যাক হবে।
মহিলা উত্তর করলেন এই বলছ কালো হয়ে যাচ্ছি, তাতে কালো কফি খাবে? হরলিক্স দুধ গুলেছি, ওই খাও।
অনসূয়া বললেন, হরলিক্স আমার বোনটাকে খাওয়াও, সে এখনো ছেলেমানুষ, ওর কাজে লাগবে।
মহিলা দুজনের জন‍্য‌ই হরলিক্স এনে অনসূয়াকে বললেন, তোমারই বা কোন্ তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে যে হরলিক্স খাওয়া চলবে না? খেয়ে নাও।
শ‍্যামলীর দিকে তাকিয়ে অনসূয়া বললেন, দেখেছিস তো, আমি কোর্টে বিপক্ষের সাক্ষীকে জেরায় জেরায় জেরবার করে দিই, কিন্তু বাড়িতে আমার কোনো কথাই খাটে না।
তারপর অনসূয়া শ‍্যামলীকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ‍্যাঁ রে, তুই একটা কি দরকারে এসেছিস বলছিলি, গল্পে গল্পে সেটা ভুলে যাচ্ছি।
শ‍্যামলী মাথা নিচু করে বলল, দিদি, আমার অ্যাডমিট কার্ড আর মার্কশীট এইসব যদি আপনার বাড়িতে রাখতে দেন, খুব উপকার হয়।
অনসূয়া নিচু স্বরে বললেন, হ‍্যাঁ রে, বাড়িতে আবার তোর ভায়েরা মারধর করেছে বুঝি?
শ‍্যামলী বলল, না না, তেমন কিছু নয়।
অনসূয়া বললেন, পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ। বাড়িতে ঠিক কি হয়েছে শিগগির বল্?
শ‍্যামলী বলল, দিদি, আমি একটা মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজছি। কলেজে প্রিন্সিপাল ম‍্যামকে কতো রিকোয়েস্ট করলাম, বললাম, হোস্টেলে থাকতে দিন। কিন্তু উনি বাড়িতে ঠিক কী ধরনের অশান্তি জানতে চাইলেন। সব ডিটেইলস বলা যায় বলুন তো? প্রাইভেসিতে আটকায় না?
অনসূয়া বললেন, শ‍্যামলী তোর সেই কবিতাটা মনে আছে, যাহা চাহ, তার কিছু বেশি দিব…,
শ‍্যামলী  হেসে বলল, বেণীর সঙ্গে মাথা। ওটা রবি ঠাকুরের কথা ও কাহিনীর কবিতা। কবিতার শিরোনাম, প্রার্থনাতীত দান
পাঠানেরা যবে বাঁধিয়া আনিল
বন্দী শিখের দল—
সুহিদ্‌গঞ্জে রক্ত-বরন
হইল ধরণীতল।
নবাব কহিল—শুন তরুসিং
তােমারে ক্ষমিতে চাই।
তরুসিং কহে মােরে কেন তব
এত অবহেলা ভাই।
নবাব কহিল, মহাবীর তুমি
তােমারে না করি ক্রোধ,
বেণীটি কাটিয়া দিয়ে যাও মােরে
এই শুধু অনুরােধ।
তরুসিং কহে করুণা তােমার
হৃদয়ে রহিল গাঁথা—
যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব
বেণীর সঙ্গে মাথা।
অনসূয়া বললেন, কবিতাটা বলতে পারার জন‍্য তোর একটা চকোলেট পাওনা হল। দিদি দ‍্যাখো তো ফ্রিজে সুইস চকোলেট আছে কিনা, সেদিন নিয়ু মার্কেট থেকে এসেছিল।
কাজের সহায়িকা বলল, আমি এখন ব‍্যস্ত। পরে দেখছি।
অনসূয়া বললেন, এই যে গণিতবিদ, বলুন তো কবিতাটা আমার মাথায় এল কেন?
শ‍্যামলী কিছুই বলতে পারল না। ফ‍্যালফ‍্যাল করে চেয়ে র‌ইল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।