দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২২৮)

পর্ব – ২২৮

অরিন্দম এসেছেন। হাসছেন।
অনসূয়া বললেন, আয়।
অরিন্দম বললেন, শ‍্যামলী, তোমার মনে আছে, তোমার বাবাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলাম?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ, সে সব লড়াইয়ের দিন কি ভোলা যায়?
অরিন্দম অনসূয়াকে বললেন, জানিস তো, সেদিন দেখেছিলাম শ‍্যামলীর ম‍্যানেজমেন্ট। হোটেলের ঘর বুক করা। আমাদের জন‍্য পাজামা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, বিছানার উপর আলাদা চাদর। ওইটুকু বয়সের একটা মেয়ে যে অতো নিখুঁত করে ভাবতে পারে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
অনসূয়া শ‍্যামলীকে বললেন, তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়িস, তাই না?
শ‍্যামলী বলল, বাবার শরীর খারাপ হয়ে যেতে আমার জীবনের গতিপথ বদলে গেল। আমি বাস্তব পৃথিবীটাকে দেখতে বুঝতে শিখলাম।
 অনসূয়া বললেন, দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে।
অরিন্দম বললেন, যাক্ না পায়ের তলার মাটি, তুমি তখন ধরবে আঁটি…
শ‍্যামলী বলল, একটা পরিস্থিতি থেকে আরেকটা পরিস্থিতিতে গেলে নতুন নতুন সম্ভাবনা এসে যায়। মাথা তোলে নতুন বাস্তবতা।
অনসূয়া বললেন, কফি ছাড়া শ‍্যামলীর বক্তৃতা জমবে না। ইলেকট্রিক কেটলিতে জল ফুটতে দিলেন অনসূয়া।
শ‍্যামলী বলল, একশো ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জল ফুটতে ফুটতে বাষ্প হতে থাকে। তার মানে ওই একশো ডিগ্রিতে জল আর বাষ্প দুটোই থাকে। জল আর বাষ্প দুটোই সমান একশো ডিগ্রিতে থাকে। কিন্তু জলকে বাষ্প করে দেয় লীনতাপ।
অনসূয়া বললেন, তাতে কি বোঝা গেল?
অরিন্দম বললেন, বোঝা গেল এই যে, তোর হাতে এখন চমৎকার কফি খাব।
শ‍্যামলী বলল, প্রতি গ্রাম ফুটন্ত জল, যার তাপমাত্রা একশো ডিগ্রি সেলসিয়াস, তাকে একশো ডিগ্রির বাষ্প করতে গেলে গ্রাম পিছু ৫৪০ ক‍্যালোরি তাপ লাগে। আবার শূন‍্য ডিগ্রি সেলসিয়াস বরফকে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার জল করে তুলতে গ্রামপিছু আশি ক‍্যালোরি শক্তি লাগে।
অনসূয়া বললেন, তাহলে জল আর বাষ্প কিংবা জল আর বরফ, দুটো এক‌ই তাপমাত্রার হলেও, তাতে তাপের পরিমাণে পার্থক্য থাকে।
আমি যে এই একটা বাঁধন থেকে বেরিয়ে এলাম, তাতে বাইরে থেকে দেখতে আমার কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বদলে গিয়েছি। আমিও বাবার আদুরে মেয়েই ছিলাম। কিন্তু যতই আমি নিজেকে জানতে চাইলাম, ততই আমার সঙ্গে সকলের দূরত্ব তৈরি হতে লাগল।
অরিন্দম বললেন, দূরত্ব তবু একরকম, সরাসরি সংঘাত লেগে গেল।
শ‍্যামলী বলল, কিন্তু আমি সব বুঝতে পারছিলাম, ওবাড়িতে আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবুও যতদিন না চাপের মুখে বাবা দলিল করে ফেলল, আমি বাঁধন কাটতে পারছিলাম না। আজও মায়ের কথা, বাবার কথা শুনতে শুনতে আমার যন্ত্রণা হচ্ছিল।
অনসূয়া অরিন্দমকে বললেন, আজ ওর বাবা মা ওকে নিতে এসেছিলেন।
 অরিন্দম বললেন, শ‍্যামলী,  হোস্টেলের রুমটা পছন্দ হয়েছে?
শ‍্যামলী বলল, কি করে প্রিন্সিপাল হোস্টেলে থাকতে দিতে হঠাৎ রাজি হয়ে গেলেন ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনসূয়াদি হদিশ দিয়েছেন।
অরিন্দম বললেন আমি সারাদিন তোমার কথাই ভেবে গিয়েছি। শ‍্যামলী বলল, সে আমার সৌভাগ্য।
অরিন্দম বললেন, তোমার মতো করে ভেবে ভেবে একটা মেয়ের কি কি লাগে সেই সব ফর্দ করে পাঠিয়ে দিয়েছি।
শ‍্যামলী বলল, গতকাল বেশ দেরি করেই রমানাথবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমি জানতাম না, আমি কোথায় যাচ্ছি, আমি কি করব। দুদিন ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি, একটা মাথা গোঁজার জায়গার জন‍্যে।
অনসূয়া বললেন, তোকে কিন্তু আমি থাকতে বলেছিলাম।
শ‍্যামলী বলল, সেটা আমার মাথায় র‌ইল। মাঝে মাঝে আসব। এক আধ দিন থাকব।
এমন সময় সহায়িকা এসে বলল, ডিনার রেডি।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Kailash Khawas says:

    খুবি ভালো। ধন্যবাদ জানাই এতো বেশি জরুরি ইনফরমেশন দিয়ে লিখে দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।