দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৪২)

পর্ব – ২৪২

খোকার মা তাঁর স্বামীকে বললেন, ছেলে কি করেছে জানো?
গম্ভীর ভাবে খোকার বাবা বললেন, কি করেছে?
আজ দিদি ওকে নিয়ে ঘোষপুকুরে গিয়েছিল।
খোকার বাবা জানতে চাইলেন, কেন ঘোষপুকুরে কেন?
মা বললেন, ওখানে যে বছরে একদিন গঙ্গা আসেন।
যত ভুলভাল কথা। গঙ্গা একটা নদী। সে কি ইচ্ছে করলে ট‍্যুর করতে যেতে পারে?
আচ্ছা, তর্ক পরে হবে, আগে কি হয়েছে সেটা তো শোনো।
কি হয়েছে।
খোকাকে ঘোষপুকুরে স্নান করিয়ে  চণ্ডীর থানে নিয়ে যাবার সময় রাস্তায় দুটো কুকুর মেলামেশা করছিল। খোকা সেদিকে নজর করে বলেছে, ওদের বাচ্চা হবে বলে ওইরকম করছে। তাইতে দিদি ওকে ঠাস করে একটা চড় মেরে আবার রিক্সা ঘুরিয়ে ঘোষপুকুরে গিয়ে আবার পাঁচ পাঁচ বার নিজে ডুব দিয়েছে, ওকেও ডুব গালিয়েছে।
তাইতে আজ বিকেলে দিদির গা গরম, হ‍্যাঁচ্চো হচ্ছে।
খোকার বাবা বললেন, তা পচা পুকুরে স্নান করলে এমন হতেই পারে। খোকার কিছু হয় নি তো?
মা বললেন, না, সে মহানন্দে বল খেলতে গেছে। এইবার ফিরে আসবে। কিন্তু কুকুরেরা যা করছে করছে, তোর ওদিকে তাকানোর দরকারটা কি?
বাবা বললেন, মিউনিসিপ্যালিটিকে একটা চিঠি লিখতে হবে। মিনেস অফ স্ট্রিট ডগস। কাল সকালে একবার খেয়াল করে দিও।
মা বললেন, হুঁঃ, তুমিও যেমন? কুকুর আর কোন্ পাড়ায় না থাকে? আর এই ভাদ্রমাসটাই ওদের মেলামেশার সময়। প্রকৃতি ওদের রাশ রাখে। পুরুষদের মতো কান মুচড়ে নিত‍্যদিন আদায় করে না।
স্বামী গম্ভীর হয়ে বললেন, ওইজন‍্যে তো ওকে আলাদা ঘরে শোয়ার ব‍্যবস্থা করে দিয়েছি।
মা বললেন, সে কথা হচ্ছে না, এই যে সব জেনে ফেলছে, এরপর কি হবে?
বাবা বললেন, স্কুলের ছেলেগুলোর মধ‍্যে ক’টা বাঁদর আছে। তোমার ছেলে দেখে দেখে ওগুলোর সঙ্গেই মেশে।
মা ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, ওঃ, যখন দোষ করে, তখন আমার ছেলে। আর ভালোটুকু তোমার। আশ্চর্য মানুষ তুমি!
এমন সময় খোকার মায়ের চোখ গেল দরজার পর্দাটা একটু গায়ে জড়িয়ে খোকা দাঁড়িয়ে আছে।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে, কখন এলি?
খোকা বলল, দশ মিনিট হল। জ‍্যাঠাইমার বেশ জ্বর। জলপটি দিয়ে হাওয়া করছিলাম।
বাবা বললেন, বাঃ, দেখেছ, কতটা দায়িত্ববোধ?
মা বললেন, এখন ও কার ছেলে, তোমার না আমার?
বাবা উত্তরে কিছু বললেন না।
ছেলে বাবাকে বলল, জ্বর মানে একটা কোথাও ইনফেকশন হয়েছে। ওষুধ জ‍্যেঠুর ব‍্যাগে অনেক রকম আছে। রকসিসাইক্লিন, অ্যামক্সিসিলিন, অ্যামপিসিলিন, এরিথ্রোমাইসিন, সেফালোস্পোরিন, ক্রিস্টালাইন পেনিসিলিন। কিন্তু প‍্যাথোজেন কোথায় কিভাবে আছে না জেনে, ওষুধ দেওয়া যাবে না।
বাবা বললেন, ওষুধ দেবার কথা আসছে কেন? কখানা ওষুধের নাম জানলেই ওষুধ দেবার অধিকার আসে না। তার জন‍্য লাইসেন্স লাগে। তার আগে পাশ করতে হয়।
মা বলল, ও তো ওষুধ দেবে বলে নি। ও তো প‍্যাথলজিক‍্যাল টেস্টের কথাই বলছে।
বাবা বলছেন,  মোটে ক্লাস এইটে পড়ে, এত ওষুধের নাম মুখস্থ করার দরকারটা কি?
আসলে সকালেই বাজারে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক মশায়ের। তিনি বাবার কাছে অভিযোগ করেছেন, আপনার ছেলে আপনাদের বংশের নাম ডোবাবে।
বাবা এই আশঙ্কার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষক বলেছেন, ক্লাসে লিখতে দিয়েছিলাম সম্রাট আকবরের শাসনব‍্যবস্থার সঙ্গে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের শাসনব‍্যবস্থার তুলনা কর। এই কুড়ি নম্বরের প্রশ্নের উত্তরে আপনার ছেলে লিখেছে, আকবর আর ঔরঙ্গজেব, দুজনের শাসন ব‍্যবস্থার মধ‍্যে মৌলিক কোনো বিভেদ খোঁজ করাটাই অর্থহীন। কেননা, দুজন সম্রাটের জীবৎকালের সময়ের বেশ খানিকটা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, অর্থনৈতিক অবস্থার লক্ষ‍্যণীয় কোনো পার্থক্য ছিল না। দেশ ছিল কৃষিভিত্তিক। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ছিল কৃষক। তাদের থেকে খাজনা আদায় করেই দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হত। মধ‍্যবর্তীস্তরের খাজনা আদায়কারী ব‍্যক্তিরা কৃষককে যথেষ্ট মাত্রায় শোষণ করত। কৃষি ছিল একেবারেই প্রকৃতির খেয়ালখুশির উপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও দেখা দেয় নি। পথঘাট ও যানবাহনের অপ্রতুলতার জন‍্য কৃষিজীবী সাধারণ মানুষ নিজের গ্রামের বাইরে কদাচিৎ যেত। শাসনব‍্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। উভয় আমলেই শাসকেরা জনগণের কাছে উত্তর দিতে দায়বদ্ধ ছিলেন না। তাঁদের সময়ে সুসংগঠিত বিচারব‍্যবস্থা বলেও কিছু ছিল না। আইন বলেও লিখিত আকারে কিছু ছিল না। শাসকের খুশির উপরেই জনগণের ভাগ‍্য নির্ণীত হত। এই ধরণের কাঠামোয় সর্বোচ্চ শাসক ভাল কি মন্দ, উদার না ধর্মোন্মাদ, আরামপ্রিয় না কষ্টসহিষ্ণু, তার উপর দেশের নিম্নকোটির মানুষের অবস্থার হেরফের হয় না। তাঁদের ব‍্যক্তিজীবনের ও ব‍্যক্তিচিন্তার কোনো প্রভাব তৃণমূলস্তরে গিয়ে পৌঁছায় না। দেশ আসলে শাসন করত মনসবদার, ও স্থানীয় শাসকেরা। সম্রাট থাকতেন বহু উচ্চ অবস্থানে, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।…. আপনিই বলুন, এসব বেঁড়ে পাকামো নয়?
বাবা বললেন, আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, ওর লেখাটা আপনি এত চমৎকার মুখস্থ করলেন কেন?
শিক্ষক অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আসলে সব মাস্টারদের বারবার পড়ে শুনিয়েছি। আপনার ছেলে এখন স্কুলে একটা হাসির খোরাক।
বাবা ভেবে পাচ্ছেন না খোকাকে কি বলবেন। কিন্তু এমন উত্তর নিয়ে খোকাকে হাস‍্যাস্পদ করা হয়েছে, এটাও তাঁর খারাপ লাগছে। এই দেশে স্বাধীন চিন্তার পরিসর বড় অল্প। যেসব শিক্ষক সিলেবাসের ঘেরাটোপে বাঁধাগতে পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় কোনোমতে উগরে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে সমান্তরাল ভাবনার আশা করাই অর্থহীন। তেতোমুখে তিনি নীরবে স্থান পরিত্যাগ করেছিলেন।
জ‍্যাঠামশায় বাড়ি ফিরে জ‍্যাঠাইমার কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন। খোকাকে বললেন, অসুখ সম্পর্কে আন্দাজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নেই। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। খোকা বলল, হ‍্যাঁ। আমিও বাবাকে সেটাই বলতে গেলাম। জ্বর মানে একটা কোথাও ইনফেকশন হয়েছে। ওষুধ তো তোমার ব‍্যাগে অনেক রকম আছে দেখলাম। রকসিসাইক্লিন, অ্যামক্সিসিলিন, অ্যামপিসিলিন, এরিথ্রোমাইসিন, সেফালোস্পোরিন, ক্রিস্টালাইন পেনিসিলিন। কিন্তু কথাটা হল, প‍্যাথোজেন কোথায় কিভাবে আছে না জেনে ওষুধ দেওয়া যাবে না। হিতে বিপরীত হবে। আগে পরীক্ষা করতে হবে।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, আমাদের শরীরের নিজস্ব কিছু প্রতিরক্ষা ব‍্যবস্থা রয়েছে। তারাই আসল লড়াকু। তাদেরকে লড়বার সুযোগটা দেওয়া উচিত। না দিলে তারা অকেজো হয়ে যেতে থাকে। তারপর যদি দেখা যায় তারা পারছে না, তখন ওষুধ প্রয়োগ।
খোকা বলল, অ্যান্টিবায়োটিক।
জ‍্যাঠামশায় বললেন খোকা, অ্যান্টিবায়োটিক বললেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে পেনিসিলিন শব্দটা। ১৯২৮ সালে স্কটিশ ডাক্তারবাবু আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিয়াম ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। তখন তিনি লণ্ডনের সেন্ট মেরিজ হসপিটালের ডাক্তার। কিন্তু রোগীদের চিকিৎসা করার জন‍্য অনেক পেনিসিলিন দরকার ছিল। অতটা তিনি তৈরি করার অবস্থায় ছিলেন না। ১৯৪০ সাল থেকে কি করে প্রচুর পরিমাণে পেনিসিলিন তৈরি করা যায়, সেই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন অক্সফোর্ডের একটা টিম। তাঁরা পারলেন। ওই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তখন অনেক আহত সৈনিকের চিকিৎসার জন‍্য চাই অনেক পেনিসিলিন। হাওয়ার্ড ওয়াল্টার ফ্লোরি আর আর্নস্ট চেইনদের টিম তা করতে পারল। এইজন্য ফ্লেমিং ফ্লোরি আর চেইন, এই তিনজনকেই একসাথে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। সেটা ১৯৪৫ সাল।
তারপর পেনিসিলিন জিনিসটার রাসায়নিক গঠন আর উপাদান ঠিক কি কি, সেই নিয়ে কাজ করতে লাগলেন এডুয়ার্ড আব্রাহাম। ১৯৪২ সালে তিনি এই ব‍্যাপারে একটা আইডিয়া দিলেন। ওঁর আইডিয়া যে সঠিক সেটা জানালেন ডরোথি ক্রোফুট হজকিন। সেটা ১৯৪৫ সাল। এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি পদ্ধতিতে হজকিন ওটা নিশ্চিত করেছেন। এই ক বছর আগে, সাতান্ন সালে জন সি সিহান কৃত্রিমভাবে পেনিসিলিন তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। একটা জিনিস এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক মানুষের সক্রিয় সাহায্য লাগে।
খোকার মা বড়জায়ের কপালে হাত রাখলেন। এখন কেমন লাগছে দিদি? জ্বর মনে হচ্ছে ছেড়ে গেছে।
খোকার জ‍্যাঠাইমা বললেন, হ‍্যাঁ। এখন অনেকটা ভাল লাগছে।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।