দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৯০)

পর্ব – ১৯০

কোথাও একটা থাকার জায়গা খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছে শ‍্যামলী। কলেজে প্রিন্সিপাল ম‍্যাম যেভাবে কথা বললেন, তাতে পরিষ্কার যে কেউ ওঁকে প্ররোচিত করেছেন। গড়িয়ে যেতে থাকা সন্ধ্যায় রমানাথদের বাড়ির ছাদে তারা দুজনে দুজনের সান্নিধ্য উপভোগ করেছে, এটা পল্লবিত করে কেউ প্রচার করে চলেছে। একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারী একান্তে কথা বলবেন, এটা বাঙালি সমাজে এখনো সহজ নয়। কো এড কলেজে ছেলে মেয়েরা একসাথে পড়ে ঠিকই। কিন্তু এখনো বহু অভিভাবক ওই কারণেই নিজের কন‍্যাসন্তানকে সহশিক্ষার পরিবেশে পাঠাতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে এই বছর ত্রিশ আগেও মেয়েরা অধ‍্যাপক মহাশয়ের পিছন পিছন ক্লাসে ঢুকত। আর ক্লাস শেষ হলে অধ‍্যাপকের সাথেই বেরিয়ে আসত। কাজী নজরুল ইসলাম না কি একজন ছাত্রীর সাথে গিয়ে আলাপ করার উপক্রম করেছিলেন বলে, তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনা ঘটালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এটা জানার পরেও কাজী এই কাজটি করেন। সদর দপ্তরে কামান দাগার আগ্রহ কাজীর ছিল।
 শ‍্যামলীর মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চার অধ‍্যায় উপন‍্যাসের কথা। সেখানে কলেজের পরিবেশে এলালতা দাশগুপ্তের ফরসা ছোটোখাটো চেহারা দেখে ছেলেরা দূর থেকে ছোটো এলাচ বলে ডেকে পালিয়ে যেত। অন‍্য একটা মেয়েকে তারা বলত বড় এলাচ। রবীন্দ্রনাথ  লিখেছেন সেই মেয়েটির আড়ে বহরে চেহারা ও গাত্রবর্ণের সাথে বড় এলাচের মিল পেত তারা।
 তারপর রবীন্দ্রনাথ এলার জবানিতে লিখেছেন ছেলেদের সাথে ব‍্যবহার করা খুবই সহজ, যদি তাদের মানুষ হিসেবে ভাবা যায়। চতুরঙ্গ উপন‍্যাসে লীলানন্দস্বামী চরিত্রটি খুব সাবধানে এঁকেছেন তিনি। যেটুকু বলেছেন, আভাসে ইঙ্গিতে বলার ব‍্যাপারটা মাথায় রেখেছেন। অবশ‍্য বুদ্ধিমান লোকের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন কালে তো ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী, রজনীশ, মহেশ যোগী ও সত‍্য সাইবাবাদের ব‍্যবসা সাম্রাজ‍্য পত্তন হয় নি, আর  অবাধ যৌনতার খেলাও শুরু হয় নি। তাহলে চতুরঙ্গ উপন‍্যাসের লীলানন্দস্বামী চরিত্রটি কি পুরোপুরি কপোলকল্পিত?
 জীবনানন্দ দাশের কবিতা মনে পড়ে। মানুষ কাউকে চায়, তার সেই নিহত উজ্জ্বল, ঈশ্বরের পরিবর্তে অন‍্য কোনো সাধনার ফল। বলেন, আরো আলো, মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়। আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, রমণীর মন, সহস্র বরষের সখা সাধনার ধন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সদ‍্যোতারুণ‍্যে লেখা কবিতাটা তার মুখস্থ। আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান, না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৈশোরের প্রেমের কথা মনে পড়লে অবাক লাগে। দেবেন ঠাকুরের ছোটছেলেকে বিলেতে পাঠিয়ে ব‍্যারিস্টার করে আনা হবে। তার আগে বিলিতি কায়দাকেতায় রপ্ত হ‌ওয়া চাই। সহজ শোভনভাবে মেয়েদের সাথে ব‍্যবহার করতে শেখা চাই। ঠাকুর পরিবারের বাইরে বাঙালি সমাজে তখন সহজভাবে মেলামেশার মেয়ে ক‌ই? বিবাহিত মেয়েরাই তখন দিনের বেলা নিজস্ব পুরুষের সান্নিধ্যে আসতে মনের ভিতর বাধা পায়। মেয়েদের পাঁচ জনের সামনে বেরোনোর পোশাক তখনো জবড়জং। এমন সময় বোম্বের ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরঙের মেয়ে আনা তড়খড়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল রবির। ভাবতে ভারি অবাক লাগে।  মিষ্টিও লাগে। আনা বোধ হয় রবির থেকে বয়সে সামান্য একটু বড়। আর রবি চেহারায় একটু বড়সড়। আনার খুব পছন্দ হয়েছিল রবিকে। হাতমোজার গল্পটা মনে পড়ে শ‍্যামলীর। আশ্চর্যের ব‍্যাপার এমন আধুনিক মন মেজাজের লোক হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন নিজের সব কয়টা মেয়ের বাল‍্যবিবাহ দিলেন? তাঁর মেয়েরা কি বাড়ির কোনো পুরুষের হাতে সমস্যায় জর্জরিত হতে পারে এই আতঙ্কে ভুগতেন কবি? তাই কি ঝামেলা চুকিয়ে দিতে বিয়ে? এই রবীন্দ্রনাথ যখন চার অধ‍্যায়ে বিয়ে জিনিসটাকে পাঁশতলা বা আস্তাকুঁড়ের সামিল করে বলেন, তখন ভাবনা হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেন, পিঠ চুলকে দেবার একটা লোকের জন‍্য মানুষ বিয়ে করে, তখন তার ভিতরকার কঠিন ব‍্যঙ্গটা টের পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সদ‍্যোতরুণী রাণু অধিকারীর সম্পর্ক লোকেরা সহজভাবে নিতে পারে নি। রাণুর বাবা মা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে বয়সে ছোটো। কবির সঙ্গে রাণুর বয়সের এতটা ফারাক, তবুও কত কথা উঠেছিল। রাণুর বিয়েতে দামি মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই করে নিজের সব কয়টা ব‌ই উপহার দিয়েছিলেন তিনি। তবু স্বয়ং গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি। পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক ছিল না।
বন্ধুত্ব যদি অপোজিট সেক্সের মানুষের মধ‍্যে হল তো বাঙালির সমাজ সেটাকে সহজ করে দেখতে পারে না। সম্পর্ককে শান্ত দাস‍্য সখ্য বাৎসল‍্য মধুর এই পাঁচ রকমে চিনিয়েছে ভারতীয় রসশাস্ত্র। অনসূয়া প্রিয়ংবদার সাথে তপোবনের দিনগুলো দারুণ এঁকেছেন কালিদাস। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ক‌ইত কথা শৌরসেনী হলা পিয় সহি… আর অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণের সখ‍্যতা। উদ্ধবের সাথে মাধবের সখ‍্যতা। আওয়ে উধো বেগর মধো… বন্ধুত্বের অধিকারে ভগবানের ঘাড়ে চাপছে ভক্ত। ভক্তের বোঝা ভগবান বয়। অনেক খুঁজে পেতে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর সঙ্গে নন্দপুরচন্দ্রের একটি সম্পর্ক খুঁজে পায় সে। সেই কোপনস্বভাব দুর্বাসা আর উগ্রবাদী দশহাজার শিষ‍্য অতিথি হবেন বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে। তখন দ্রৌপদীর কাতর প্রার্থনায় কৃষ্ণ তাঁর তাম্রস্থলীর কানায় লেগে থাকা শাকান্ন ভক্ষণ করে দারুণ একটা ম‍্যাজিক দেখালেন যে হ‍্যারি হুডিনিও ডাহা ফেল মেরে যাবেন। কিন্তু, সে জিনিস কি ঠিক বন্ধুত্ব হল?
 থানার ওসির সাথে হেসে কথা বলার সম্পর্ক নিয়ে যখন বাবার সামনেই আঁশটে ইঙ্গিত করেছিল অতনু, বাবা একটু হলেও আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু মা মানতে চান নি। আবার লোহাছাঁটের বড় কারবারী রামনারায়ণ মিশ্রকে বন্ধু বলাটা বাবা ভাল চোখে নিতে পারেন নি। এমনকি শ‍্যামলী যে অরিন্দম দাশগুপ্ত, প্রবাল সেন আর রমানাথ নন্দী, তিনজনের সাথেই সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্ব চাইছে, সেটাও বাবা খারাপ ভাবে নিচ্ছেন। চিঠি লেখা, একান্তে গল্প করা, দেখা করা, এগুলো বাবার চোখে বেলেল্লাপনা মাত্র। পিসিও বলত ঘি আর আগুনের কথা। তখনও পিসি ভাবতে শুরু করে নি। যা শুনত, তাই বলত। ভাবা প্র‍্যাকটিশ করত না। শ‍্যামলী ভাবে বাঙালির মেয়ের রজোদর্শন হলেই অরক্ষণীয়া হয়ে গেল। খোদ রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত নিজের কন‍্যাদের ক্ষেত্রে এই চক্কর থেকে বের হতে পারেন নি। বিদ‍্যাসাগর পেরেছেন? বঙ্কিমচন্দ্র? কেশব সেন তো সাংঘাতিক দ্বিচারিতা করে বসে ‌র‌ইলেন। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা হয়ে, বড় বড় কথা বলতে বলতেই যেই কুচবিহারের রাজাকে পাত্র পেলেন অমনি আদর্শ টাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে সুনীতি দেবীর বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।
সুভাষচন্দ্র বসু বিদেশে একা একা থাকতে থাকতে তাঁর টাইপিস্ট মেয়েটিকে যদি ভালবেসে থাকেন, যদি ভদ্রমহিলা অমন দাবিটি করেন, তাতে কিছু লোকের অত গা জ্বালার কি আছে রে বাপু! হাড়হাবাতে বাঙালি নিজের প্রিয় মানুষ গুলোকে শুকনো সন্ন‍্যাসী হিসেবে দেখতে চায়। লেনিনের কথাও মনে পড়ে শ‍্যামলীর । এক‌ই এলাকায় নির্বাসনদণ্ড ভোগ করছিলেন স্ক্রুপস্কায়া। মাঝে মধ্যে আসা যাওয়া, আলাপ সালাপ, ভাবের আদানপ্রদান হতে হতে দুই সতীর্থ একদিন ভাবলেন একসাথে থাকলেই তো হয়। ওঁদের মনেও হয় নি ফরম‍্যাল বিয়েটা করতে হয়। তার পরেও লেনিন যে কখনো আর কোনো মেয়েকে ভালবাসতে পারবেন না, এমন কঠোর বাঁধনে তো স্ক্রুপস্কায়া তাঁকে বাঁধেন নি। এঙ্গেলসও কেরানী একটা মেয়েকে ভালবেসে কারখানা শ্রমিকদের কাছের লোক হয়েছেন। তাকে নিয়ে দাম্পত্য সাজিয়েছেন। সে মারা গেলে তার বোনকেও উপযুক্ত বিবেচনায় স্নেহ ও ভালবাসা দিয়েছেন। কার্ল মার্কস তাঁর বিবাহিত স্ত্রী জেনি মার্কসের অসুস্থ থাকাকালীন নিজের বাড়ির সহায়িকাকে সন্তানবতী করেছেন। প্রথাগত বিয়ের ধার ধারেন নি। এঁরা কেউ শুকনো সন্ন‍্যাসী ছিলেন না।
যে দেশের মানুষ কোনো একসময় দৈব ব্রাহ্ম প্রাজাপত‍্য গান্ধর্ব, অতোরকম বিবাহপদ্ধতি ভাবতে পেরেছিল, আজ তারা এতখানি একমাত্রিক হয়ে গেল কেন?
পাণ্ডবদের প্রত‍্যেকে দ্রৌপদীকে ভোগ করতেন। সন্তান উৎপাদনও করেছেন। অথচ প্রত‍্যেকের ব‍্যক্তিগত স্ত্রী আলাদা আলাদা করে ছিল। অর্জুন তো বিয়ে করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সুভদ্রা, চিত্রাঙ্গদা, উলূপী.. অর্জুন একেরপর এক রমণীর পাণিগ্রহণ করেছেন। অভিমন‍্যু, বভ্রুবাহন এদের নামদুটো মনে পড়ছে ওর। ভীমের ব‍্যক্তিগত স্ত্রী ছিল হিড়িম্বাসুন্দরী। তার গর্ভে ঘটোৎকচকে উৎপাদন করেন ভীম। আর ধর্মপুত্রের ব‍্যক্তিগত স্ত্রী ছিলেন দেবিকা। একাধিক স্ত্রী গমনে যে দেশ আপত্তি করে নি, সেদেশের মানুষ অপোজিট সেক্সের একাধিক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভেটো দেবে কেন?
থানার ওসির চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে শ‍্যামলী বলল, আসবো?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।