ছোটগল্পে অমৃতা মুখার্জী

ডাইনী

আজ  শুনলাম মিস্টার ব্রুক (নাম পাল্টে দিলাম) আর নেই। তিনি ছিলেন আমার সবথেকে কঠিন রুগী।
প্রথম যেদিন আলাপ হল খুব ব্যঙ্গাত্মক ভাবে আমার লাস্টনেম উচ্চারণ  করলেন। আমাদের আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষটার উপর একটু ক্রীম চীজ দেওয়া আছে। ব্রিটেনের মত কাঁচা রুটির উপর সার্ভ করে না। রুটিটাও অল ইকুয়ালিটি দিয়ে টোস্ট  করা। কাজেই  গেলার সময় ভারি সুস্বাদু লাগে। লন্ডনের মত গলা জ্বালা করে না।
জিজ্ঞেস করলেন আমার ডাক্তারি ডিগ্রীটা আফগানিস্তান এর কিনা? আমার চুলে কি আমি গোবর লাগাই ? তাই কি এত কালো? আমি কবে দেশে ফিরে যাব? ভারতে কী এখন দাঙ্গা চলছে? কাশ্মীর কি সুইজারল্যান্ড এর চেয়ে সুন্দর?
আমি কথা বেশি না বলে হুঁ হাঁ করে সারলাম। ৩০বছর এদেশে থাকার পর এগুলো আর গায়ে মাখি না। সাধারন শাদা আমেরিকান দের জি কে আর আই কিউ দুটীই মাথায় রাখি। খুব  মায়া হয়। বেচারারা সোনার দেশে জন্মেছে, জীবন সংগ্রাম বলতে হাইস্কুল পাশ, খাবার বলতে বিস্বাদ স্টেক আর আলু। ওদের ওপর রাগ করে কি লাভ?
মিস্টার ব্রুক বললেন একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত। উনার কাশিটা টিবি কিনা সেটা আমি ঠিক বলতে পারব। ইন্ডীয়ার ডাক্তার আর কিছু নাহোক টিবি চিনবে। গরীব দেশ।
আমি চলে আসার সময় সান্ত্বণা দিয়ে বললাম টিবি গরীব  দেশের অসুখ হলেও তার অষুধ আছে। সেরে যায়। ধনী দেশের অসুখ গুলো ভারী বেয়াড়া।
টিনএজ প্রেগনান্সী সারানো মুশকিল।
উনি একটু থমকে গেলেন।
তারপর নানা ভাবে অনেক কটু কথা বলেছেন, বিদ্রূপ করেছেন। আমার নামে নালিশ ও করেছেন। কিন্তু রোগ বাড়লেই শিশুর মত অধীর হয়ে বার বার ফোন করতেন। নার্স ভেরোনিকা কে গালাগালে উচ্ছন্ন করতেন। গো টু হেল! অই ইন্ডী ডাক্তার কে ডাকো! অই ডাইনী জানে আমার অষুধ। বড্ড তেজ …র কিন্তু শারপ লাইক নাইফ।
মেজাজ  ভাল থাকলে  অনেক গল্প করতেন। বিশ্বযুদ্ধে পাইলট ছিলেন। ভিয়েতনামের বীভৎস  দিন গুলোর কথা, কিভাবে বিষাক্ত গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে সারা জীবনের মত পঙ্গু হয়ে গেলেন, খুব দু:খ করতেন। তিন বার বিয়ে করেছেন । বার বার ডিভোর্স । ছেলে মেয়েরা কেউ মানুষ হয়নি ।
আমার মা এত কস্ট করে আমাদের এত ভাল মানুষ করেছেন। চোখ দিয়ে জল পড়ত। মাই রেস্পেক্ট টু হার! গ্রেট লেডী।
তুমি তাকে আদরে রেখ। আমার মত যেন নার্সিং হোমে পচতে না হয়।
দেখ আমার সারা পিঠে ঘা হয়ে গেছে।
কেউ আসে না। নো বডি কেয়ারস ।
দেশে মাকে দেখতে যাব, পরের দিন প্লেন । খুব তাড়া।
ভেরোনিকা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল ডক্টর প্লীজ  কাম, উনার খিঁচুনি উঠছে , এপিলেপ্সি, স্বাস পড়ছে না। চীৎকার কোরলাম কোড Blue কল 911,  ঝাঁপিয়ে পড়লাম  সবাই মিলে। অক্সিজেন, চেক  গ্লুকোজ, হী ইজ ড্রাউনিং, প্রেসার ফলিং , মুভ ফাস্ট। লাফ দিয়ে ঊঠলাম বেড রেল ভেঙ্গে, ব্রীদ , ব্রীদ , হাপরের মত বুক উঠছে উনার। ভেরোনিকা কেঁদে উঠল, নো পালস ডক্টর, আমি নির্মম ভাবে জামা ছিঁড়ে ফেললাম, মুভ , স্টারটিং চেস্ট কম্প্রেশন নাউ, সি পি আর, পজিশন, Tilted হেড, 1,2,3,4,5,6 ,,,,উন্মাদের মত চেস্ট কম্প্রেশন , চীৎকার,,,,
মিস্টার ব্রুক টক টু মী,
নাথিং রং, ইউ আর ফাইন,
ফর গডস সেক, টক টু মী,
ইউ কান্ট স্টপ ব্রীদিং,
সাম বডি গিভ মি ব্যাগ ,
হুমড়ী খেয়ে মাউথ রিসাসিটেশন
গড ড্যাম ইট !
মিস্টার ব্রুক ওয়েক আপ। টক টু মী।
উন্মাদ ডাইনী ভারতীয় ডাক্তার, ব্জ্র কঠিন সি পি আর, কামড়ে ধরেছে যমের হাত, মৃত্যু  পিছিয়ে যাচ্ছে। হেরে যাচ্ছে, আধাঁরের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে, কহিতেছে শত বার যেতে দিব না রে।
হ্ঠাৎ চোখ মেললেন । থেমে গেল খিঁচুনি। থমকে গেলাম। উঠে বসলেন। ততক্ষনে ambulance এসে গেছে, emergency team is here, they took over. ভেরোনিকা জড়িয়ে ধরল। ডক্টর  ইউ ডীড ইট, হি ইজ আলাইভ, হি উইল বী ফাইন।
স্রোতের মত ঘাম পড়ছিল গা বেয়ে। হেসে বললাম আসলে উই ডীড ইট। গো টীম।
মিস্টার ব্রুক দুর্বল হাসছিলেন। বললেন এমনকী মৃত্যুও তোমার মত পাগলিদের ভয় পায়। ওরা ওকে নিয়ে গেল হাসপাতালে।
দু সপ্তাহ হল দেশ থেকে ফিরেছি।
মিস্টার ব্রুকের বিছানা  এত পরিপাটি?
ভেরোনিকা এসে কেঁদে ফেলল। He died after 4 days , after you left, he went peacefully. He told me to say thank you to you. He said he sorry ! কত অপমান  করেছেন তোমায়!
He said you are the best ডাইনী  ঈন্ডী এঞ্জেল উইথ স্টেথোস্কপে , একজন পাগল ডাক্তার যে মৃত্যু কে রুখে দিয়েছিল।
শেষ বিকেলে চ্যাপেলে এসে বসলাম। দূর সন্ধ্যার মেঘে ছোট একটা প্লেন ঊড়ে যাচ্ছিল। মিস্টার ব্রুক চলে যাচ্ছেন।
ভিয়েতনাম কে ভুলে গিয়ে নতুন শান্তির আকাশে।
There was no time to say goodbye.
But this I ask – please do not cry.
Remember me as you think best.
Remember the happy times, but forget the rest
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।