পর্ব – ২১৬
কি হয়েছে?
দরজার একটা দিকের পাল্লা খুলে সবিতা জিজ্ঞাসা করলেন।
সবিতা ঠাহর করল দোকানের মালিককে পুলিশের লোক ধরে এনেছে। ভিড়ের মধ্যে চেনামুখ অনসূয়া চ্যাটার্জিকে দেখতে পেয়ে সবিতা কাতরে উঠে বলল, দিদি, কি হয়েছে?
থানার মেজবাবু বললেন, শ্যামলী নামে একটা মেয়ে তোমার এখানে আছে।
সবিতা বলল, কেন, সে কি করেছে? সে যে বড্ড ভাল মেয়ে! কি করেছে সে? সবিতার গলা যেন বুজে আসছে ভয়ে।
শ্যামলীকে আমরা নিয়ে যাব। বড়বাবু জীপ থেকে নামতে নামতে বললেন।
সবিতা বলল, চোর নয়, ছ্যাঁচড় নয়, ধরে নিয়ে যাবেন কেন?
অনসূয়া চ্যাটার্জি হস্তক্ষেপ করলেন। ওসি সাহেব, ও ভয় পেয়ে গেছে। আমি বুঝিয়ে বলছি। শোনো গো মেয়ে, শ্যামলীকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কাল কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তোমার এখানে আছে না কি?
সবিতা বলল, আমি তার মায়ের মতো। মা-ই এক রকম। ও আমার কাছে থাকবে বলে এসেছে।
অরিন্দম দাশগুপ্ত পিছন থেকে সামনে এগিয়ে এসে বললেন, তুমি যে তাকে ভালবাসো, সে আমি জানি। কিন্তু এ জায়গায় তো অমন মেয়ে থাকতে পারে না। ওকে আমরা নিয়ে যাব।
শ্যামলী পিসির পিছনদিক থেকে বেরিয়ে এসে বলল, বড়বাবু, আমি সাবালক মেয়ে। নিজের ইচ্ছায় নিজের পছন্দ মতো জায়গায় থাকার আইনি অধিকার আমার আছে।
বড়বাবু অনসূয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আপনার বোনকে খুঁজে দিয়েছি। এবার উনি মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন তুলছেন। আইনি সওয়াল আপনিই করুন।
শ্যামলী বলল, যেখানে আমি আগে আশ্রিত হিসেবে ছিলাম, সেখানে নানা কারণে আর থাকা যাচ্ছে না। এখানে আমি থাকব, খেটেখুটে নিজের অন্নসংস্থানের চেষ্টা করব।
দোকানের মালিক ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, কে তুমি, চিনি না, শুনি না, সাতজন্মে সম্পর্ক নেই, আমার দোকানে থাকবে বললেই হল?
সবিতা রুখে উঠে বলল, তুমি চেনো না, শোনো না, তাতে কি? আমি তো বলছি, আমি ওর মায়ের মতো। আমার কাছ থেকে কেউ ওকে কেড়ে নিয়ে যাক্ দেখি?
দোকানদার খেপে উঠে বলল, দোকান আমার। আমি ঠিক করব, কে থাকবে আর কে না থাকবে!
সবিতা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, বললাম যে, আমার মেয়ে বলেই মনে করি। মা যেখানে থাকবে, বাছাও সেখানেই থাকবে। যদি ওকে থাকতে না দাও, এই রইল তোমার কারবার। আমি আজই যে দিকে দুচোখ যায়, চলে যাব। দোকানদার আমতা আমতা করে বলল, তোমাকে তো আমি চলে যেতে বলি নি। ওকেও বলতাম না। কিন্তু এত থানা পুলিশের ঝামেলায় আমি জড়াই কেন?
অনসূয়া এগিয়ে এসে শ্যামলীকে বললেন, শোন্, তোকে পড়াশুনাটা করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এত চমৎকার একটা কেরিয়ার বোকামি করে শেষ করে দিস্ না। তুই আমার সঙ্গে চ। সবিতার দিকে তাকিয়ে অনসূয়া বললেন, কই গো, তুমিও চলো। তুমি কাছে থাকলে মেয়েটার ভাল লাগবে।
শ্যামলী বলল, আমি যাব না দিদি, এইখানে গাছতলায় বসে থাকব।
অনসূয়া বললেন, ইয়ার্কি পেয়েছ না? গাছতলায় বসে থাকব! এই যে এতদিন ধরে স্কলারশিপ বাবদে টাকা নিয়েছিস, সে টাকা দেশের মানুষের করের টাকা। কলেজের মাইনে তোরা কতটুকু দিস? ওইটাকায় কলেজের টিচারের মাইনে, লাইব্রেরির বই কেনা, ইলেকট্রিক বিল, সব ওঠে বুঝি? সরকার কে টাকা গুঁজতে হয় না? শুনে রাখ্, হদ্দ গরিব চাষাটা জোলাটা পর্যন্ত জমির খাজনা দেবার সময় তার ওপর সেস দিতে বাধ্য হয়। তোরা পড়ছিস গরিব মানুষের সেসের টাকায়। যে হতভাগা কোনো দিন ইশকুলে যায়নি, সেও ওই স্কুল কলেজের খরচ যোগায়। আর তুমি বলছ গাছতলায় থাকব? গাছতলায় পড়াশুনা হয়? চল্ বলছি আমার সঙ্গে!
বড়বাবু হেসে বললেন, শ্যামলী পাল এবার শক্ত হাতে পড়েছেন।
অরিন্দম দাশগুপ্ত বললেন, শোনো শ্যামলী, তুমি পড়াশুনায় এই জেলার গর্ব। তোমাকে আমরা এভাবে ফুরিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমাদের মনুষ্যত্বে বাধে।
শ্যামলী শক্ত হয়ে বলল, আমি কোথাও গলগ্রহ হয়ে থাকতে পারব না। সেটাও আমার মনুষ্যত্বে বাধবে।
অনসূয়া বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আগে চ দেখি। গাড়িতে ওঠ্।
দোকানের মালিক সব কাণ্ড দেখে নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। অনসূয়া চ্যাটার্জিকে সে চেনে এই কোর্টের ব্যস্ত উকিল হিসেবে। তাঁর বাবাকেও সে দেখেছে অনেক আগে। এই এলাকার বনেদি পরিবার। অরিন্দম দাশগুপ্ত ও তাই। এমন দুজন মান্যগণ্য লোক কেন শ্যামলী নামে মেয়েটাকে নিজেদের গাড়িতে করে নিয়ে যেতে চাইছেন সে বুঝে উঠতে পারছে না। থানার বড়বাবু পর্যন্ত ওঁদের সম্ভ্রম করে কথা বলছেন।
অনসূয়া সবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো গো, তুমিও চলো।
দোকান মালিক সবিতাকে মিনতি করে বলল, রাগের মাথায় ভুল করে কি বলেছি না বলেছি, তাতেই তুমি চলে যাবে?
শ্যামলী অনসূয়াকে বলল, দিদি, পিসি এখন এখানে থাকুক। সবিতাও নরম হয়ে তাকাল দোকান মালিকের দিকে। বড়বাবু মেজবাবুকে বললেন, আপনি পালেদের বাড়ি থেকে শ্যামলীর পারসোনাল জিনিস যা কিছু আছে, কালেক্ট করে, ম্যাডামের বাড়িতে পৌঁছে দেবেন।
শ্যামলীকে নিয়ে অনসূয়ার গাড়ি ছুটে চলল।
হোটেলের উনুনে আঁচ দিতে দিতে ধোঁয়ার আড়ালে একটা মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়তে দেখে দোকানের মালিক যথাসাধ্য নরম স্বরে বলল, আমি আর কোনোদিন তোমাকে দুঃখ দেবো না। তুমি কেঁদো না।
সবিতা আঁচলে মুখ ঢেকে বলল, কে বলেছে আমি কাঁদছি?
তার উথলে ওঠা কান্না দেখে দোকান মালিক চুপ করে রইল।
ক্রমশ…