অণুগল্পে মিঠুন মুখার্জী

উত্তর 24 পরগনা জেলার গোবরডাঙাতে নিবাস। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম মাস্টার ডিগ্রি এবং পরবর্তীতে নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে সেকেন্ড বার বাংলায় মাস্টার ডিগ্রি।লেখালেখি, গান শোনা এবং গান করা পছন্দ করি। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত ও আধুনিক। নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটির বেঙ্গল পার্টিশন বিষয়ক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছি ।বাড়িতে প্রাইভেট পড়ানো হয় ,সঙ্গে একটি এনজিওতে সমাজসেবামূলক কাজ কর্মের সঙ্গে যুক্ত আছি। বাস্তব সমস্যাকে লেখার মধ্যে বেশি ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করি। আনন্দলোক পত্রিকায় দশটার অধিক ক্যাপশন প্রকাশিত হয়েছে।

মানবিক মুখ

তখন সকাল আটটা বাজে, রাজদীপ হঠাৎ চিৎকার করে উঠে বললো–” আমি পেরেছি, দীর্ঘদিনের পরিশ্রম সফল হল আমার। মানুষ পারেনা এমন কিছু নেই।” রাজদীপের চিৎকার শুনে তার বাবা- মা বোন যে যার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মা জিজ্ঞাসা করে–‘কি হয়েছে রাজ, এমন চিৎকার করলি কেন?’ সবার চোখে বিস্ময়।সকলকে রাজ জানায়, তার দীর্ঘদিনের গবেষণায় সে সফল হয়েছে, সে এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যা স্পর্শ করলে শরীরের কোন কোন অঙ্গ দুর্বল বা খারাপ হতে চলেছে তার পূর্বাভাস দেয়। তার কথাটা কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি সেই মুহূর্তে । রাজের বোন সৃষ্টি বলে–ও এই ব্যাপার, আমরা তো ভাবলাম কোনো বিপদ হয়েছে।যে যার মত ঘরে চলে যায়।রাজদীপ তার এই আবিষ্কারে কারো উৎসাহ না দেখে একটু কষ্ট পায়। সৃষ্টি করার আনন্দ সেই মুহূর্তে মাটি হয়ে যায়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র রাজদীপ চক্রবর্তী,বর্তমানে গবেষণায় রত ।পড়াশোনা ও গবেষণার বিষয় ছাড়া কিছুই বোঝে না।কলেজ জীবনে অনেকেই তাঁকে প্রেম নিবেদন করলেও সে তার লক্ষ্যে অটুট।সে অনেককেই বলেছে–“আমার জন্য ও সব নয়,প্রেমে পড়া আমার হবে না”।কিন্তু ভাগ্যের চাকা কার কোথায় গিয়ে থামে কেউ বলতে পারে না। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান রাজদীপ হঠাৎ একটা গরীব, নম্র,সুন্দরী ,অসহায় মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়।ঋতুজা ঘোষাল নামের এই মেয়েটি তার বোন সৃষ্টির পরিচিতা। যার এ দুনিয়ায় নিজের বলতে কেউ নেই। মামা ও মামীর কাছে মানুষ। তারাও দু’বছর হয়েছে একটি ভয়ানক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সৃষ্টির গানের শিক্ষিকার দুই মেয়েকে দেখাশুনা করে ঋতুজা।গান শিখতে গিয়ে সৃষ্টির ঋতুজার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। মামার সহায়তায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আর পড়তে পারে নি।
রাজদীপ একদিন বোনকে আনতে গিয়ে ঋতুজাকে দেখে ছিল। সেই এক পলকে একটু দেখাতে পছন্দ হয়েছিল রাজদীপের ঋতুজাকে। যে রাজদীপ অনেক বিত্তশালী মেয়ের প্রেমপ্রস্তাবকে গুরুত্ব দেয় নি,তার জীবনে যে এমন ঘটবে সে নিজেও জানত না।একেই বলে জীবন।
আমি রমজান, আমার বাল্যবন্ধু রাজদীপ।পঞ্চম শ্রেণি থেকে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি।আমি মুসলিম বলে রাজদীপ কোনদিন ঘৃণা করেনি।কলেজ জীবন থেকে আমরা আলাদা হয়ে যাই।তবু বন্ধুত্বের টান এখনও অনুভব করি। তাই সময় পেলেই চলে যাই রাজদীপের বাড়িতে।আমি বর্তমানে বাংলায় এম.ফিল করছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।রাজদীপ আমাকে রাহু বলে ডাকতো।কারণ, আমি খেতে খুব ভালোবাসি।আমি ওকে রাজ বলতাম ।সেদিন রাজের বোনের জন্মদিন উপলক্ষে আমি নিমন্ত্রিত ছিলাম। আমাকে ঋতুজার কথা সেদিনই প্রথম জানায় রাজ। প্রথমে আমি অবাক হয়েছিলাম।কারণ, রাজ প্রেমে পরতে পারে আমার বিশ্বাস হয়নি।তবুও ভালো লাগলো কথাগুলি শুনে।আমি বিশ্বাস করি,প্রেম মানুষকে বদলে দিতে পারে।
রাজদীপ ঋতুজাকে ভালোলাগার কথাটি প্রথমে বাড়িতে তার বোনকে ও বোনের মাধ্যমে বাবা মাকে জানায়। বোন সৃষ্টির মুখে ঋতুজার সম্পর্কে জেনে রাজদীপের সঙ্গে ঋতুজার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় রাজের বাবা- মা। গানের শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে সমস্ত বিষয়টি জানতে পারে ঋতুজা। কিন্তু ঋতুজা প্রথমে ধনী পরিবারে বিয়েতে ভয় পেলেও পরে গানের শিক্ষিকার কাছে অভয় পেয়ে ও রাজের পরিবার সম্পর্কে জেনে বিয়েতে মত দেয়। অল্পদিনের মধ্যে রাজদীপের সঙ্গে ঋতুজার শুভ পরিণয় অনুষ্ঠিত হয়।
বিয়ের এক মাসের মধ্যে দুজন দুজনকে কিছুটা বুঝে নেয়। এই এক মাসের একটি দিনও রাজদীপ ঋতুজার মনোবাসনা পূরণ করে নি।সে তার গবেষণা ও পড়াশোনা নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত থাকত।ফলে তিনকুলে কেউ না থাকলেও রাজদীপের এই আচরণ মেনে নিতে পারে না সে ।অল্প দিনের মধ্যে সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছে যায়, ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের।প্রথম প্রথম ঋতুজার কষ্ট হলেও,সে সবকিছু মানিয়ে নেয়। সে প্রতিজ্ঞা করে কোন কিছুর বিনিময়ে সে আর রাজদীপের কাছে ফিরে আসবে না। রাজদীপও গবেষণার কাজে ফাঁকি না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
পাঁচ বছর পর একদিন রাজদীপের সঙ্গে আমার দেখা হয় শিক্ষকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায়।বর্তমানে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক।আমি রাজের কাছে জানতে পারি ,সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপনা করে গত দুই বছর। গত পাঁচ বছর কর্মব্যস্ততায় রাজের বাড়ীতে আমার যাওয়া হয় নি। তাই ওর সাফল্যের কথা শুনে আনন্দ পেয়েছিলাম।এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে ।রাজদীপ আর বিবাহ করেনি,আমার বিয়ে হয়েছে তিন বছর,একটি মেয়ের হয়েছে দু বছর বয়স। মেয়ের জন্মদিনে রাজকে নিমন্ত্রণ করলাম।রাজ জানায় সে চেষ্টা করবে।
জন্মদিনে আমাদের বাড়ি আসার পর রাজদীপ আমার স্ত্রীকে দেখে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেই মুহূর্তে চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অনেক অনুরোধ করে আমি ওকে আটকাই।আমি বুঝতে পারি ঋতুজাকে দেখেই রাজদীপের এমন ভাব ভঙ্গি।আমি রাজকে জানাই,আমি ঋতুজাকে বাঁচানোর জন্য বিবাহ করি।এছাড়া আমার কাছে কোন পথ ছিল না। তোর সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর কোন দিশা না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল ঋতুজা।সেই সময় আমি কলেজ থেকে ফিরছি।প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি, বাঁচানোর পর দেখি ঋতুজা। ওর কাছে সবকিছু শুনে, জাতের পরোয়া না করে ওকে আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। আমার জাতের মানুষ ওকে আর আমাকে প্রতিদিন নানান গালিগালাজ করতো।একদিন তো আমাদের মারার জন্য একশর বেশি মুসলিম লাঠি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিল। বাধ্য হয়ে লোকচক্ষু থেকে বাঁচাতে আমি ঋতুজাকে বিয়ে করি।এখনও খুব একটা শান্তিতে আমরা নেই।আমার কথা শুনে রাজের চোখের কোনে জল দেখা যায়।সে শুধু আমাকে বলে–‘বেশ করেছিস’। অনেক বললেও না খেয়ে চলে যায় রাজদীপ।
এই ঘটনার দুমাস পরে একদিন আমার মেয়েকে নিয়ে রাজের বাড়ি যাই । রাজদীপকে না পেয়ে কাকু-কাকিমাকে তার কথা জিজ্ঞাসা করতেই সৃষ্টি জানায়– দাদা গুরুতর অসুস্থ। কলকাতার ড্রীমল্যান্ড নার্সিংহোমে তিনদিন ধরে ভর্তি। আজ বিকেলে আমরা দেখতে যাব। সেই যে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল,তারপর থেকেই ওর শরীরটা ভাল ছিলনা। মাঝে মাঝে ভুল বকত । বলতো–“আমি অবিচার করেছি। আমার বাঁচার অধিকার নেই।আমি পাগল হয়ে যাব।”ঋতুজা বৌদি ভাইয়ের নাম ধরে চিৎকার করত আর কাঁদত।আবার কখনো বলতো–” আমি ভুল করেছি।অসহায় মেয়েটির প্রতি অন্যায় করেছি। ওকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল”। দাদা ওর আবিষ্কৃত যন্ত্রটা স্পর্শ করে জানতে পারে, দুরারোগ্য ব্যাধি শরীরে বাসা বেঁধেছে ওর।জানিনা ভগবানের কি ইচ্ছা।সৃষ্টির কথা শুনে নিজেকে দোষী মনে হয়েছিল রাজের এই অবস্থার জন্য।আল্লাহর কাছে দোয়া করি তাড়াতাড়ি রাজ সুস্থ হয়ে উঠুক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।