দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৬০)

পর্ব – ১৬০

সবিতা শশাঙ্ক পালের কাছে এসে বললেন, দাদা, বাপের বাড়ির দেশে আজ আমি যাচ্ছি না।
শশাঙ্ক কিছু বললেন না, শুধু জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। বাসন্তীবালা বললেন, যাক্ বাবা, তোর তবু সুমতি হয়েছে। কে আছে তোর সেখেনে, কিসের টানে যাবি?
বাসন্তীবালার কথাকে কিছু মাত্র পাত্তা না দিয়ে শশাঙ্কের দিকে তাকিয়ে সবিতা বলল, দাদা, ভেবে দেখলাম তোমার কথাটাই ঠিক।
বাসন্তীবালা বললেন, তোর দাদা তো সারা দিনে হাজার রকম কথা বলে। তারমধ‍্যে কোন্ কথাটার কথা তুই বলছিস?
বাসন্তীবালার দিকে ঠাণ্ডা চোখে একবার তাকিয়ে নিয়েই শশাঙ্কের দিকে চেয়ে সবিতা বললেন, ওই যে বাবার স্বপ্ন দেখেছিলাম, ওসব ভুলভাল। তুমি বলেছিলে না, মরে যাবার পর মানুষের আর কিচ্ছুটি থাকে না, বেশ টের পেলাম, সে কথাটা একদম সত‍্যি।
শশাঙ্ক বললেন, না রে, মন যখন চেয়েছে, একটিবার ঘুরেই আয়। গ্রামের পাঁচজনের খবরাখবরি তো জেনে আসতে পারবি।
বাসন্তীবালা স্বামীকে বললেন, তুমি আর ওর মাথার পোকা নড়িও না তো। বলে, কত সৌভাগ্য আমার যে, যাবে না বলছে। তাকে আবার তুমি নাচাচ্ছ, যা, গিয়ে কে কেমন আছে, দেখে আয়।
বাসন্তীবালা রেগে উঠে বললেন , ও গেলে ছিষ্টির সংসার টানবে কে? ছোটো খোকা, বড়খোকা মুহুর্মুহু ফরমাশ করছে, পিসি, এটা খাব, সেটা খাব, এক গেলাস জলটা পজ্জন্ত গড়িয়ে খায় না। বিছানার চাদরটা অবধি গুছোতে পারেনা। এলোর দড়ি বেলোর দড়ি করে রাখে। দুবেলা ঘুরে আসার আগে কাচা ইস্ত্রি করা জামা প‍্যান্ট পরে বেরোনো চাই। রাজপুত্তুর সেজে না বেরোলে তেনাদের পেসটিজ যায়। এদিকে সেগুলো সাবানজলে ভিজিয়ে দিয়েও উবগারটুকু করে না।
সবিতা আছে তাই চলছে। বলি, সংসারের খবর রাখো কিছু?
শশাঙ্ক শান্ত স্বরে বললেন, তা তুমিও তো সারাক্ষণ ঠাকুর ঠুকুর না করে ওকে একটু হেল্প করতে পার।
বাসন্তীবালা বললেন, আমার যে বাতের ব‍্যথা তুমি সেটা জান? বসলে উঠতে পারি না, আবার উঠলে বসতে পারি না। অনেক দিন গাধার মতো তোমাদের সংসার টেনেছি। এখন আমার শরীর জবাব দিয়েছে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তা শরীর খারাপ হয়ে থাকলে ডাক্তার দেখালেই পার।
বাসন্তীবালা ঝাঁজিয়ে উঠে বললেন, দেখাব দেখাব। একদম পাকা ডাক্তার দেখাব। আর যেন ফিরে আসতে না হয়, তেমন ডাক্তারই দেখাব।
সবিতা শান্ত স্বরে বলল, কাল রাতে কত কেঁদে কেঁদে বাবাকে বললাম, ও বাবা, আর যে সহ‍্য করতে পারছি না, আমায় কাছে টেনে নাও, সব জ্বালা জুড়োক। বাবা কোনো কথাই বলে না। তারপরে তাঁকে কত করে ডাকলাম। কোথাও যদি থাকেন, দয়া করে চরণে ঠাঁই দেন। ক‌ই, টুঁ শব্দটি করেন না। শেষে মনে হল, ধুর, ফালতু ফালতু ডাকছি। মরে গেছে, তারপর আমার কপালে পুরো সিঁদুর কৌটোটা উলটে দিয়েছে, তারপর ঘাটে নিয়ে গিয়ে পাথর ঠুকে শাঁখা ভেঙে দিল। বলতে গেলাম, তিনি নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন, এ জিনিস দুটো স্মৃতি হিসেবে কাছে রাখতে দাও। গলা দিয়ে স্বর বের হতে চায় নি সেদিন। তখনো তো শরীর ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারেননি তিনি। কাছেই ঘুরঘুর করছেন, তবুও একবারটি তিনি বলেন নি, আহা, থাক না, দুটো শাঁখা তো মোটে, নাই বা ভাঙলে!
বাসন্তীবালা বললেন, বেশি ভ‍্যাজরম ভ‍্যাজরম করিস না তো। আসল কথাটা কি বলবি বল্?
সবিতা অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে শশাঙ্ককে বললেন, একটা বিধবা মেয়ে মনের কথাটা বলে হালকা হয়, এটা পর্যন্ত কেউ চায় না। সেই গাধার গল্প বলেছিল তোমাদের মেয়ে। সেই গাধাটাকে এ একবার বিক্রি করে দেয়, ও আরেকবার বিক্রি করে দেয়। কেউ যেন সত‍্যি সত্যি ভালবাসেনা। শেষকালে মরল, তবে শান্তি।
শ‍্যামলী মাথা নিচু করে রেখেই বলল, বালথাজার এর গল্প।
শশাঙ্ক হেসে বললেন, তোকেও ও বলেছে ওইসব বিদঘুটে গল্প?
সবিতা বললেন, শোনো দাদা, তোমার টাকা আমার কাছে গচ্ছিত ছিল। এই নাও সব পয়সা ফেরত নাও। শশাঙ্কর খাটের উপর একটা বড় রুমাল পেতে একটা বটুয়া থেকে অনেকগুলো খুচরো পয়সা ঢাললেন সবিতা। আমার সব গোণা গাঁথা আছে। কুড়ি পয়সা কম পৌনে তিনশ টাকা আছে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, এত খুচরো পয়সা কোথায় পেলি রে সবিতা?
বাসন্তীবালা বললেন, ওই তো ও বাজার করতে যেত। ফিরে এসে আমায় পয়সা বুঝিয়ে দিতে এলে, আমি নোটগুলো তুলে নিয়ে, খুচরো পয়সাগুলো ওকে রেখে দিতে বলতাম। দরকার অদরকারে ও ওর ওই ভাণ্ডার থেকে খরচ সামলে দিত। সেদিন রমানাথ শ্রাদ্ধের কথা বলতে এল, ওর সাথে তুমি কথা বলে যাচ্ছ। ওর সামনে তোমার কাছে টাকা চাওয়া যাচ্ছে না। তখন মুঠোখানিক পয়সা আঁচলে বেঁধে ও ছুটল ফলের দোকানে। আমি হলে পারতাম কতকগুলো  দশ পাঁচ পয়সা দিয়ে জিনিস কিনতে? ও ওসব পারে।
সবিতা বললেন, দাদা, অনেক সামলে সুমলে এখানে সেখানে ঘু্রিয়ে ঘুরিয়ে পয়সা কটা বাঁচিয়ে রেখেছি। এবার তুমি নিজের কাছে রাখো।
বাসন্তীবালা বললেন, কিছু পয়সা নিচে রেখে দিগে যা না। এই পয়সাকটা না হলে কি আমাদের চলছে না?
তাঁর কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে  সবিতা বলল, গুণে রাখো দাদা, পয়সা কড়ি গুণে নিতে হয়।
শশাঙ্ক পাল বললেন, সেটা বাইরের লোকের কাছে। আমি তোকে জানি। একটা পয়সার এদিক ওদিক হয়নি।
এমন সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অতনু বলল, পিসি, চা দিবি না?
অন‍্যদিনে অতনু কিছু বলা মাত্র সবিতা কোমরে আঁচল জড়িয়ে নিচে দৌড়োতেন। আজ ওঠার বিন্দুমাত্র লক্ষণ না দেখিয়ে বললেন, ছোটোখোকা, রান্নাঘরে গিয়ে দ‍্যাখো, তোমাদের দু ভাইয়ের চা ঢাকা দেওয়া আছে। আমি ডেকেছিলাম। তখন তোমরা ওঠো নি।
অতনু ঝাঁজিয়ে উঠে বলল, সে চা কখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শীতের দিনে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয় জানিস না?
সবিতা বললেন, দাদার সাথে দরকারি কথা বলছি। এখন যেতে পারছি না।
অতনু বলল, তুই উঠে আসবি, নাকি ঘাড়ে একটা রদ্দা মারব?
অমনি শশাঙ্ক পাল রেগে উঠলেন। শাট্ আপ শূয়ার। রদ্দা মেরে দ‍্যাখ একবার, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোকে অ্যারেস্ট করিয়ে দেব। যা নিচে যা। সময় মতো উঠবি না, আবার বড় বড় কথা?
বাসন্তীবালা অতনুর হয়ে সাফাই গাইতে চাইলেন। অতো বড়ো ছেলে সারাক্ষণ সবিতাকে তুই মুই করে কথা বলে। কতবার সবিতাকে বলেছি, শাসন কর্, শাসন কর্। তো কে শোনে কার কথা। সবিতা বলতো, আমাদের গাঁ ঘরে ছেলেরা মাকে তুই করেই কথা বলে। হ‍্যাঁ রে, ছোটোলোকের ঘরে যা চলে, একটা মানী লোকের বাড়িতে কি তা চলা উচিত?
শশাঙ্ক স্ত্রীকে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, তোমার ফালতু কথা তুমি থামাবে? মানী লোক কাকে বলে, তুমি তা জানো? যার ছেলেরা কুটুমবাড়ি গিয়ে পয়সা চুরি করে নেশা করে আসে, যার ছেলেরা ঠাকুরের সিংহাসন নড়িয়ে টাকা চুরি করে খারাপ পাড়ায় জুয়ো খেলতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তাকে আর যাই হোক মানী লোক বলে না।
বাসন্তীবালা পাল্টা ঝাঁজিয়ে উঠে বললেন, ছেলেমানুষ  একটা ভুল করে ফেলেছে বলে, তুমি কি নিত‍্যি দিন এইভাবে দাঁত দিয়ে পিষবে? বাপ হয়ে তুমি যদি এভাবে শত্রুতা করো তো, বাইরের শত্রুকে ঠেকাবো কি করে?
শশাঙ্ক ছাড়বেন কেন? তিনি বললেন, যেমন মা তেমনি ছাঁ। যখনই বাঁদরদুটোকে শাসন করতে চেয়েছি, তুমি, এই তুমিই সবসময় আপত্তি করেছ। এখন ঠেলা সামলাও!
সবিতা বললেন, দাদা, তোমাদের স্বামী স্ত্রীর গল্প দু মিনিট পর কোরো, বলে তিনি হঠাৎ উঠে এসে শশাঙ্কের পায়ের কাছে মাথা রেখে প্রণাম করলেন। দাদা, অনেক আদর দিয়েছ এই বোনটাকে। নিজের দাদা কোনো দিন দ‍্যাখে নি, তুমি সেই অভাব মিটিয়ে দিয়েছ। কিন্তু আজ বিদায় দাও।
শশাঙ্ক পাল বিরক্ত হয়ে বললেন, এই বললি যাব না, আবার এই বলছিস বিদায় দাও, এই সব হেঁয়ালির মানে কি?
সবিতা শান্ত স্বরে বললেন, হেঁয়ালি করি নি দাদা। বলেছি দেশের বাড়িতে যাব না। কিন্তু এবাড়িতে থাকার পাট আমার চুকেছে। এতদিন ধরে আদর করে থাকতে দিয়েছ, সে কথা আমি ভুলব না। ক’দিন থেকেই মনে হচ্ছিল, এই দেবতা, মুনি ঋষি, সাধু সন্নিসী, এগুলো সব এক একটা লুটে খাওয়া পার্টি। সব কটা নিজেদের যেটায় সুবিধে হয়, সেটাকে ধর্ম নাম দিয়ে বোকাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। বেওয়া মেয়েমানুষ, ভুগে মরেছি নির্বোধের মতো। বিধবা বলে কেউ মানুষ বলে মনেই করে নি। শ‍্যামলী যখন শরৎচন্দ্রের পল্লী সমাজের গল্প বলছিল, তখন মনে হয়েছে, বিধবারা এদেশে কি বিচ্ছিরি ভাবে নিজেকে ঠকায়!  তোমাদের মেয়ের কথায় আমার চোখ খুলে গেছে। চোখ খুলল তো পায়ের শেকল কাটল। আর আমার কোনো পিছুটান নেই। আমি পাঁচজনের চোখে নিজের দামটা যাচাই করে নিয়েছি। এবার আমাকে নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নিতে হবে। গলায় আঁচল জড়িয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে সবিতা বললেন  আজ আমায় বিদায় দাও দাদা। আমি নিজের জায়গাটা গড়ে নিতে চাই।
শশাঙ্ক বেদনাহত মুখে সবিতার দিকে তাকিয়ে র‌ইলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।