দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৩৮)

পর্ব – ২৩৮

এই অনু, ডাক্তার ডাক্তার খেলবি?
অনসূয়া, দশ বছরের বালিকা, বলল, সে আবার কেমন খেলা?
দাঁড়া, বলে চট করে জ‍্যাঠামশায়ের একটা পুরোনো কোট আলনা থেকে টেনে নিয়ে পরে ফেলে খোকা। বালকের পাখির মতো শরীরে ঢলঢল করছে পূর্ণবয়স্ক জ‍্যাঠামশায়ের কোট। জ‍্যাঠামশায়ের টেবিল থেকে বাড়তি একটা স্টেথোস্কোপ নিয়ে কানে গুঁজেছে বালক।
অনু বলছে, তোকে যে সত‍্যি সত‍্যিই ডাক্তারবাবু মনে হচ্ছে রে!
খোকা গম্ভীর হয়ে বলল, অ্যানাটমি ফিজিওলজি সব শিখে ফেলেছি। কদিন বাদে সার্জারিও শিখে ফেলব।
অনু বিশ্বাস করে না। ধ‍্যুৎ তেরি, তাই হয় না কি?
দেখবি তবে? নিজের বুকে স্টেথোস্কোপ ঠেকিয়ে অনুকে শোনায় খোকা। বলে, দুপ দুপ করে শব্দ শুনছিস?
অনু অবাক হয়ে বলে, এযে হাতুড়ি পিটছে মনে হচ্ছে!
হুম, একে বলে লাবডুব। হৃৎপিণ্ড পাম্প করছে। বড়দের জন‍্য মিনিটে বাহাত্তর বার। ছোটদের আরো বেশি।
অনু অবাক। হ‍্যাঁ রে, আমারও হৃৎপিণ্ড আছে?
খোকা বলে, আচ্ছা, দেখছি। জামা খোল্।
অনু বলে, জামা খুলতে হবে কেন?
খোল্ না, ডাক্তার ডাক্তার খেলার ওই নিয়ম।
ধ‍্যুস। জামা আমি খুলব না।
খুলিস না। এই তুই ভালবাসিস আমাকে? জামা না খুললে ফুল বডি চেক আপ করব কিভাবে?
জ‍্যাঠামশায়ের রোগী দেখার চেম্বারে কোণের দিকে রোগীকে শোয়ানোর বিছানা। তাকে ঘিরে পর্দা। পর্দা টেনে দেয় খোকা।
একটু ইতস্ততঃ করে জামাটা খুলে ফেলে বালিকা। ন‌ইলে প্রাণের বন্ধু অভিমান করছে। বালিকার বুকে বেলকুঁড়ি। করতলে আড়াল করে সে।
প‍্যান্টটাও খুলে ফেল্।
চোখ বন্ধ করে জন্মমুহূর্তের পোশাকে দাঁড়ায় মেয়ে।
আদমের পাঁজরের হাড় থেকে মেয়েদের জন্ম। এই দ‍্যাখ, বারো জোড়া পাঁজরের হাড়। বুকের মধ‍্যরেখায় তর্জনী ছোঁয়ায় খোকা। একে বলে স্টারনাম। এবার উপুড় হয়ে শো। বালিকার মেরুদণ্ডে হাত রাখে খোকা। এই হল স্পাইন। শিরদাঁড়া। তেত্রিশটা হাড় বেঁধে ছেঁদে প্রকৃতি শিরদাঁড়া বানিয়েছেন। এই হাড়গুলোকে ভার্টিব্রা বলে। এরমধ্যে চব্বিশটা হাড় আলাদা আলাদা। আর নখানা জড়িয়ে মড়িয়ে আছে। ঘাড়ের কাছে স্পাইনের একেবারে ওপরের অংশকে বলে সার্ভিক‍্যাল কার্ভ। এখানে সাতটা হাড়। বুককে বলে থোরাক্স। তাই বুকের জায়গাটার নাম থোরাসিক কার্ভ। এখানে বারোটা হাড়। এর নিচে লাম্বার কার্ভ। এখানে পাঁচটা হাড়। তাহলে সাত প্লাস বারো প্লাস পাঁচ, এই চব্বিশটা আলাদা আলাদা হাড়ের হিসাব হল। লাম্বারের নিচে স‍্যাকরাল কার্ভ। এখানে পাঁচটা ভার্টিব্রা জড়িয়ে গিয়েছে।
বালিকা খোকার জ্ঞানের বহর দেখে অবাক।
এবার বালিকার নিতম্বের বিভাজিকায় নেমে এসেছে খোকার তর্জনী। এখানে কক্সিস। চারটে হাড় জড়িয়ে এক হয়েছে এখানে। বানরজাতীয় প্রাণী থেকে মানুষ এসেছে। আগে লেজ ছিল। সব মেরুদণ্ডওয়ালা জন্তুর লেজ থাকে। মানুষের‌ও লেজ থাকে। কিন্তু সে যখন মায়েদের পেটের ভেতর থাকে, তখন। বেরোনোর অনেক আগেই লেজ খসে যায়। এই কক্সিসের কাছেই তার প্রমাণ। ভাল বাংলায় অনুত্রিকাস্থি।
অনু অবাক হয়ে বলে, “অ নু ত্রি কা স্থি?”
গম্ভীর গলায় খোকা বলতে থাকে, মানুষ হতে গিয়ে অনেক জিনিস খসাতে হয়েছে। ভগবান কিছু আর একদিনে বানিয়ে ফেলে নি। লক্ষ লক্ষ বছরের চেষ্টায় ভুলচুক শুধরাতে শুধরাতে হোঁচট খেতে খেতে বহু কষ্টে বহু অপেক্ষায় তবে মানুষ তৈরি করতে পেরেছে প্রকৃতি। ভগবানের কিছু হাতযশ নেই। অনু অবাক হয়ে শোনে।
বালিকাকে পাশ ফিরিয়ে খোকা বলে, এই যে কু়ঁচকির কাছে অ্যাপেনডিক্স। মানুষ হয়ে ওঠার অনেক অনেক বছর আগে গরুর মতো জন্তু ঘাস খেত। ঘাস হজম করার জন‍্য গরুদের কাজে লাগে অ্যাপেনডিক্স।  মানুষ তো ঘাস খায় না। তাই অ্যাপেনডিক্স আর মানুষের কাজে লাগে না। টিকটিকির লেজের মতো একটুখানি হয়ে আছে এখানে। জন্তু থেকে ধাপে ধাপে মানুষ হয়ে ওঠার ওটাও একটা প্রমাণ। অ্যাপেনডিক্সে মাঝে মাঝে ময়লা ঢুকে পড়ে যন্ত্রণা হতে পারে। তখন কেটেকুটে বাদ দাও। ন‌ইলে…
এরপর বালিকার নাভিকুণ্ডে তর্জনী ছোঁয়ায় খোকা। বাইবেলে আছে ইভ আদমের পাঁজর থেকে জন্মেছে। তাই তার নাইকুণ্ডু ছিল না। কিন্তু যারা মায়েদের পেট থেকে জন্মায়, তাদের নাইকুণ্ডু থাকে। ওখান দিয়ে মায়ের রক্ত এসে বাচ্চার খাবার দাবার দিয়ে যায়। জন্মের সময় ওই বাঁধন ছিঁড়তে হয়। তাই বাচ্চাকে বলে মায়ের নাড়ীছেঁড়া ধন।
ওরে, সুড়সুড়ি দিস্ না। বলে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে বালিকা।
খোকাকে খুঁজতে এসে খিলখিল হাসি শুনে পর্দা সরিয়ে ঢুকে জ‍্যাঠাইমা হতবাক। টের পেয়ে বালক পালিয়েছে। পড়ে আছে তার স্টেথো।
জ‍্যাঠাইমার চোখে তুমুল রাগ দেখে ভয়ে এতটুকু হয়ে যায় বালিকা। জ‍্যাঠাইমা চাপা গলায় ধমক দেন, তোর গায়ে জামা নেই কেন?
খোকা ডাক্তার ডাক্তার খেলবে বলে খুলতে বলেছিল।
হ‍্যাঁ, অমনি তুমি আহ্লাদ করে ন‍্যাংটোপুটো হয়ে বসে আছো। ছিঃ! মা গো মা। শিগগির প‍্যান্ট পর্।
বালিকাকে ধমক দিয়ে তিনি বলেন, জজের বাড়ির মেয়ে এমন বোকা হয় তা তো জানতাম না।
বাবার পেশা ধরে টানাটানির জন‍্য বালিকা মনঃক্ষুণ্ণ হয়। সে বলে, খোকা বলল যে। জোর করছিল। আমি প্রথমে খুলতে চাই নি। ও খেলবে না বলল। তাই।
হ‍্যাঁ। বুড়ো ধাড়ি মেয়ে! ন দশ বছর বয়স হল। বুদ্ধির বেস্পতি! ও তোর চেয়ে বয়সে ছোট না? ও তোমার ভাই হয়!
হতবাক হয়ে যায় অনু। খোকা তার ভাই? প্রাণের বন্ধু নয়? শুধুমাত্র ভাই?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।