সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ২০

মর্তকায়ার অন্তরালে
||২০||
একবার স্বামীজি এক শিষ্যকে প্রচারে পাঠাতে চান | শিষ্যটি বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, তিনি তো কিছুই জানেন না | স্বামীজি বললেন : “তাই বলগে, ওটাও তো একটা মস্ত বড়ো কথা |” শিষ্যটি তখনও তপস্যা দ্বারা একটা অবস্থা লাভের কথা ভাবছেন | শিষ্যটির মনের এমন বাসনার কথা জানতে পেরে স্বামীজি বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন : “তুই যদি নিজের মুক্তির জন্য সাধনা করতে চাস তো তুই জাহান্নামে যাবি | পরমার্থ লাভ করতে হলে পরের মুক্তির জন্য চেষ্টা কর্ , নিজের মুক্তির ইচ্ছা জলাঞ্জলি দে | ঐ হল সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা |” ১২
নিজের মুক্তির ইচ্ছা স্বামীজির কাছে স্বার্থপরতা | “যে মনে করে, আমি অন্যের চেয়ে আগে স্বর্গ যাব, কিংবা অন্যের চেয়ে আগে মুক্তিলাভ করব – সেও স্বার্থপর |”১৩ ভাইয়ের জন্য যে নরকে যেতে প্রস্তুত সেই বিবেকানন্দের কাছে স্বার্থশূন্য মানুষ | আর এই স্বার্থশূন্যতাকেই বিবেকানন্দ ধর্মের লক্ষণ বলে অভিহিত করেছেন | “নিঃস্বার্থ মানুষ বলে, ‘আমি সবার শেষে থাকব | আমি স্বর্গে যেতে চাই না | আমি নরকেও যেতে প্রস্তুত – যদি তার দ্বারা আমার ভাইয়ের কোন উপকার হয় |’ এই স্বার্থশূন্যতাই হচ্ছে ধর্মের লক্ষণ |”১৪
স্বামীজির কাছে ধর্ম ছিল সম্পূর্ণ মানব ধর্ম | স্বামীজি একবার এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোককে বলেছিলেন : “যে পর্যন্ত আমার দেশের একটা কুকুরও অভুক্ত থাকবে, সে পর্যন্ত আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো ও তার যত্ন করা- তাছাড়া আর সবকিছুই হয় ধর্মধ্বজিতা নয়তো অধর্ম |”১৫ স্বামীজি ঘণ্টানাড়া, ফুল বেল-পাতার ধর্ম সর্বস্ব ছিলেন না | “হাজার হাজার লোক অনাহারে মরছে, ( দেশে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল) তাদের রক্ষা করার জন্য নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করা – এ-ই হল বেদান্ত ধর্মের সারকথা |”১৬
এক সন্ধ্যায় স্বামীজি বসেছেন একান্ত আলাপ চারিতায় | নিশ্চয়ানন্দকে লক্ষ্য করে স্বামীজি বললেন, “দেখ নিশ্চয়……যদি কাজ কিছু করতে না-ও পারো – ভিক্ষে করে একটি পয়সা সংগ্রহ করে, তা দিয়ে একটি মাটির কলসী কিনে রাস্তার ধারে বসে তৃষ্ণার্ত পথিকদের জল দিও | তৃষ্ণাতুরকে জলদান করালেও মহৎ কাজ হবে |”১৭ গুরুগত প্রাণ শিষ্য সেই কথার অন্যথা তো করেননি, বরং আর বেশি কিছু করেছিলেন | এই শিষ্যগণই ছিলেন স্বামীজির practical Vedanta এর বাস্তব রূপকার | খুবই সংক্ষেপে একটু নিশ্চয়ানন্দের কাজ একটু বলব | গুর-শিষ্যের রসায়নের একটি ছবি আঁকতে আমাদের সুবিধা হবে |
স্বামী নিশ্চয়ানন্দ অতি প্রত্যুষে একটা ওষুধের বাক্স ও পথ্যাদির পুঁটলি লয়ে কনখল থেকে আঠারো মাইল হেঁটে হৃষীকেশে যেতেন সাধুদের সেবা করতে | সেবা শ্রশ্রূষাদির পর দিনান্তে আহার ছিল সামান্য মাধুকরী | অপরাহ্নে খোঁজ খবর নিয়ে আবার স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন | রোদ-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম, উপেক্ষা করে দৈনিক ছত্রিশ মাইল হেঁটে স্বামীজির নির্দেশিত পথে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন | জ্ঞানপিপাসু পাঠক আরো অধিক তথ্যের জন্য স্বামী অব্জজানন্দের লেখা ‘স্বামীজির পদপ্রান্তে’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন |
বিবেকানন্দের সেবাধর্মকে নিবেদিতার সেবাকাজের মধ্য দিয়ে না দেখলে দেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় | তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার সুযোগ এখানে নেই | তবুও ১৯৯৮-৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ যখন মহামারীর আকার নেয় তখন নিবেদিতার সেবাকাজ যেনো এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল | বাগবাজারে ঘিঞ্জি গলিগুলির নর্দমা ও স্তুপীকৃত আবর্জনা পরিষ্কার, রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, রোগীর মৃত্যুর পর বস্তির দেওয়াল চুনকাম করা, বাগদি বস্তিতে স্যাতসেঁতে ঘরে প্লেগ রোগীর নিঃসঙ্কোচে সেবার মধ্যে দিয়ে স্বামীজির শিবজ্ঞানে জীব সেবার সার্থক প্রতিফলন দেখা গেলো |
‘স্বামীজির ধর্ম’র স্বরূপ স্বামীজিরই একটি বাণীর মধ্যে নিহিত আছে -“আমার উদ্দেশ্য রামকৃষ্ণ নয়, বেদান্ত নয়, আমার উদ্দেশ্য সাধারণের মধ্যে মনুষ্যত্ব আনা |” মনুষ্যত্ব আনা খুব একটা সহজ কাজ নয় | “Be and Make” – নিজে মনুষ্যত্ব বোধে উর্ত্তীণ না হলে অপরের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ ঘটানো সম্ভব নয় | এই প্রসঙ্গে ‘Kali the Mother’ কবিতাটি খুব প্রাসঙ্গিক | কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করেছেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত | তারই শেষ দুটি লাইন-
“সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,
কালনৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে |”
সর্বসুখ ত্যাগ করে দুঃখ দৈন্যকে বরণের সাহস ও মৃত্যুকে তুচ্ছ করার নির্ভীকতা দেখাতে না পারলে মনুষ্যত্ব আনা সম্ভব নয়, স্বামীজির ধর্মের স্বরূপ উপলব্ধি সম্ভব নয় | কারণ স্বামীজির তাই ইচ্ছে- “সর্বসুখভোগ ত্যাগ ও মৃত্যুকে তুচ্ছ করার নির্ভীকতা তোমাদের পাথেয় হোক |”১৮
তথ্যপ্রাপ্তি :
১| শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ, ২য় ভাগ, ঠাকুরের দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ, নবম অধ্যায়, পৃঃ১৩১ | ২|ঐ, পৃঃ১৩১,১৩২ | ৩| বাণী ও রচনা, খণ্ড ৭, উদ্বোধন কার্যালয়, ডিসেম্বর ১৯৯৯ | ৪| ঐ, খণ্ড ৬, পৃঃ১৯৪ | ৫| উদ্বোধন পত্রিকা,৬ষ্ঠ বর্ষ,১ম সংখ্যা,১ম মাঘ১৩১০,পৃঃ ৩২ | ৬| আমার ভারত অমর ভারত, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, জুন ২০০৫, পৃঃ৯৭ | ৭| ঐ, পৃঃ৯২ | ৮| যুগনায়ক বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, মে ২০১১,পৃঃ৩৪০ | ৯| ঐ, পৃঃ৩৪১ | ১০| স্মৃতির আলোয় বিবেকানন্দ | ১১| শ্রী শ্রী মায়ের কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, পৃঃ৬৩ | ১২| আমার ভারত অমর ভারত | পৃঃ২২৫ | ১৩| ঐ, পৃঃ৬৮ | ১৪| ঐ, পৃঃ৬৮ | ১৫| ঐ,পৃঃ২২৪ | ১৬| ঐ,পৃঃ২২৪ | ১৭| স্বামীজির পদপ্রান্তে, উদ্বোধন কার্যালয়,অক্টোবর১৯৮৩, পৃঃ২৯২ | ১৮| বর্তমান পত্রিকা ১২.১.১৩ |