সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ২৮

মর্তকায়ার অন্তরালে

|| ২৮ ||

ঐ বর্ষেরই আর এক ছাত্রী বকুল মজুমদারের লেখাতে আছে , “বাংলা সাহিত্যের কবি ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপক – প্রথমটা একটু বিস্ময়কর মনে হয়েছিল ছাত্রীদের – কিন্তু তাঁর পড়াবার ভঙ্গিটি দেখে তারা খুশি না হয়ে থাকতে পারেননি |
কবি আরম্ভ করলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক স্যার ওয়াল্টার র ্যালের প্রবন্ধ ‘দি ইনফ্লুয়েন্স অব্ দি ইংলিশ ভয়েজেস অব দি সিক্সটিনথ সেনচুরি অন্ পোয়েট্রি অ্যাণ্ড ইমাজিনেশন’ – কবিকণ্ঠ ভেসে গেল বহুদূরে – সহজ সরল হয়ে গেল ছাত্রীদের কাছে খটমট প্রবন্ধের প্রত্যেকটি ভাষা | কবির দক্ষিণ হস্ত উত্তোলিত হ’ল তাঁরই রূপ প্রকাশে | তাঁর হস্ত উত্তোলনের মধ্যেও যেন সহজ হয়ে গেল কুয়াশাচ্ছন্ন ইংরাজী সাহিত্যের ভাব ……ছাত্রীদের সাথে প্রয়োজনের বেশি একটি কথাও তিনি কোনোদিন বলেননি | ক্লাসে পড়া বোঝাবার সময় কোনো ছাত্রী মনে হয় এতটুকুও অন্যমনস্ক হ’ত না; জানি না এটা তাঁর ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শের গুণ না তাঁকে শ্রদ্ধা করার জন্য | তিরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা – এমন কি উপদেশের নীরস নীতি কথাও তাঁর কাছ থেকে কেউ কোনোদিন পায়নি |”

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে জীবনানন্দ কিন্তু বড়িষার পরেই অধ্যাপনা করেছেন হাওড়া গার্লস কলেজে | তিনি ভালো পড়াতে পারতেন না বা বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা যুক্তিগুলি ধোপে টিকছে না |

তিনি যে বয়সের ভারে পড়াতে পারতেন না, এই মিথ্যেটার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা একটু উল্লেখ করব | শিক্ষক কবি নীহারকান্তি ঘোষ দস্তিদার লিখেছেন : “জীবনানন্দ ও আমি, অনেক সময় একই সঙ্গে কলকাতা থেকে ৭নং বাসে চড়ে বড়িষার যেতাম এবং ফেরার সময়ও অনেক সময় এক সঙ্গেই কলকাতায় ফিরতাম | কিন্তু তাঁকে তখন খুব দুর্বল বলে একদিনও দেখিনি |”

তাহলে ঐ’রূপ মিথ্যে অভিযোগের আসল রহস্য কী ? ঐ ভদ্রমহিলা যিনি তাঁর দাদাকে বলে জীবনানন্দের চাকরিটি পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি গোপালবাবুকে জানিয়েছিলেনল : “দাদা, ওসব দায় দায়িত্ব নিতে রাজী ছিলেন না | জানেন তো মাথার উপর তখন এডুকেশন সেক্রেটারি ডি.এম.সেন | তিনি কিরূপ কড়া লোক?”এই প্রসঙ্গে গোপাল বাবুর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : “কে কড়া আর কে নরম, তা আমার জানবার প্রয়োজন ছিল না, আমি যা জানবার সেটুকু জেনেই চলে এলাম |”

এরপর জীবনানন্দ হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু ওখানেই ছিলেন, যদি ঐ কলেজে তাঁর আয়ুষ্কাল খুব স্বল্পকালের | ১৯৫৩ এর মাঝামাঝি হাওড়া গার্লস কলেজে যোগদান আর তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৫৪এর ২২ অক্টোবর রাত্রি ১১টা৩৫মিনিটে |

তাঁর সংসার ধর্ম গ্রহণের পর থেকে সংসার সংসার পলাতক চিত্র আমরা পেলাম না | বরং সংসার প্রতিপালনে কবির ঐকান্তিক প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় |

এবার আসব তাঁর কবিতায় | যেটি জীবনানন্দের নিজস্ব ক্ষেত্র | পলায়নের মনোবৃত্তি তাঁর কবিতায় পরিলক্ষিত হয়নি | ভগবানের কথা, ধর্মের কথা তেমন ভাবে না থাকলেও মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত প্রেম, দুঃখ, সুখ সামাজিকতা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান | সর্বোপরি প্রকৃতি প্রেম তাঁর কবিতার একটি মূল সুর | স্বদেশ প্রীতি তাঁর কবিতার মধ্যে খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত | একটি কবিতার এখানে উল্লেখ করব, যে কবিতার প্রত্যেকটি লাইন এত অদ্ভুতভাবে সত্য,পড়লে মনে হবে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, তিনি আমাদেরই লোক মানুষের দুঃখে তিনি ব্যথা পেয়েছেন | তাই তিনি লিখেছেন :
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা,
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া |
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় |

‘সুচেতনা’ এতটি প্রেমের কবিতা | যখন এই লাইনগুলি পড়ি :
“কেবলই জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপবীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতো আমাদেরো প্রাণ
মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান |
এরপরেই তিনি লিখছেন – সুদিন আসবে | কবি আশাবাদী |
“সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে- এই-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ-বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;
প্রায় ততদূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো, ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে |”
প্রেমের সঙ্গে যেনো দেশ সমাজ সব মিলেমিশে একাকার |

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।