সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (চতুর্থ পর্ব)

সবাই চুপ করে বসে আছি, তুলসীতলার পিদিমের কাঁপা কাঁপা আলোয় দাওয়ার অন্ধকারটা বুঝি আরও ঘন হয়ে জমাট বেঁধেছে। কানাইদার মুখ আর দুটো স্থির আঁখিপাতা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, কানাইদা মাটির দাওয়ায় বসে থাকলেও অন্য কোথাও বিচরণ করছেন। বাউলনি যে কখন ঘরের চৌকাঠে এসে বসেছে, কে জানে? আলো যতোদূরেই জ্বলুক না কেন শরীর পেলে ছায়া ফেলবেই। বারান্দার দেওয়ালে কানাইদার শরীরের ছায়াটাও সমানে কেঁপেই যাচ্ছে। একটা আধিভৌতিক পরিবেশ।
–” বুজলে গো পদীপদাদা, এই মিলন কথাটা সাদারণভাবে ভাবলে একরকম, আর তলিয়ে ভাবলে এর কোনও তল খুঁজে পাওয়া যাবে নে। “
ফের একটা নীরবতা। বাটির মুড়িমাখা বাটিতেই পড়ে আছে। মুখে দিচ্ছিনা এটা ভেবে, সে মুড়ি চিবোনোর শব্দে যদি কানাইদার মার্গবিচরণে সামান্য হলেও ব্যাঘাত ঘটে।
–” মনের মানুষ, এই কতাটার মধ্যে যে কী অনন্ত এক খোঁজ লুইকে রয়েচে, সেটা কিন্তু তুমি আমি বুজতেও পারবো না গো পদীপদা। মনের মানুষ কতাটা শুইনলে তুমি আমি ভাবতে বইসপো যে বোদয় সেই পেমাস্পদর কতা, যারে দেকলি পরে মন অপূব্ব এক আনন্দের বাজারের খপর পায়। ক’জন ভাবতে পারে যে, মানুষ আর অন্য কাউকেই না নিজেরেই নিজে সবচে বেশী ভালোবাসে। নিজের আনন্দ যকন এক সচ্চিদানন্দের খপর পায়, তোমার মন তোমার আত্মা যকন এই পিথিবি ছেইড়ে, চন্দ সূয্য, গহ তারা ছেইড়ে, মহাশূন্যে সেই আনন্দপুরুষের, পরমাত্মার খোঁজ পায়, তকনই মনের মানুষ এসে বসত করে মনের মাজারে।”
কানাইদা যেন কথা বলছে না। শুধু ঠোঁট দুটো নড়ে যাচ্ছে, আর কোন সুদূর থেকে যেন শব্দগুলো কথার মতো ভেসে আসছে।
–” সেটাই হলো মিলন গো পদীপদা, মনের মানুষের সাথে মিলন। সে মিলনে নোকনজ্জার অবকাশ কই গো! সে তো তোমার সাতে তোমারই মিলন। সে বড়ো অপূব্ব বিষয় গো। এক জ্যোতিম্ময় পুরুষ বা নারী মিলিত হচ্ছে নিজেরই আরেক পরমজ্যোতির সাতে। একেনে কোনও শরীর নেই গো, শুদুই মন, শুদুই আনন্দ, শুদুই আলো। এ মিলনে মেলার জন্যিই না সমস্ত সাদকেরা সাদনায় মাতেন। ”
এ কি কথা কইছেন অন্ধ একজন বাউল, চক্ষুহীন একজন মানুষ আলোর দেখা পাচ্ছেন। দেখা না পান, উপলব্ধিতে, চেতনায় কোন মার্গে বিচরণ করছেন, সে কথা কে বুঝবে? আচ্ছা — নদী কি আমায় এই মিলনের কথাই বলেছিলো? একই শরীরে পুরুষ এবং নারী?
মনের কথাটা যেন চুম্বকের মতো করে টেনে নিলো কানাই বাউল।
–” দ্যাকো পদীপদা, তোমার মন যকন কোনো শরীল আশ্যিত পেম চাইবে, তকন সে পেমে হাজারো সমিস্যে। সবচাইতে বড় সমিস্যে হচ্চে গে তিপ্তি পাওয়া বা দেওয়া। একটা শরীল যকন তিপ্তিতে ভরপুর, তকন হয়তো অন্য শরীল মরুভূমির মতো শুইকে রয়েচে। সে পেম দু’দিনের তরে গো। কিন্তু যে পেমে শরীলের কোনো চাহিদার পয়োজন নাই, নিজের শরীলের সাতে নিজের শরীলের মিলন, আসলে সেকেনে তো কোনো শরীলই নেই গো, আনন্দের আদার। আনন্দের সাতে পরমানন্দের মিলন, আলোর সাতে আলোর, সুরের সাতে সুরের গো, সুগন্দের সাতে সুগন্দের। এটা দেকতে গেলে স্বমেহন, স্বরতি। একেনে পুরুষ অঙ্গে নারী আর নারী অঙ্গে পুরুষ একই সাতে একই অঙ্গে অঙ্গীভূত গো, একাঙ্গী। কাজেই কোনও আপশোষ বা অতিপ্তির কোনও সুযোগই নেই গো, এ মিলন যে মনের মানুষের সাতে মিলন, যে মানুষ নিজের মনেই যাপন করেন। এ পেম মনকে ভিত্তি করে গড়ে ওটে, শরীলকে ভিত্তি করে লয় গো।”
ওই আলো আঁধারিয়ায় কানাইদার মুখে যেন এক আনন্দের আভা পিছলে যাচ্ছে। রাতেরবেলায় বৃষ্টিস্নাত খেজুর পাতায় যেভাবে চাঁদের আলো পিছলে যায়, সেভাবেই। ধীরে ধীরে তিনি যেন নীচে নেমে আসছেন।
–” তুমি কি আমার কতা কিচু বুজতে পারলে গো পদীপদা? নদীও বোদয় এ কতাগুলোই তোমায় বইলেচিলো। কতা অচ্চে সরিতসাগর গো পদীপদা, একবার বাঁদ ভাইঙলে যেমন জলের তোড়কে আর রোকা যায় না, কতাও তেমনিই গো। একবার শুরু করলে আর –”
— ” বলি একটু চা কইরে দেপো? গলা ভিজোবে নাকি গো গোঁসাই? আমি তো চিন্তায় পড়ে গেচিলাম, ভাবতিচিলাম আজ না জানি নাইমতে রাত গইড়ে যায়। বুজলে গো ঠাকুর, এজন্যিই না বইলেচিলাম যে, পেরাইমারি ইস্কুলের মাস্টারের সাদ্যি কী উঁচু ইস্কুলের পড়া শেকানোর? ”
–” আরে,দেকো দেকিনি, ভাইবলাম আজ সন্দেয় পদীপদাকে নিয়ে একটু দাদুর ঠাঁয়ে যাপো, কিন্তুক কোতা তেকে যে সুময় কেটে গেলো বুজতেই পারলুম না -”
–” এ সব অনত্থ হলো গে সেই গানটার জন্যি। ওরা কারা, লালন সাঁইয়ের গান গাইচিলো? ”
আমার মনে তখন রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করা শুরু করেছেন। যে কোনও সময় বিপদ ঘটতে পারে। মন ছেড়ে সুর এসে কখন যে এই দাওয়ায় আছড়ে পড়বে, বুঝতে পারছি না।
–” তারচে’ আমি একটা কতা বলি? আজ আর দাদুর আকড়ায় গে কাজ নেই। মনটা কুব ঠাকুরের গলায় গান শোনার জন্য অদীর হয়েচে গো গোঁসাই। ”
-” সেই সবচে ভালো হপে গো পদীপদাদা, একটা গান ধরো কেনে গো, রাজা বাউলের গান, আমার পরাণের রবিবাউলের — “
–” আরও আলো আরও আলো
এই নয়নে প্রভু ঢালো
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি আরও আরও আরও দাও তান
মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ।
আরও বেদনা আরও বেদনা
প্রভু দাও মোরে আরও চেতনা
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।
আরও প্রেমে আরও প্রেমে
মোর আমি ডুবে যাক নেমে
সুধাধারে আপনারে
তুমি আরও আরও আরও করো দান।
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ। “
–” ঠাকুর, বাউলরাজার গানেও যেন সে ইঙ্গিতই পেলাম গো। আরও পেমে আরও পেমে – মোর আমি ডুবে যাক নেমে, সুদাদারে আপনারে, তুমি আরও আরও আরও করো দান! কতাগুলোর মানে কী গো গোঁসাই? “
ত্রয়োদশ পর্ব
শুক্লা অষ্টমীর চাঁদ একটা নৌকো হয়ে যেন নোঙর ফেলেছে উঠোনের ছাতিমগাছটার ডালে। সারাটা অঞ্চল ‘ম ‘ম করছে ছাতিমফুলের মৌ মৌ সুবাসে।
এতোক্ষণ ধরে এই গন্ধটা নাকে আসেনি কেন? এটা তো আর ঠিক নয় যে, এই গন্ধটা হঠাৎ এসময়ই ইচ্ছে করে ছাতিম ছড়িয়ে দিলো! এরকমটা হয়। ধরো অনেকক্ষণ ধরে কোনো একটা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছো, আচমকা কোনো বাঁক ঘুরতেই হয়তো একটা আঁধারভরা ঝোপে থোকা থোকা জোনাকিপোকা জ্বলছে আর নিবছে, তোমার তখন হঠাৎ করেই মনে হতে পারে — বাপরে, কি জমাট বাঁধা অন্ধকার এখানে।
–” দ্যাকো পদীপদা, আসলে উপলব্দি লয় গো, কতাটা হচ্চে, সে উপলব্দিকে মনের অন্দরে নে সেটাকে কাটাচেঁড়া কইরে, একটা সিদ্দান্তে আসা। ঈশ্বর যেমুন আমাদের পঞ্চইন্দিয় দিয়েচেন, এমনটা আর কোনো ছিষ্টিকে দেননি গো। তারাও লিচ্চয় চামড়া দে ঠান্ডা — গরম বুজতে পারে, নাক দে গন্দ শুঁকতে পারে, কানে শব্দ ঠাহর কত্তে পারে, জিব দে স্বাদও নিতে পারে, কিন্তু ব্যাস ওই পয্যন্তিই। সেসব ইন্দিয় দে কোনও কিচু বিচার কইরে নিজেকে উন্নত করার কাজে ব্যভার কত্তে পারে না গো। উপলব্দি আর অনুবব এ দু’শব্দের মদ্যে খুব সামান্য কিন্তু বিশাল এক পাত্থক্য আচে। এ জন্যিই মানুষ সব্ব ইন্দিয়ের উপরে গে নিজেকে বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্তায় নিয়ে যেতি পারে। অন্য কোনও জীব সেটা পারে না।”
ছাতিম আর মহুয়া এ দুটো ফুলের ভেতর অনেক সাদৃশ্য থাকলেও পার্থক্যও আছে বিস্তর। দুটোর গন্ধেই মদিরতা আছে, কিন্তু মহুয়ার গন্ধে মাথা ধরিয়ে বমি করিয়ে ছাড়বে , কিন্তু ছাতিমের গন্ধে মন যেন কোথায় ভেসে চলে — কোন দূরে যেন খুঁজে ফেরে ভালোবাসাকে। মনে যখন এসব ভাবছি, তখনই কানাইদা ফের একবার চমক লাগালো।
মন কী কথা ভাবছে সেসব যে কীভাবে পড়ে নিতে পারেন এই অন্ধ বাউল, সেটাও একটা পরম বিস্ময়।
–” রবিবাউল কি আর সাদে তার ধ্যানমন্দিরে ছাতিমগাছ বইসেচিলেন গো? এর সুবাস মনকে অনন্তের খপর দেয় গো পদীপদা। যে গানটা তুমি গাইলে, সে গানের বেতর যে অনন্তের আরাদনা আচে সে কি এতোই সাদারণ গো — তইলে বাবতে গেলে তুমি পুরো অতলতলে তইলে যাবে গো। পেম হলো গে এক সুদার আদার। সে সুদাদারে কবি যেন ডুইবে যেতে চান। আমার আমি যদি নিজের কাচে নিজেই হাইরে যাই তাহলেই তো মিলন হপে গো, আমার আমির মদ্যেই তো লুইকে আচে মনের মানুষ! ”
কোন কথাটাকে যে কোন নোঙরে বেধে অতলে ডুব দেন এনারা সে মনের সন্ধান পেতেই কি আমার উচাটন মন আমাকে টেনে এনেছে এখানে?
দাওয়ার থেকে উঠে ঘরে গিয়ে গায়ে পেঁচিয়ে রাখা কাঁথাটাকে খুলে গায়ে একটা ওভারকোট চাপিয়ে নিলাম। এই ওভারকোটটা আমার খুব প্রিয়। সি ই এস সির একজন নাইট ওয়াচম্যান জানাদা এই কোটটা আমাকে দিয়েছিলেন। ধুসর রঙের কম্বলকাপড়ে তৈরি এই কোটটা প্রায় পায়ের পাতা ছুঁয়ে ফেলে। আর অজস্র ছোটোবড়ো পকেট। পাজামার ওপর কোটটাকে গলিয়ে হাতে একটা পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে নিলাম। ধীর পায়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালাম। আধো অন্ধকারে থোকা থোকা ছাতিমফুল ফুটে আছে। মনে পড়লো, কানাই বাউল কেঁদুলির মেলায় যেদিন হারিয়ে যাওয়া শিশু কৃষ্ণভামাকে পরম যত্নে বুকে ঠাঁই দিয়েছিলেন, সেই একইদিনে শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন এক শিশু ছাতিমকে। দু’জনকেই এনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন তার আখড়ায়। দুই শিশুই — শিশু ছাতিম আর শিশু মানবী একইসাথে লালিত হয়েছে কানাইদার ঠাঁয়ে। একই বয়সী দুই শিশু দু’জনকে বরণ করে নিয়েছিলো মনের নিগড়ে।
ধীরে ধীরে আশ্রমের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে পথে পা রাখলাম। বেশ লাগছে। ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। ডানহাতে ধরা টর্চের আলোয় বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি — পথের দু’ধারের ঘাসে এখনই যেন রূপোলি শিশির বাসা বানাচ্ছে।
কী মনে হলো টর্চের আলোটাকে আকাশের দিকে তাক করলাম। আর তখনই একটা অপূর্ব সুন্দর জিনিস চোখে পড়লো। তীরের ফলার মতো ত্রিভুজাকৃতি দুধসাদা বলাকার সারি ঝকমক করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। রাতেরবেলা ওদের এরকমভাবে আকাশ পাড়ি দেওয়ার দৃশ্য আমি আগে কোনও দিনও দেখিনি।
শীতের আকাশ বুঝি অন্য সময়ের থেকে বেশী নির্মল থাকে। সারাটা আকাশ জুড়ে তারারা কামিনীফুলের মতো ফুটে আছে।
—” তুমি কোনওদিনও আকাশগঙ্গা দেকেচো ঠাকুর? ”
বাউলনি যে কখন আমার পাশে পাশে পথ হাঁটছে, খেয়াল করিনি। আমি একটুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাত্রি এবং কৃষ্ণভামা — দুইই কালো, কিন্তু কেউই নিকষ কালো নয়। বাউলনির সারাটা মুখ জুড়ে এখন যেন একটা খুশীমাখা শিশুর সারল্য।
আমি মাথা নেড়ে বললাম –” না তো, বইতে পড়েছি, কিন্তু চাক্ষুষ করিনি। কিন্তু তুমি কখন এলে বাউলদিদি? একা একা কিন্তু বেশ লাগছিলো হাঁটতে। ”
–” ও, আমি এসে বুজি তোমায় বিরক্ত করলাম! বেশ, তুমি এগোও, আমি আসি। ”
কথাটা বলেই বাউলনি পেছন ঘুরলো। আমি বাঁ হাতটা দিয়ে ওর হাতের কব্জিটাকে ধরলাম। সেও বুঝি এরকমটাই চাইছিলো। কপট রাগ দেখিয়ে বললো — ” দ্যাকো ঠাকুর, মোহিনী রাতে মোহিনী নারী সঙ্গ ভালো নয় গো। আমি না হয় বরং –”
–” কী যেন বলছিলে আকাশগঙ্গার কথা! কোথায় আছে দেখিয়ে দাও না গো বাউলদিদি –”
বাউলনি এক ঝটকায় আমার মুখটাকে ধরে ওর মুখের কাছে নিয়ে এলো, ডানহাতটাকে আকাশের দিকে তুলে বলে উঠলো —
— ” হুই যে দেকতেচো দুদসাদা রঙের একটা পতের মতো চলে গিয়েচে ওই জারুল গাচের মাতার ওপর দে –”
বাউলনির মুখনিঃসৃত বাতাস আমার নাসারন্ধ্রে এসে ঢুকছে। সেই বাতাসের বুকে যেন সেই ছাতিমফুলের মৌ মৌ মাতাল করা গন্ধ। সে অবস্থায় যে আমি কতকাল ছিলাম জানি না, সে এক লহমা ও হতে পারে, এক দন্ড, এক অনুপল, এক পল, এক মুহূর্ত অথবা এক যুগ — সে আমি জানি না। দূর থেকে যেন একটা শব্দ ভেসে এলো — ” ঠাকুর সেই যে গানটা আচে — আকাশভরা সূয্য তারা — গানটা গাইবে গো?
সারাটা আকাশ জুড়ে টগরফুলের মতো তারারা ফুটে আছে, চাঁদের নৌকোটা তখন পুবের দিক থেকে একটু দক্ষিণ দিকে হেলেছে। ধীরে ধীরে ওটা পাল তুলে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দাঁড় বাইবে।
আধো আলো আধো আঁধারে গাছগুলোর বুক জুড়ে থোকা থোকা জোনাকি, জোনাকিরা ছড়িয়ে আছে ভুঁই থেকে মাথা তোলা কণ্টিকারির ঝোপগুলোর বুকে। মনে হচ্ছে যেন, আকাশময় ছড়িয়ে থাকা তারারা বুঝি মাটির প্রেমে নীচে নেমে এসেছে। রাতের আকাশকে আমি বুঝি এভাবে উপলব্ধি করিনি কখনও।
ছাতিমফুলের মৌতাতের সুবাস আর রাতের আকাশ সবকিছুই যেন এক অপরূপ বাউলিয়া রূপ নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
–” ঠাকুর –”
ফিসফিস করে একটা শব্দ আমার চৈতন্যর মধ্যে যেন একটা গোপনীয় বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে।
— ” আজকের আকাশের মতো এতো রূপসী আকাশ আমি কোনোদিনও দেকিনি গো। আসলে আমার মনে লয় ঠাকুর, মনের মতো সঙ্গী পেলি পরে পিথিবিটাই বুজি আয়নার সামনে বইসে সাজতি শুরু করে। ”
–” ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান।
বিস্ময়ে তাই জাগে — জাগে আমার প্রাণ —
আকাশ ভরা –”
— ” ঠাকুর, এ প্রাণের খোঁজ কীভাবে পাওয়া যায় -”
দূর থেকে যেন একটা আকুতি ভেসে আসছে। আমি শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু ঠাহর করতে পারছি না। কে যেন আমার হাত ধরে তারায় তারায় নেচে বেড়াচ্ছে –
” অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার ভাঁটায় ভুবন দোলে — নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান — বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান — আকাশভরা –”
–” তোমার কাছে এলিই আমার জানাগুলো কেমন বেবভুল হয়ে যায়, আমি কোতায় যেন হাইরে যাই, কোন্ নক্ষত্তের পত ধইরে কে যেন একটা একতারার সুরে আমায় ঘুইরে নে বেড়ায়। আমি কিচুতেই পত খুঁজে পাই না –”
সেই সদ্য শিশিরপাতে ভিজে যাওয়া বাতাসে আমি আমার গালে কার যেন করতলের শীতল স্নিগ্ধ স্পর্শ পেলাম। ধীরে ধীরে আমি উপলব্ধির জগতে ফিরে আসছি। বাউলনি তার দু’হাতের তালু দিয়ে আমার দু’গালকে ধরে আছে। তার দুচোখের পাতায় টলমল করছে সদ্য পড়া মুক্তোবিন্দু। আমি সেই আধো আলো আঁধারিয়ায় কৃষ্ণভামার চোখে কী দেখলাম, তার মানে আমি আজও বুঝে উঠতে পারি নি। সেটা কি রাধাভাবের বিভোরতা, নাকি এক অসহায় নারীর আত্মসমর্পণ অথবা –
–” বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে
দিওয়ানা বানাইছে —
কী জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে —
আমি কী বলিবো আর – বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে
কলিজা অঙ্গার —
ওরে পরাণবঁধুর পিরিতে আমার কুল হারাইছে–
দিওয়ানা বানাইছে আমায় —
বসে ভাবি নিরালায় —
আগে তো জানি না বন্দের পিরিতির জ্বালা,
ওরে –কুল নাশা পিরিতির নেশায়
কুল মান গেছে — দিওয়ানা বানাইছে –“
দোতারার তারের সুরের সঙ্গতের সাথে ইনি কোন্ মহান, পথের পাশে সামান্য একটু ঢালের শেষে একটা অপ্রশস্ত উঠোনের পর একটা মাটির দাওয়ায় বসে এ কোন্ গান ধরেছেন?
তখন কৃষ্ণভামার হাতের ভেতরে আমার হাত। আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে দু’ফোঁটা উষ্ণ জলবিন্দু আমার হাতের ওপর ঝরে পড়লো।
ঘন অন্ধকারেও যদি কোনও কিছু ঠাহর করার চেষ্টা করা যায়, তাহলে অন্ধকারকে দূরে ঠেলে সে বস্তু প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। আসল বিষয়টা হচ্ছে তুমি তাকে দেখার জন্য কতোটা উদগ্র হয়ে আছো। তোমার আকাঙ্খাই তোমার চাওয়াকে অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট করে তোলে। আলোর বুকে অন্ধকার বসত করে কিনা জানি না, তবে অন্ধকারের বুকে আলোর বসত আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করলাম। ঘন কৃষ্ণ অন্ধকারে আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম কৃষ্ণভামার ঘন কৃষ্ণ নয়নতারার মধ্যে আমার মুখচ্ছবি।
–” ঠাকুর –”
আবার সেই কন্ঠস্বর। যেন সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে একটা বুদবুদ জলের উপরিতলে এসে অস্ফুটে ফেটে গেলো।
–” গোঁসাই বলেন, অন্দত্ব চোখে লয় গো, আসল অন্দত্ব ঠাঁই গেড়ে নেয় মনের বেতরে। সমুদ্দ চায় বলেই দেকো সেই কোন গবিরে আলো গে সেঁদোয়। যারা জাত ডুবুরি তারা দেকো গবিরে ডুব দে ঠিক মুক্তো তুইলে নে আসেন। অন্দ চোকেও গোঁসাই যে আলোর সন্দান করেন, সেটাই আসলে খোঁজ গো ঠাকুর। মনের মদ্যি আকুলতা না থাকলি কেউ কারো নয়নতারায় নিজেরে পত্তক্ষ কইরতে পারে না গো। ”
সে কি ? আমি যে ওর চোখের মণিতে আমায় দেখলাম, সেটা ওকে কে জানান দিলো? এই আদিগন্ত আঁধারিয়ায় নক্ষত্র আলোকে আলোকিত পৃথিবীর বুকে কিছুক্ষণ আগে শোনা গানটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। –” কি জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে — দিওয়ানা বানাইছে , পিরিতি শিখাইছে — ”
গানটা কি তাহলে কেউ গাইছিলেন না, তাহলে এই গানটাও কি গোটা কুহকেরই অঙ্গ মাত্র?
কৃষ্ণভামার হাতের মুঠোয় আমার হাত। পথের সেই ঢাল বেয়ে আমরা এসে সেই গায়কের উঠোনে দাঁড়ালাম।
–” ঠাকুর, ইনি হলেন আব্দুল ফকির। লালন সাঁইএর সাগরেদ। যে গানটা ইনি গাইচিলেন, সেটার পদকত্তা লালন গো — লালন ফকির। “
কালো লুঙ্গি, কালো আলখাল্লা আর মাথায় একটুকরো কালো কাপড় ফেট্টির মতো করে বাঁধা একজন দীর্ঘদেহী মানুষ, হাতের দোতারাটা রেখে প্রণামের মুদ্রায় আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।