Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৫)

maro news
ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৫)

তীর্থ ভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

(গ) প্রথা বহির্ভূত স্থাপত্য: বাংলার প্রথাগত শিখর ,চালা ,দালান ,রত্ন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মন্দির ছাড়াও গম্বুজাকৃতি ছাদসহ বেশ কিছু মন্দির স্থাপত্যের নিদর্শন পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলায় দেখা যায়। মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্গত আদিনাথ ও কিরীটেশ্বরীর মন্দির বর্গাকার ভূমি নকশার উপরে স্থাপিত হলেও মন্দিরের উপরিভাগের স্থাপত্য গম্বুজাকৃতি। কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর,মেদিনীপুর জেলায় এরকম কিছু গম্বুজাকৃতি ছাদ বিশিষ্ট মন্দির দেখা যায়। বীরভূম জেলায় এ ধরনের গম্বুজাকৃতি ছাদের মন্দির চোখে পড়েনি। তবে মন্দিরময় মলুটি গ্রামে, যেখানে সাধক বামাক্ষ্যাপার ছোট মা বলে কথিত মৌলিক্ষা মাতার মন্দির আছে, সেখানে সিঙ্গেল প্ল্যাটফর্মের উপরে পাশাপাশি তিনটি মন্দির আছে, যার তিন রকম আকৃতির তিনটি চূড়ার মাঝেরটি গম্বুজাকৃতি। ওই গ্রামটি আগে বীরভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জুন যে সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়, তার পরিণতিতে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ওই গ্রামটি তখনকার বিহারের অর্থাৎ বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে বর্ধমানের জমিদার কীর্তিচাঁদ রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মন্দিরের স্থাপত্য অভিনব। মন্দির চত্বর এর মূল পূর্বমুখী প্রবেশপথটি জোড়বাংলা ও পশ্চিমভাগের প্রবেশপথ দোচালা রীতিতে নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহ রথ-পগ যুক্ত একরত্ন মন্দির। ক্রমহ্রাসমান অবস্থায় উচ্চতা তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। কিন্তু মন্দির সংলগ্ন বিশাল বর্গাকার জগমোহনের ছাদ গম্বুজাকৃতি।

(৮) রাসমঞ্চ, দোল মঞ্চ ও তুলসী মঞ্চ:

উপাসিত বিগ্রহকে বাৎসরিক উৎসব বা অনুষ্ঠানে মূল মন্দির থেকে বাইরে নিয়ে এসে মন্দিরের কাছাকাছি স্বতন্ত্র ভাবে রাখার জন্য নির্মিত রাস মঞ্চ বাদল মঞ্চ। মঞ্চ বলতে বোঝায় বিশেষভাবে নির্মিত উচ্চতা বিশিষ্ট কোন মন্ডপ। যেখানে বিগ্রহকে স্থাপন করলে ভক্তদের বিগ্রহ দর্শনের সুবিধা হয় সেই কারণে ওই ধরনের মঞ্চের চারদিক খোলা রাখা হতো। সাধারণত উঁচু বেদীর উপরে আটকোনা হিসাবে ওগুলো নির্মিত‌ হত এবং অধিকাংশ স্থানে রাসমঞ্চের প্রতিটি কোণে স্তম্ভের উপর সংস্থাপিত একটি করে চূড়া ছাড়াও তার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আরেকটি বৃহদাকার চূড়া সংযোগ করে সেটিকে ন চূড়া বিশিষ্ট হিসেবে নির্মাণ করা হত। যদিও কোথাও এইসব চূড়ার আকৃতি দেখা যায় শিখর মন্দির সদৃশ, তবে অধিকাংশ স্থানে এগুলি হত রসুনের আকারে‌। স্থানীয় স্থপতিরা তাই এই ধরনের চূড়াগুলিকে 'রসুন চূড়া' নামে ‍ অভিহিত করত। এই জাতীয় রাস মঞ্চ মেদিনীপুর, হুগলি, বাঁকুড়া সহ পশ্চিমবাংলার প্রায় সব জেলাতেই দেখা যায়। নয় চূড়া ছাড়া সতেরো চূড়া বিশিষ্ট রাসমঞ্চ মেদিনীপুর বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। তবে শিখর মন্দিরাকৃতি চূড়া যুক্ত সতেরো চূড়া রাসমঞ্চের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বাঁকুড়া জেলার হদলনারায়নপুর( পাত্রসায়র থানা) এবং মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া থানার অন্তর্গত মাঙলই গ্রামে দেখা যায়। এই দুটি রাসমঞ্চে প্রভূত পরিমাণে পৌরাণিক দেবদেবীর পোড়ামাটির ফলক সংযোজিত হয়েছে। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের বৃহদাকার রাস মঞ্চটি পীঢ়ারীতির আদলে নির্মিত প্রথাগত স্থাপত্য বহির্ভূত এক অভিনব স্থাপত্য নিদর্শন , যার তুল্য কোন স্থাপত্য পশ্চিম বাংলার কোথাও নেই। নাড়াজোলের বৃহদাকৃতি রাসমঞ্চ টি দ্বিতল দালান এবং প্রতি তলে বারোটি করে ২৪ টি এবং শীর্ষ ভাগের কেন্দ্রীয় বৃহৎ চূড়াটি নিয়ে পঁচিশরত্ন রাসমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।

‍রাসমঞ্চের মতো দোলমঞ্চের সংখ্যাও পশ্চিমবাংলায় অনেক। সাধারণত চতুষ্কোণাকার এই স্থাপত্য গুলির আকৃতি হত চার চালা বা আটচালা কোথাও পঞ্চরত্ন বা নবরত্ন, আবার কোথাও শিখর রীতি সদৃশ। এই ধরনের ইমারতের বৈশিষ্ট্য হলো রাস মঞ্চের মতো চারিদিকে খোলা চারকোণে নিবদ্ধ থামের উপরে স্থাপিত লহরা- নির্ভর গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদন নির্মিত হতো। চারচালা রীতি দোল মঞ্চের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল বর্ধমান জেলার বড়শুলের( থানা বর্ধমান) এবং বীরভূম জেলার জাজিগ্রামের( থানা মুরারই) দোল মঞ্চ। বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার থানার অন্তর্গত মন্দির ময় গণপুর গ্রামে কালীতলায় ১৪ টি চারচালা রীতির শিব মন্দির এর কাছে টেরাকোটার কাজ শোভিত একটি সুন্দর দোল মঞ্চ আছে। রাসমঞ্চ ও দোল মঞ্চ ছাড়াও কিছু কিছু স্থানে উঁচু ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত চারদিক খোলা চতুষ্কোণ ভূমি নকশার উপর স্তম্ভ নির্ভর চারচালা বা পঞ্চরত্ন রীতি বিশিষ্ট বেশ কিছু তুলসী মঞ্চ দেখা যায়। এইসব মঞ্চের মাঝখানে তুলসী গাছ রোপনের জন্যই এটির নাম তুলসী মঞ্চ হয়েছে।

নির্মাণ কৌশল ও উপকরণ: পশ্চিমবাংলায় মন্দির নির্মাণের উপাদান হিসেবে বেশিরভাগ জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে অগ্নিগ্ধ ইঁট। বাঁকুড়া পুরুলিয়া মেদিনীপুর বর্ধমান প্রভৃতি জেলায় নানা ধরনের পাথর সহজে পাওয়ার কারণেই হয়তো পাথর দিয়ে নির্মিত অনেক মন্দির ওইসব জেলাতে আছ । গাঁথনির উপকরণ হিসেবে চুন-সুরকি বা চুন বালির মিশ্রণে তৈরি পলেস্তরার প্রয়োগ হয়েছে ব্যাপকভাবে।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register