T3 || নারী দিবস || সংখ্যায় দেবযানী ভট্টাচার্য

নারীর আত্মবিশ্লেষণ

4.7,1940 আনন্দবাজার পত্রিকার ‘নারীর কথা’-র নিজস্ব পাতায় লেখা হল,”কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত এ দেশের গোটা নারী সমাজ এখনও আত্মনির্ভরশীল হইতে শিখে নাই-আত্ম মর্যাদার মর্ম এখনও ভালো করিয়া বোঝে নাই।’কেটে গেছে 82 বছর, আত্মবিশ্লেষণ করতে বসে দেখি, অবস্থাটা কী কিছু পরিবর্তন হয়েছে?হাজারো ত্রুটি মস্তিষ্কে আঘাত করে, স্বাধীনতা বা অধিকার কী ছেলের হাতের মোয়া ! ইহা অর্জন করতে জানতে হয়, আমরা অভিযোগ করে, কেঁদেকেটে ,প্রতিবাদ করে কিছু পেলেও এই ভাবনায় জারিত হই না ,এ তো সহজাত ভাবেই বিদ্যমান আমাদের মধ্যে, নেই নেই রব তোলা আমাদের চিন্তার অসারতা, কিছু আইন হয়তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চালু করতে উদাসীনতা দেখিয়েছে, কিন্তু আমরা কতটুকু এর ধারণকারী?আমরা কেন লালন করছি লিঙ্গ বৈষম্য?
স্বাধীনতার পরবর্তী যুগে নারীর জীবনে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন, প্রয়োজনের খাতিরে বাইরের দুনিয়ায় ঘটেছে পদার্পণ, কিন্তু আত্ম নির্ভরশীলতার প্রশ্নে চেতনায় রয়ে গেছে জমাট বাঁধা অন্ধকার!!তাই বিবাহকেই হাতিয়ার করে গার্হস্থ্য জীবনের সুখকেই বেছে নিয়েছে নারী, লড়াইয়ের ময়দানে নেমে নিজেকে যাচাই করার মনোভাব বা আত্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সে ভাবে করে নি, তবে এ বিষয়ে সমাজের ভূমিকা অবচেতনে ছাপ ফেলেছে মগজে।লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা বা পুরুষকে দোষী সাব্যস্ত করে চাপা দিয়েছে নিজেদের চেতনার অক্ষমতা।এও কী আত্মমর্যাদার মর্ম না বোঝার অক্ষমতা নয়?

আত্মবিশ্লেষণ পর্বে উঠে আসে আর একটি প্রশ্ন, পুরুষতন্ত্র কী শুধু পুরুষের দ্বারাই আরোপিত হয়?নারী কী পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করে না? অন্দরমহলে যে নারী ,লিঙ্গবৈষম্যের বীজ বপন করে দেন শিশুর শৈশবস্থায় বা বাইরের দুনিয়ায় নিজের আপন ভাগ্য জয় করবার পথটিতে হাজারো বাঁধার বন্ধন সৃষ্টি করে আমাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করেন বা নারীর শ্রমের মূল্য দেওয়ার পরিবর্তে তা আবশ্যিক কর্তব্য বলে নির্দেশ দেন বা বধূ নির্যাতনে মদত দেন তিনি কী কম পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বহন করেন না?

অধীনতামূলক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে হতে আমরাও সয়ে গেছি ব্যক্তিজীবনের পরাধীনতা, চূড়ান্ত পরনির্ভরশীল জীবন যাপনের ধারাবাহিকতায়, ঘুমিয়ে থাকে আমাদের আত্মমর্যাদা বোধ, বা ঘুম পারিয়ে রাখে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। আর এই অবস্থায় এক অদৃশ্য শিকলের শৃঙ্খল জড়িয়ে যায় আমাদের চেতনায়, আর তা এতই কঠিন যে তা ছেঁড়ার শক্তিটুকুও অদৃশ্যে হরণ হয়ে যায়।

তবে রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’সূচনার অর্ধশতক পার করে আত্মবিশ্লেষণ পর্বে শুধু নারীর ব্যর্থতাই নজরে আসে না, সমাজের মননে যে গোঁড়া পুরুষতন্ত্রের গেড়ে বসেছিল সময়ের সাথে সাথে প্রতিবাদ ও নারী শিক্ষার প্রসারিত হওয়ায় তা অনেকটাই শিথিল ও পরিবর্তিত হয়েছে এবং বেগম রাকেয়া থেকে শুরু করে মহাশ্বেতা দেবী, সুকুমারী ভট্টাচার্য, অশাপূর্না দেবীর লেখনী নারীকে প্রবুদ্ধ করেছে চেতনার উন্মেষ ঘটাতে।অনেক পুরুষ লেখকের সাহিত্য, নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে চলচিত্র নির্মাণ নারীর আত্মমর্যাদা বোধের পক্ষে, আত্মনির্ভরশীলতার পক্ষে সহায়ক হয়েছে।নারী আজ বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধে, সন্তানধারণ বা যৌন ইচ্ছা অনিচ্ছার পক্ষে বা বিপক্ষে নিজস্ব বক্তব্য পেশ করতে পারছে।’গর্ভনিরোধক পিল’ -এর আবিষ্কার নারীর জীবনের অনেক বাধা দূর করেছে, এবং ধীরে ধীরে পুরুষের কুক্ষিগত পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে শিখেছে, আত্ম নির্ভরশীল হওয়ার শিক্ষা ও দ্বায়িত্ব সমাজ ও পরিবার যৌথ ভাবে নিয়েছে। দ্রুত কমতে শুরু করেছে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রভাব।

পরিশেষে নারীর আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতার আত্মবিশ্লেষণে ক্ষেত্রে পুরুষ কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী হয়ে থেকে যায়। ‘ধর্ষণ ‘নামক ক্ষতি টি নারীর জীবনে পুরুষের দ্বারাই ঘটে, এবং তা এক নারীর জীবনকে স্তব্ধ করে দেয় সারাজীবনের মতো। তাই বলি নারী ধর্ষণকে যতদিন একটি শারীরিক দুর্ঘটনা হিসেবে না ভাববে,এবং পরের উদারতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন কাটাবে অর্থাৎ সার্বিকভাবে নারীর চেতনার উন্মেষ না ঘটবে,ততদিন এই দিবস পালন কেবল একটি উৎসবের দিন হয়েই থেকে যাবে, যার অন্তরে লুকিয়ে থাকবে নারীর ব্যর্থতার অন্ধকার!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।