অবশেষে এল সেই প্রতিক্ষিত দিন।বাড়ির গৃহ প্রবেশ।বাবা বলেছিল,আগে থেকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গৃহ প্রবেশের দিন সকালেই যাওয়া হবে।
মা জানতে চাইল-পুজোর সব কিছু আয়োজন করতে হবে যে।
বাবা বলল,কোনো চিন্তা নেই। তুমি শুধু গিয়ে বেল বাজিয়ে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাবে।
মা আবার জিজ্ঞেস করল,হ্যাঁ গো কত লোকজন আসবে?তাদের খাওয়া দাওয়া কি হবে?
সব হয়ে যাবে।তুমি দেখো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা!
আমি জানি না,মা কখনো আমাদের মতো লুকিয়ে বাড়ি তৈরির সময় যেত কিনা!এই নিয়ে অবশ্য মাথা ব্যথাও ছিল না।কারণ আমরা তিনবোনই জানতাম বাড়িটা কেমন দেখতে হয়েছে।তবে সেটা ছিল আমাদের গোপন সিক্রেট।
গৃহপ্রবেশের দিনটা ছিল ৯জুলাই।১৯৮৬সাল।সেদিন রথ যাত্রা।
সকাল থেকে আমাদের ব্যস্ততা শুরু হল।আগের দিন রাতে মা আমার জন্য দুটো ম্যাগি হাতা হাইনেক গলার ব্লাউজ কিনে এনেছিল দমদম নিউমার্কেট থেকে।তখন পর্যন্ত আমাদের জানা মার্কেট ওই একটিই। গড়িয়াহাট, নিউমার্কেট এসব যেন স্বপ্নে শোনা জায়গা। হাতিবাগান মার্কেট দেখতাম মায়ের মামার বাড়ি যাওয়ার সময়।টাউন স্কুলের গলি দিয়ে গাড়িটা খানিকটা এগিয়ে ডান দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেত।তারপর সরু রাস্তা। গাড়ি আর ঢোকে না।আদি কলকাতা বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই।
বিশাল চৌকো বাড়ির মাঝখানটা উঠোন।আর ছাদগুলো সব কমন।এক ছাদের সঙ্গে আরেক ছাদের কোনো পাঁচিল নেই। আমরা এক ছাদে উঠে অনায়াসে পরপর অনেক গুলো বাড়ি চলে যেতাম।
সে তুলনায় আমাদের নতুন বাড়ি পুরো অন্য রকম।
ম্যাগি হাতা ব্লাউজ সে বছর নাকি সাংঘাতিক জনপ্রিয়। এর আগে মায়ের ব্লাউজ সেলাই করে পরেছি।এবার ভাবলাম,আমার নিজস্ব দুটো ব্লাউজ হল।কালো আর লাল। কিন্তু না,এ ধারনাটা ঠিক ছিল না।যদিও কাকিমা বলল,এ বাবা!বড় হল!দে টেকে দিই।কিন্তু আমার মনে হল,মায়ের মাপেই কেনা।অবশ্য এ ব্লাউজ পরে মা স্কুলে তো যেতে পারবে না।তাহলে!
অবশ্য ততক্ষণে কাকিমা সেলাই মেশিন নিয়ে বসে গেছে। কাকিমা আর মা একই সেলাই দিদি মনির কাছে সেলাই শিখত।কাকিমার ঘরের মেঝেতে বসেই এসব কাজ চলত।থান কাপড় কিনে এনে দুজনে মিলে আমাদের টেপ, জামা,স্কার্ট, ব্লাউজ, সায়া বানাতো।মোটামুটি আমরা তিনবোন আর রুমনি মানে কাকিমার মেয়ে একই থান কেটে জামা,টেপ, প্যান্টি সবই পরতাম।
তবু রুমনির জন্য বাবা বাইরে গেলে সুন্দর সুন্দর জামা নিয়ে আসত।আমাদের সেই থান কাপড়ে একই রকম।আর রুমনি কাকিমাকে মা বলত না।আমার মা’কে মা বলত,আমাদের সঙ্গেই থাকত।
আসলে কাকিমা যে আমার নিজের কাকুর বউ নয়,ছোড়দা কাকু যে বাবার নিজের ভাই নয়,এসব ভাবার কোনো অবকাশ ছিল না।
যাহোক,কাকিমা ব্লাউজ মুড়ে দিল। ঠিক হল সকালে লাল ব্লাউজ দিয়ে লাল শাড়ি আর বিকালে কালো ব্লাউজ দিয়ে হলুদ শাড়ি পরব।আর দুপুরে পুজো শেষ হলে চুড়িদার।আর বোনেরা ফ্রক। আমি বড় তাই শাড়ি।
সেই সময় আমি ক্লাস ফোর থেকেই যেকোনো অনুষ্ঠানে শাড়ি।সেটাই সভ্যতা।বাড়ির গৃহপ্রবেশের দিন তো অন্য কিছু ভাবাই যাবে না।অবশ্য শাড়ি নতুন নয়।
লাল শাড়িটা মায়ের।তাঁতের ।আর হলুদ একরঙা শাড়িটা বাবার সহকর্মী অনুবাদ পত্রিকার তৎকালীন সহ সম্পাদক কালিপদ কাকুর বউয়ের।আমাদের এমন দুর্দশার কি কারণ ছিল জানি না।তবে তাতেও কোনো অসুবিধা ছিল না।শাড়ি তো পাওয়া গেছে। এর আগেও সব অনুষ্ঠানেই কখনো কাকিমা, কখনো মাসি,কখনো স্কুলের দিদিমনি অনিতা দির শাড়ি।কাজেই ওগুলো নিয়ে ভাবতাম না।
এখন একটাই সমস্যা হল,লাল শাড়ির সঙ্গে সাদা শায়া বিচ্ছিরি ভাবে দেখা যাচ্ছিল।
তুলসী দি শাড়ি পরাবার সময় বলল,তোকে খুব সুন্দর লাগছে। কেউ শায়া দেখবে না।আর গিয়ে তো পুজোতে বসে যাবি,কাজেই অসুবিধা হবে না।
তুলসি দি হচ্ছে আমাদের মেন্টার।কাজেই সে যখন বলে দিয়েছে, জানতাম আর কিছুতেই কোনো চেঞ্জ হবে না।
যাহোক নতুন বাড়ি পৌঁছালাম সকাল আটটার মধ্যে। গিয়ে দেখি বাড়িটা চেনাই যাচ্ছে না।আলো দিয়ে ঘেরা।সামনে কলা গাছ দুদিকে মাটি দিয়ে পোঁতা।বাড়ির সামনে গরদের ধুতি আর গায়ে সিল্কের উত্তরীয় পরে বাবা, তার সামনে ঘিয়ে রঙের মেরুন পাড় সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়ি পরে মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে।তার কাঁখে একটা জলের বড় কাঁসার নাকি পিতলের কলসি।
মা বাবা কখন সেখানে পৌঁছে গেছে জানতেই পারিনি শাড়ি পরার চক্করে।আর মা আজও সেই এক শাড়ি।এই শাড়িতেই মা বিয়ে বাড়ি থেকে বাবার বন্ধুদের যেকোনো বড় পার্টিতে যেত।
আমরা কি গরীব? এক মুহূর্তের জন্য কথাটা মাথায় এলেও বাড়িটা দেখে সেই দুঃখ দূর হয়ে গেল।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে নিচে দুটো ফ্ল্যাট।সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা।আর দরজার সামনে দিয়ে সিঁড়ি।সেটা আবার পুরোটাই স্টিলের।এবং এমন ভাবেই যে তিনতলা থেকে একেবারে একতলা অবধি পুরোটা দেখা যাবে।দুটো সিঁড়ি অন্তর পেতলের ফুলদানি।তাতে রজনীগন্ধার স্টিক।পরবর্তী কালে ফুলের বদলে এগুলোতে প্ল্যাস্টিক বা কাপড়ের ফুল লাগিয়ে রাখা হত।তবে কয়েক বছর পর দেখা গেল,একটা একটা করে ফুলদানি চুরি যাচ্ছে। শেষ অবধি মা বাকি গুলো খুলে নিল।
তাছাড়া ফুলদানি গুলো তেঁতুল দিয়ে মাজতে হতো,নইলে কালো হয়ে যেত।
বাবা অবশ্য পেতলের বদলে কাচের ফুলদানি রাখার কথা বলল,কিন্তু মা আর রাজি হল না।
যাহোক ওপরে উঠে চক্ষু চড়কগাছ। দুদিন আগেও তো এসব দেখিনি এত ঝাড়বাতি,আলো,ফ্যান কবে কখন লাগানো হল!
একবার মনে হল এগুলো কি নাচের অনুষ্ঠানে যেমন ভাড়া নেওয়া হয় ফ্যান লাইট এমন,কিন্তু দেখে তো নতুন মনে হচ্ছে। এসব ভাবার মাঝেই দেখলাম পুজো শুরু হয়ে গেল।
এত বড় বাড়িটায় লোকে লোকারণ্য। এত লোক এলো কখন!সকালে তো কোনো বন্ধুকে বলা হয়নি।সবাই রাতে আসবে।মা দেখলাম একবার তুলসিদিকে বলল,এতলোকের রান্না কিভাবে হবে?
বাবা পুজো করতে করতে সে সময় উঠে এসে সিগারেট ধরিয়ে ছিল।বলল,চিন্তা করতে হবে না।ক্যাটারার বলা আছে।
নিচের ঘরগুলোতে এক ফাঁকে দৌড়ে দেখে এলাম।চেয়ার আর বেঞ্চ পাতা।বাইরের উঠোনে রান্না চলছে বিশাল দুটো উনুনে।
মাকে এসে সে খবর দিলাম।অসুবিধা হল, ক্রমাগত ভিআইপি দের গাড়ি আসায়।লাল নীল আলো,পুলিশের আগে এসে বাড়িটা দেখে যাওয়া…যারা স্থানীয় মানুষ তাদের কি মনে হচ্ছিল জানি না।
আমরা অবশ্য এসবে অভ্যস্ত।
অবশেষে চারটের সময় পুজো হোম যজ্ঞ শেষ হল।পুরোহিত সেই জটাধারী জ্যেঠু আর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে আগত এক সন্ন্যাসী।
খাওয়া শেষ করে ছুটে গলাম ইজ্জত কলোনির বাড়িতে। সেখানে তখন কেউই নেই। সবাই তো আমাদের নতুন বাড়িতে। আমরা গেলাম কারণ ড্রেস পালটাতে হবে।বোনেরা ফ্রক আর আমি আবার শাড়ি।এবার কালোর সঙ্গে হলুদ শাড়ি।
ফিরে এসে দেখি বাড়িটা ভরতি কীর্তন গাইয়েদের ভিড়ে।তারা এবার পালা করে নামসংকীর্তন,রাম লীলা,কৃষ্ণ লীলা শুরু করবে।যারা নাম সংকীর্তন করতে এসেছেন তাদের কাউকে কাউকে চিনি।এরা রবিবার রবিবার সকালে পাড়ায় কীর্তন গেয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা তোলেন।আর যারা এসেছেন তাদের মধ্যেও কজন কে চিনি।এরা মাজুতে থাকেন।বাবার ভক্ত সামন্ত কাকু যখন নিজে আসতে পারে না,তখন এই কাকুর হাত দিয়ে মাছ,মুড়ি,চিড়ে,হলুদ মুড়ি এসব পাঠান।
কিন্তু সে যে পালাগান করে জানতাম না।বাবা বলল,কেউ কোথাও যাবে না।সবাই বসে শুনবে যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে। শুধু নিচে গিয়ে বন্ধুরা এলে খাবার সময় ঠিক মতো খাচ্ছে কিনা দেখে আবার চলে আসবে।
সন্ধা ছটা থেকে টানা শুরু হল হরিনাম সংকীর্তন দিয়ে,পর পর নানা দলের নানা কীর্তন, পালা চলতেই থাকলো।অবশেষে রাত এগারোটায় শেষ হল।
এর মধ্যে শোনা গেল,দুবার নতুন করে রান্না বসানো হয়ে গেছে। কারণ মোটামুটি ভাবা হয়েছিল লোকসংখ্যা পাঁচশো মতো হতে পারে।রাত নয়টাতে সেই সংখ্যা আটশো ছাড়িয়ে গেছে।কাজেই বাবার বিশেষ বন্ধু মন্টু কাকু আর ছোটকা অশকা মিলে বেরিয়ে আবার চাল ডাল আনাজ নিয়ে এসেছেন। মিষ্টি এসেছিল পুরোটাই আজিমগঞ্জ থেকে।মালাই বরফি আর চমচম। সিঁথির সবচেয়ে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান মহুয়া থেকে দই,আর কে সি দাসের রসগোল্লা।
মেনু হয়েছিল পোলাও,ধোকার ডাল্লা,লুচি,ছানার কোপ্তা,আলুরদম,আর পাপড়, চাটনি।
তবে রাত দুটোয় আমরা যখন খেতে বসলাম তখন আর ছানার কোপ্তা বা ধোকা ছিল না।
এরপর তিনদিন টানা নতুন বাড়িতে থাকা।
এতদিন পুরনো বাড়ির একটা ঘরে কাটিয়ে এসে নতুন বাড়ির এত ঘর, এত জায়গা দেখে ভাবছিলাম এটাই বুঝি স্বর্গ।
কিন্তু কদিন পরেই বুঝতে পারলাম, আমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম দোতলা আর তিনতলাতেই সীমাবদ্ধ।কারণ একতলার পুরোটাই বাবা যখন যেখানে যেতেন সেখানে আমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে আসতেন।আর তারা যা-কিছু ঘটুক না কেন এসে থেকে যেত দীর্ঘ দিন।
প্রথম প্রথম মা’ই তাদের রান্না করত,পরে ঠাকুমা এ নিয়ে রাগারাগি করলে মায়ের সঙ্গে বাবা কথা বলা বন্ধ করে দিলেও নিচের লোকেরা যাতে নিজেরাই রান্না করে খেতে পারেন,তার জন্য একগাদা বাসন এলো।
কিন্তু হায়!যতবার তারা ফিরে যায়,নিচে গিয়ে সেসব বাসন,এমনকি চাদর পর্যন্ত আর পাওয়া যা না।অবশ্য বাবার তাতে কোনো হেলদোল ছিল না।