সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৯)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৯

চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে কেবল বলতে পেরেছিল — জানি না যাও। তাদের দুজনকে ওভাবে কথা বলতে দেখে হাজির হয় বোনেরা। হৃদয়দার হাত ধরে বলে — শুধু দিদির সঙ্গে কথা বললেই হবে ? আমরা বুঝি দিদির মতো সুন্দরী নয় বলে কথা বলা যাবে না ? দিদিটা ও আচ্ছা। হৃদয়দাকে আটকে একা একা গল্প করেছে।সে কপট রাগ দেখিয়ে বলে , হ্যা আমার আর খেয়ে দেয়ে তো কাজ কর্ম নেই , তোদের হৃদয়দাকে আটকে গল্প করব ? বৌভাতের হাজার রকম কাজ পড়ে আছে। কি করে সে সব সামালদেব তা ভেবে পাচ্ছি না। যা না, তোরা হৃদয়দাকে নিয়ে মনের সুখে গল্প কর না যত খুশী। বোনেদের এড়াতে তখন ওই কথাগুলো বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে অন্যদিকে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না তার।

যেতে যেতে দেখে বোনেরা উচ্ছল হয়ে উঠেছে। হৃদয়দার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে নতুন বৌ’য়ের কাছে। তার খুব আফশোষ হয়। সেও যদি থাকতে পারত ওদের সঙ্গে। আচ্ছা তার কথায় হৃদয়দা কিছু মনে করে নি তো — দোলাচলে পড়ে সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে শুনতে পায় হৃদয়দা বৌদিকেও হাসিঠাট্টায় মাতিয়ে তুলেছে। সে কান খাড়া করে সব শোনে। হৃদয়দার কথা তার কানে মধু ঢালে। একসময় বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় হৃদয়দা। দাদা তাকে এগিয়ে দিতে যায়। দরজার পা রাখার সময় দাদার দৃষ্টি এড়িয়ে একবার চোখ তুলে তাকায় হৃদয়দা। আর তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। বুকংভিতর যেন পাহাড় ভাঙার শব্দ পায় অঞ্জলি। উদাস দৃষ্টিতে সে দরজার দিকে চেয়েই থাকে, টের পায় না কখন হৃদয়দা চলে গিয়েছে।

আচমকা দিদির গলা পেয়ে তার টনক নড়ে। দরজা পার হতে হতে দিদি বলে — কি রে , দরজার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছিস যে ? তুই কি করে জানলি আমি এইসময় আসব ? দিদির কথা শুনে খুব অস্বস্তিতে পড়ে যায় অঞ্জলি। সে তো আর বলতে পারে না তার আগমনে নয় , সে হৃদয়দার গমনপথের দিকে চেয়েছিল। ছুটে গিয়ে দিদিকে জড়িয়ে ধরে অঞ্জলি। বিয়ের পর একেবারে অন্যরকম লাগছে। কেমন একটা সুখী সুখী ভাব দিদির চোখে মুখে। কথাবার্তাতেও দিদি-দিদি ভাব। অথচ এতদিন তারা বন্ধুর মতো ছিল। এ পরিবর্তন শুধু দিদিরই নয় , বিয়ের পর প্রায় প্রতিটি মেয়েরই হয়। তাদের পাড়াতেই মালতিদি , জ্যোৎস্নাদি, ফুলমনিদিদের বিয়ের পর প্রথম বাপেরবাড়ি আসার পর দিদির মতোই অন্যরকম লেগেছিল। আচ্ছা সে’ও কি ওইরকম পাল্টে যাবে।

নিজের বিয়ের কথা ভাবতেই কোথাই যেন হারিয়ে যায় অঞ্জলি। মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি। আর তা দেখে দিদি বলে, আরে তোর হলোটা কি ? কোথাই হারিয়ে গেলি ? শুধু শুধু হাসছিস যে বড়ো ? দিদির কথায় থতমত খেয়ে যায় সে। তাড়াতাড়ি দিদি-জামাইবাবুর হাত ধরে সে নতুন বৌদির ঘরে পৌঁচ্ছে দিয়ে বৌভাতের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাত পোহালেই বৌভাত। হাজারও কাজ বাকি। দু’রকম ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সমাজের খাদ্যাভাস অনুযায়ী শুয়োরের মাংস আর হৃদয়দা , পরানকাকু , তারা কয়েকজন মাস্টারমশাইয়ের মতো কিছু নিমন্ত্রিতের জন্য অন্যরকম ব্যবস্থা করতে হবে।গ্রামের অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রে বাইরের ওইসব নিমন্ত্রিতদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সে তো আছেই, দাদা হৃদয়দাকে’ও তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে। সেইসব ব্যবস্থা করতেই বেশ রাত হয়ে যায়। বাকি রাতটুকু দিদির সঙ্গে গল্প করেই কেটে যায়।

সকাল হতে না হতেই অঞ্জলি অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রের রান্নাবান্নার তদারকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌছোয় হৃদয়দা। তাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না অঞ্জলি। এমনিতে সুঠাম চেহেরা হৃদয়দার। তার উপরে পড়ে এসেছে নীল পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা। সবার মাঝেই আলাদা করে চোখ টেনে নেওয়ার মতোই অন্যরকম লাগছে তাকে। সে’ও চেয়ে থাকে অপলকে। হঠাৎ দেখে হৃদয়দাও তার দিকে চেয়ে আছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। সে দ্রুত অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জার চাইতেও কখন কার চোখে পড়ে যায় সেই আশংকায় অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হয়। হৃদয়দা কিন্তু এগিয়ে এসে তার সামনেই দাঁড়ায়। আর তার বুক ধুকপুকানি কয়েকগুন বেড়ে যায়। হৃদয়দা বোধহয় তা টেরও পায় না। তাই সরাসরি তার চোখে চোখ রেখে বলে , যা সেজেছো না, তোমাকে সিনেমার হিরোইনদের মতো লাগছে।
— আর যে বলছে তাকে বুঝি দেখতে খুউব খারাপ লাগছে ? ভাববাচ্যে জবাবটা দিয়ে কাজে মেতে ওঠে অঞ্জলি। হৃদয়দাও মেতে ওঠে তদারকিতে। দিনভর নিমন্ত্রিতদের খাইয়ে অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রে শেষ ব্যাচে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে খেতে বসে হৃদয়দাও।

খেতে শুরু করার পর দেখে এখানেও অজান্তেই সেই মুখোমুখি বসে পড়েছে তারা। খুব অস্বস্তি হয় তার। আত্মীয় স্বজন, দিদি- বৌদি, দাদা, বোনেরা সবাই রয়েছে। তাই মুখ নামিয়ে খেতে থাকে সে। খুউব ইচ্ছে হয় হৃদয়দা তার দিকে চেয়ে আছে কিনা তা একবার দেখে। কিন্তু লজ্জায় তা পারে না। ভালো করে খেতেও পারে না। খাবার খুঁটেই যায়। খাওয়া – দাওয়ার পর হৃদয়দা সবার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে দাদার চোখ এড়িয়ে আগের বারের মতোই আরও একবার তার দিকে তাকায়। সেও চোখাচোখি হওয়ার আশায় আড়চোখে চেয়েছিল। চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে পড়ে সে। বিষয়টি চোখ এড়ায় না দিদির। তাকে একা পেয়ে দিদি এক সময় বলে — কি ব্যাপার রে , হৃদয় বলে ওই ছেলেটা সকাল থেকে দেখছি তোর পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করছে ?
—– কি আবার ব্যাপার হবে , দাদার বন্ধু। দাদা ওকে বাইরের লোকেদের দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিল।
দাদার দোহাই দিয়ে দিদির প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিল সে। বলতে পারে নি হৃদয়ের কাছেই বাঁধা পড়ে গিয়েছে তার হৃদয়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।