ক্যাফে গল্পে অজন্তাপ্রবাহিতা

[ আজকের গল্পের প্রেক্ষাপট আসামের মনোরম শহর ডিগবয় ]

অরিজিনাল

ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব সীমান্তের একটি ছোট শহর ,ডিগবয়। যদিও দেশের মানচিত্রে এই শহরের নাম উল্লেখ আছে তবে আসামের বাইরে বেশির ভাগ দেশবাসীই এই শহরের নাম শোনে নি। কারো কাছে আসাম গুয়াহাটিতেই শেষ হয়ে যায় কেউ বা ভাবে ভুল করে ডিব্রুগড় বলতে গিয়ে ডিগবয় বলে বসেছে। এই শহরের ইতিহাস শুধুমাত্র গুগলের কাছে অংশ মাত্র। নব প্রজন্মের কারোই এশিয়ায় এই প্রথম তৈলনগরীর কথা মনে নেই।
কিন্তু এই শহর আজও দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল সরবরাহ করে চলেছে। শহরের আনাচে কানাচে আজও সাহিত্য ও সংগীত চর্চা হয় পুরো দস্তুর মতো।
প্রথম লকডাউন আনলক হবার পরে রোহন বাবা মায়ের সাথে ডিগবয়ে এসেছে দাদুর বাড়ি। আসার পর থেকেই ওর কৌতুহোল আর জিজ্ঞাসার কোনো অন্ত নেই। যাই দেখছে সবই নতুন। সবটাই সত্যি।
“রোহন, অনেক হয়েছে, এবার বিছানায় এসো। রাত দশটা বাজে। এবারে কিন্তু পাপা বকুনি দেবে ।আমি কিন্তু মোটেও সেভ করবোনা তোমায়।”
মায়ের বকুনির দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রোহন এক মনে দেয়ালে লাগানো ইলেক্ট্রিক সুইচ গুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
কেমন কাঠের বোর্ডের ওপরে গোল গোল বড় বড় সুইচ,নিচের অংশটা অফহোয়াইট, কালারের ওপরের অংশটা ডার্ক ব্ল্যাক।মাঝখানে একটা নব।ওপরে করলে লাইট জ্বলছে আর নীচে করে দিলে লাইট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
“জানো পাপা,আমি এই সুইচটা ‘ডিসকভারি’তে দেখেছিলাম। তোমার বাড়িতে কি সুন্দর এগুলোকে ‘টাচ’ করতে পারছি!
It’s a great feeling, papa”.
ন’বছরের রোহনের বিস্মিত চোখ দুটো দেখে মুচকি হাসলো ঋষভ।বাচ্চাদের মনে সর্বদাই নতুনকে পরখ করবার ইচ্ছে থাকে,রোহনের সেই ইচ্ছেটা একটু বেশি। সব কিছু গোড়া থেকে বোঝা চাই। তাহলে ওর শান্তি। আদর করে ওর চুল গুলো নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এবার শুয়ে পড়ি চলো।কাল ভোর বেলা দাদুর সাথে বাগানে কাজ করতে যাবে।”
“ok, papa”।
রোহন দিল্লী নিবাসী। বয়স মাত্র নয় বছর।
এত বছর ধরে বাবা মায়ের সময়ের অভাবে দাদুর বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠে না। দাদু থাকেন ডিগবয়। দিল্লী থেকে বড্ডো দূরে। সেই কোন ছোট্টবেলা দাদুর বাড়ী এসেছিল তার কোনো স্মৃতি আজ ওর মনে নেই । এবারে ঠাকুমার জেদে বেশ অনেক দিনের জন্য দাদুর বাড়ি আসা । করোনার জন্য এখন মা ও বাবা দুজনেই বাড়িতে বসে কাজ করতে পারে,ওরও স্কুল বন্ধ। অন লাইন ক্লাস। কাজেই সেই সুযোগে দাদুর বাড়ি এসে একটু থাকলে মন্দ কী !
পিসীরাও আছে । দাদু ঠাকুমার সাথে সময় কোন দিক দিয়ে কেটে যাচ্ছে,বুঝতেই পারা যাচ্ছে না।
কাল সকালে দাদু ধনেপাতা গাছ লাগাবে।
স্কুলের জি .কে . বইয়ের দৌলতে সব ভেজেটেবিলের নাম‌‌ ওর মুখস্ত। কিন্তু কখনো সেগুলো মাটিতে জন্মায় কিভাবে তা কখনো দেখা হয় নি।
দাদু সকাল বেলা চা জলখাবার খেয়েই বাগানে লেগে পড়ে।সঙ্গী রোহন।
দিল্লীতে সবার বাড়িতে ও কিচেন গার্ডেন দেখেছে।এখানে বাড়ীর পেছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে দাদুর বাগান।সেখানে অনেক গাছের সম্ভার।পেয়ারা,কাঁঠাল,সুপুরী, কুমড়ো, আরো কত‌ নাম না জানা গাছ।
একপাশে ঠাম্মির ফুলের গাছ।সেখানে সারি দিয়ে ফুটে আছে মরশুমী গাঁদা ফুল আর ডালিয়া ।‌এছাড়া কত‌‌ রঙের জবা, টগর,শিউলি, স্থলপদ্ম আর কত কি।সব ফুলের নাম রোহনের জানা নেই। ঠাম্মি প্রতিদিন বাড়ীর ফুল দিয়েই পুজো করে।এখানে বাজার থেকে ফুল কিনে আনার কোনো চল নেই।একপাশে ছোট্ট করে’ তুলসী বন’ আছে।যার পাতা দিয়ে ঠাম্মী রোজ সবাইকে কাড়া বানিয়ে দেয়।
বেশ কিছুদিন থেকে দাদু গোটা ধনে জলে ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে জারমিনেট করছিল।ছোট্ট ছোট্ট শেকড় বের হলে সেগুলোকে এক এক করে মাটিতে পুঁতবে।সেখান থেকে ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর ধনে গাছ হবে।ভাবতেই রোহনের ভীষন এক্সসাইটেড লাগছিল।
ডিগবয়ে আসার প্রথম দিনেই দাদু বাগানের গাজর তুলেছিল। সেই দেখে রোহনের কী আনন্দ।
“Wow! Dadu ! It’s amazing”.
এমনিতে ওকে সবজি খাওয়াতে গিয়ে নিশাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। বাগানের তাজা গাজরের সবজি হাতের কাছে পেয়ে ও নিজেই চেটেপুটে খেয়ে নিল। নিশা আর ঋষভ অবাক। এতো মিরাকেল।যেই ছেলের খাওয়া নিয়ে বাড়িতে রোজ কুরুক্ষেত্র লেগে থাকে, সে কি না নিজের হাতে সবজি খাচ্ছে।
কিছুদিনের মধ্যেই ধনে গাছ গুলো বড় হলো।ফাঁক পেলেই দাদুর টর্চ হাতে নিয়ে বাগানে ছোটে, গাছ গুলো কেমন আছে দেখবার জন্য। ঘাসের ডগায় ছোট্ট ছোট্ট টুনি বাল্ব জ্বলতে নিভতে দেখে খুব অবাক হয়।টর্চ বন্ধ করে আলো গুলো ভালো করে দেখার চেষ্টা করে।তারপরেই ছুটে এসে বাবাকে টানতে টানতে বাগানে নিয়ে যায়,”see papa! How amazing.”
“এগুলো fireflies…জোনাকী। রাতের অন্ধকারে দেখা যায়।আমরা যখন ছোট ছিলাম,তখন এই জোনাকীদের সাথে আমাদের খুব বন্ধুত্ব ছিল।এদের ধরে বোতলে ভরে ঘরের একপাশে রেখে দিতাম।”
“How did they breathe?”
“বোতলের মুখে ছোট্ট ছোট্ট ফুটো করে দিতাম যাতে এরা হাওয়া পায়। রাতে যখন লোডশেডিং হতো তখন আবার এরাই আমাদের আলো দিতো।”
বলতে না বলতেই আলো চলে গেলো।চারিদিক নিস্তব্ধ অন্ধকার।ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে,আর ঘাসের ডগায় জোনাকীরা হাওয়ার সাথে দোল খাচ্ছে। অবাক হয়ে রোহন দেখছে সেই দৃশ্য।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রোহণের ঠাম্মী হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ওদের ডাকতে এলো।
আরেক বিস্ময় ওর সামনে ,” Papa! This is Harican ,I know I have seen this at Delhi Hut, no?”
হ্যাঁ বেটা।আমরা ওখানে হ্যারিকেন দেখেছিলাম। দেয়ালে সাজানো ছিল।ছোট্ট ছোট্ট হ্যারিকেন।ওর ভেতরে ছোট্ট জিরো পাওয়ারের বাল্ব ছিল আর এই হ্যারিকেন জ্বলছে কেরোসিন দিয়ে।”
“Ok, papa…
Papa! Can I request you something? Can’t we stay here in Digboi and enjoy all these original beautiful things?”
রোহনের কথা গুলো শুনে ঋষভ মনে মনে ভাবলো, আমিও তো তাই চাই বেটা। সব কিছু অরিজিনাল।ভালোবাসা,আদর,স্নেহ,মমতা।সেগুলো দিল্লীর কংক্রিটের জঙ্গলে কোথাও পাওয়া যায় না।অনেক হলো বড় শহরের মায়া, আর নয়। এবার সব কিছু অরিজিনাল চাই আবার। ক্যারিয়ার এর স্বার্থে আমরা সবাই এই অরিজিনাল জিনিস গুলো থেকে অনেক দূরে। সেখানে এইসব কিছুই নেই। আবার ফিরে পেতে চাই যা কিছু হারিয়ে গেছে,হারিয়ে যাচ্ছে।
চল সোনা ! তুই আর আমি আমরা চেষ্টা করি এই অরিজিনাল বিউটিফুলকে চিরকালের জন্য ধরে রাখার চেষ্টা করি । রোহনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে চেপে বললো,”I will try to stay here forever,Beta. Let us enjoy all original things in our life.”
Delhi hut – উত্তর ভারতের নামকরা রেস্তরাঁ
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।