অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ১৯)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

বন্ধু , শুধু একবার ফিরে যেতে দাও,
সেই সব আশ্চর্য কলরব ঘিরে ;
মুঠো মুঠো নীলাকাশ,নদীর বাতাস ,
বেঁচে থাকা,বেঁচে ওঠা, সুনিশ্চিত, ধীরে…

ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ যেন একটা অনন্য অনুভূতি বয়ে আনলো উন্মনার তরঙ্গহীন জীবনে। অনেকটা বাসের পথ পেরিয়ে বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির চেনা গন্ধের গেটে যখন সে পৌঁছলো , তখন সমবেত অতীত যেন ওকে ডেকে বললো– এতদিন কোথায় ছিলে একা , রোদ বৃষ্টি ঝড়ে আমি পাইনি তোমার দেখা। পথের দুধারে কাজুবনের বয়স একটু বেড়েছে এই যা। নতুন পাতারা যেন পুরোনো পাতাদের কানে কানে বলছে–আমাদের খুব প্রিয় একজন ফিরে এসেছে।তোমরা বুঝতে পারছো ? দূরে অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ বিল্ডিং পেরিয়ে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছগুলোও যেন চিনতে পারলো ওকে। পথের ধারে ঘাসের ওপর লাল নীল সবুজের মেলা বসে গেছে। ডিগ্রি কোর্সের সিরিয়াসনেস থেকে মাস্টার্সের অনিবার্য হাতছানিতে ঠিক ওদের মতোই নতুন ছেলেমেয়েদেরও এই বিশ্ববিদ্যালয় বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছে। উন্মনার মনে হলো — প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় যেন অন্তহীন এক মহাকাব্য।সময় ও পড়াশুনোর পরিবেশ তাকে আভিজাত্য দেয় ক্রমশ। কিন্তু তার শরীরে কখনোই মরচে ধরে না। সাংবাদিক অমলেন্দুর সময়ে যেমন ছিল , উন্মনাদের সময়ে যেমন ছিল , আজও ঠিক তেমনি আছে । শীত শেষে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের মতো ফুটে আছে আজকের যৌবন । আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টের আলাদা আলাদা আড্ডা। ফিজিক্স ,ম্যাথামেটিক্স , জুলজি,বোটানি , ইকনমিক্স ,ফিলোজফি , বাংলা অথবা ইংরেজি ডিপার্টমেন্টগুলোর টুকরো টুকরো আড্ডা থেকে যে শব্দতরঙ্গ ভেসে আসছে ,তার থেকেই উন্মনার অভিজ্ঞ ‌অনুভূতি বুঝিয়ে দিচ্ছিলো,কে কোন বিভাগের।
উন্মনা সবসময় বিস্মিত হতে ভালোবাসে। মনে পড়ে গেলো , আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে পুরোনো ক্যান্টিন থেকে ঘুগনি চপ মুড়ি চা দিয়ে যেতো মাঝবয়সী খোকনদা , সকলের বন্ধু খোকনদা। তার জায়গায় হয়তো অন্য কেউ এসে চা এর ভাঁড় হাতে হাতে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে । যেন সেই এস ওয়াজেদ আলির ভারতবর্ষ গল্পের মতো। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে…
ভাবতে গিয়েই ফিক করে হেসে উঠলো উন্মনা। ট্র্যাডিশন আর প্রেম শব্দদুটো কী সুন্দর অথচ কী গভীর , তাই না ? উন্মনা-মন উন্মনা অবাক হয়ে শুনলো — কোনো একটা আড্ডার মধ্যে থেকে একটি মেয়ে আশ্চর্য সুরেলা গলায় গেয়ে উঠেছে — মৌ বনে আজ মৌ জমেছে বউ কথা কও ডাকে…
হেমন্তের কালজয়ী গান , অথচ মেয়েটির গলায় কী মিষ্টি লাগছে ! এই ক্লাসিক গানটির পাশাপাশি অন্য একটি আড্ডা থেকে ভেসে আসছে এখনকার গানের কলি–তুমি যাকে ভালোবাসো ,স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো…
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন্য দলের সমবেত কন্ঠে — পথে এবার নামো সাথী ,পথেই হবে এ পথ চেনা…
জিনস-টপ ,শাড়ি , চুড়িদার… গান কবিতা আর , আমরা চঞ্চল যৌবনের এই মহা সমাবেশ দেখে উন্মনার খুব ইচ্ছে করছিলো দৌড়ে গিয়ে ওদের দলে মিশে যেতে।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করেই ক্যান্টিনে উঁকি মারলো না সে । কী জানি , খোকনদাকে যদি আর দেখতে না পায়। সেই খোকনদা– গোঁফের নীচে, ঠৌঁটের কোণে একটু হাসি । ঘুগনি মুড়ি চা দিতে এসে উন্মনাকে প্রায়ই বলতো — দিদিভাই , সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতাটা একবার শোনাবে ? আর , জীবনানন্দের আবার আসিব ফিরে ,‌ শোনাবে ?
অফিসের কাউন্টার থেকে মাস্টার্স-এর সার্টিফিকেট নেওয়ার সময় মাঝবয়সী স্নেহশীল দাসবাবু কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। উন্মনার খুব ইচ্ছে করছিলো ভেতরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে । সেটা না পারলেও তার নিষ্পাপ হাসিমুখেই ভদ্রলোক যেন প্রণাম খুঁজে পেলেন। হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই ফোনটা বেজে উঠলো ।
— হ্যালো , আমি অমলেন্দু স্যার বলছি। ইউনিভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে আছি ,আপনি কোথায় ?
— আমার কাজ হয়ে গেছে,আপনি কি ভেতরে আসবেন ?
— না না , ভিতরে গেলেই হাজারটা খবর আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সাংবাদিক তো , যেখানই যাই নতুন নতুন খবরের গন্ধ পাই আমরা।তাছাড়া , ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষা জগতের অনেক খবর থাকে । কিন্তু না ,আজ আমি শুধু আপনার কাছেই এসেছি ।
পয়লা ফাল্গুনের এখনও বেশ কয়েকদিন দেরি । তবুও অমলেন্দুর এই কথাটা উন্মনার মনে যেন নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগিয়ে দিলো…
উন্মনার জীবনের অনেকগুলো প্রদীপ নিভে গিয়েছিল । কবিতার জীবন একেকটা করে যেন সেই দীপগুলো আবার জ্বেলে দিচ্ছে । কোনোরকমে বলতে পারলো– আপনি গেটে দাঁড়ান , আমি এখুনি আসছি ।
— হ্যাঁ তাড়াতাড়ি আসুন। গেটের পাশে একটা ঠেলাগাড়িতে গরম চা তৈরি হচ্ছে । আপনি এলেই মাটির ভাঁড়ে চা খাবো ।
ফোনটা কেটে দেওয়ার পর উন্মনার অন্তহীন হৃদয় যেন বলে উঠলো — বয়সে কত বড় এই মানুষটা এখনও কী দারুণ রোমান্টিক ! মাটির ভাঁড়ের চা’কেও তিনি ভীষণ মূল্য দিতে জানেন । বাহ্ !
উন্মনার পায়ের গতি বাড়লো। যেতে যেতে শুনলো আরেকটি গানের কলি — এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো , এ কেমন কান্না তোমার আমায় যখন আদর করো…
অমলেন্দুর সঙ্গে দেখা করার আগে উন্মনার ফিসফিস ঠোঁটে কবি জীবনানন্দ–
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…
উন্মনা আজ পরেছে বাসন্তী জমির তিনপাড় তাঁতের শাড়ি , কাঁথা স্টীচের কাজ করা মেরুন ব্লাউজ । দৌড়োদৌড়ি হুড়োহুড়ির সহজ পোষাক চুড়িদার বা জিন্স কুর্তি নয় ,উন্মনা আজ নিজেকে সাজিয়েছে শান্তিপুরি শাড়ির স্নিগ্ধতায় । সঙ্গে শান্তিনিকেতনের ঝোলা ব্যাগ। কপালে মেরুন টিপ আর খোলা চুল। ঠিক যেন শেষের কবিতার পাতা থেকে উঠে এসেছে চিরদিনের লাবণ্য।যেন কথাসাহিত্যিক বিমল করের আধুনিকা কোনো নারী চরিত্র , শিল্পী সুধীর মৈত্রের আঁকা ছবিতে জীবন্ত হয়ে গেছে উপন্যাসের প্রচ্ছদে। যেন ঘরে বাইরের বিমলা আর স্ত্রীর পত্র-র মৃণাল পাশাপাশি হাঁটছে কবিমন-নারী ,কবিতার নারী উন্মনার সঙ্গে।
দুরুদুরু বুকে গেটের মুখে এসে বাঁ দিকটায় চেয়ে দেখতেই অবাক হয়ে গেল কবি উন্মনা । যেন জীবনযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক , অভিজ্ঞ সাংবাদিক অমলেন্দু মন্ডল নয় , একটু বয়স্ক ঋতুরাজ আগামী বসন্তের পলাশের ডাল হয়ে নেমে এসেছে এই চৈত্রের দুপুরে।হাল্কা ব্রিক কালারের হাঁটুঝুল পাঞ্জাবিতে সদ্য ফোটা কিংশুকের ছোঁয়া। সঙ্গে ব্লু জিনস। কিন্তু পায়ের চটিটা একটু অন্যমনস্ক ও পুরোনো।সামান্য ভুরু কোঁচকাতে গিয়েও উন্মনার নারীমন রাধাচূড়ার পাপড়ি হয়ে গেলো। সুভদ্র ও শান্ত অমলেন্দু স্যার নিঃশব্দে হাসছেন। সেই হাসিতে এক আকাশ বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি। অমলেন্দুর বাড়ানো হাতে হাত রেখে উন্মনা এই — সেদিন চৈত্রমাস বেলায় বুঝতে পারলো , না না , উপলব্ধির অতলে গিয়ে বুঝতে পারলো– নির্ভরতা শব্দের নতুন মানে।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।