অনুপম বাবু তার দক্ষিণের বারান্দায় বসে আছেন আনমনে — সামনে খোলা কাগজ– দৃষ্টি যেন অনেকদূরে প্রসারিত — গভীর ভাবনায় মগ্ন–।
বারান্দায় গ্রিল বেয়ে উঠে গেছে পাতাবাহার — এটা কোয়েল লাগিয়েছিল– বড় গাছ ভালোবাসত মেয়েটা — কতরকম যে ফুলগাছ এনে লাগাত তার ঠিক নেই — একদিন ওর মা বলেছিল যে মেয়ে তো লাগিয়ে খালাস — যত্নের বেলায় মা করবে–।
আদর্শবাদী প্রফেসর ছিলেন তিনি– এখন অবসর গ্রহণ করেছেন–। জীবনের চরম পরিস্থিতিতেও সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা রেখে চলেছেন — কখনও কোন অবস্থাতেই সত্যের পথ থেকে সরে আসেন নি — মেয়েকে ও সেই আদর্শে বড়ো করে তুলেছিলেন — এখন মনে হয় ভুল করেছিলেন — যেখানে সর্বত্র মিথ্যা আর স্বার্থের হানাহানি — সেখানে একা একজন সত্যকে আঁকড়ে থেকে কতটুকু প্রতিকার করতে পারবে–? হয়তো তাঁর শেখানো এই আদর্শের পথে চলতে গিয়ে মেয়েটা অসময়ে নারীত্বের লজ্জা সম্মান হারিয়ে প্রাণ দিল—। কি করতে পেরেছিলেন তিনি? কয়েকদিন কাগজে খুব লেখালেখি হল–” বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামে এক যুবতী সাংবাদিককে ধর্ষণ করে নির্মম ভাবে খুন করা হয়েছে — পুলিশ তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পাশের ডোবা থেকে–। তিনি তো এর বিচার চেয়েছিলেন? পেয়েছেন কি? তার কোয়েল তো চলেই গেল– কিন্তু আরও অনেক কোয়েল তো আছে — তাদের তো রক্ষা করতে হবে–।
কেউ কেউ মন্তব্য করেছিল — মেয়ে হয়ে কি দরকার ছিল সাংবাদিকতা করার –? অসময়ে প্রাণটা তো গেল — সেই সাথে সম্মানটাও গেল– বাবা মায়ের মুখে চুনকালি পড়লো — এ কথা বলেছিলেন তাঁরই নিজের বড়ো দিদি–।
তিনি প্রতিবাদ করে বলেছিলেন চুনকালি? কিসের চুনকালি? যে সমাজ এখনও মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারেনা সেই সমাজের মুখে চুনকালি — আমার নয়– আমি নিজেকে এক গর্বিত পিতা বলে অহংকার করি — আমার মেয়ে সত্যকে উদঘাটন করতে গিয়ে কিছু নর পিশাচের হাতে বলি হয়েছে –।
স্ত্রী জয়া এলো চায়ের কাপ নিয়ে —
— কি কি ভাবছ কাগজ খুলে–
অনুপম বাবু হতাশ চোখে চেয়ে বললেন — আজ আবার একটি ধর্ষণ — একটি নার্স ফিরছিল সারাদিনের ডিউটি সেরে বাড়িতে — বাইপাস ছাড়িয়ে একটু নির্জন জায়গায় তার বাড়ি– একটু রাত হয়ে গিয়েছিল – নার্সের ডিউটি তো ইমার্জেন্সি থাকলে অনেকসময় রাত হয়ে যায়– অটো পায়নি বেচারা মেয়েটা- ব্যাস কয়েকজন হিংস্র পশু একটি অসহায় মেয়ের প্রতি তাদের পৌরুষ দেখালো —
আর একটি কোয়েল চলে গেল সেই একই নির্মমতায়– আরও কত কোয়েল এভাবে চলে যাবে বলতে পারো? ওদের সংসার চলত মেয়েটির রোজগারে–? কে লড়বে ওদের হয়ে?
আমি তবু নিজের যতটুকু ছিল তাই দিয়ে চেষ্টা করে গেছি– হুমকিও কম আসেনি তারজন্য — তবু লড়েছিলাম যাতে আমার কোয়েল মায়ের মতো যেন আর কোন বাবা মায়ের কোল খালি হয়ে যায়। যেন একটা সঠিক বিচার হয়– শেষ পর্যন্ত পেয়েও ছিলাম — ওদের চারজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল — কিন্তু কি হল? সেই তো একই অবস্থা চলছে–
— পুলিশ সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে — কয়েকদিন বাদে হয়তো টাকার জোরে বাবা কাকারা ছাড়িয়ে আনবে– আর কোর্ট বলবে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেওয়া হল–।
এরাই সমাজের বুকে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর এক একটি মেয়ের সর্বনাশ করে যাবে– আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই আঙুল দেখিয়ে বলবে এর মেয়েটা ধর্ষিত হয়েছিল– আমাদের পরিচয় কি? না ধর্ষিতার পিতা মাতা–।।