• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ৫

মর্তকায়ার অন্তরালে

||পাঁচ ||

ক্ষিতিমোহন লিখলেন
অমৃতসর| ১৮ই ফাল্গুন ১৩১৪
প্রণতিপূর্ব্বক নিবেদন ,
আপনার পত্রখানা পাইয়া আমার প্রাণে যে কি করিতেছে তাহা জানাইতে পারি না | সাহিত্যের প্রসাদে আপনি আমাদের আত্মীয় হইতেও আত্মীয় | তাই নিঃসঙ্কোচে আপনাকে পরমাত্মীয়ের ন্যায় সব কথা লিখিয়াছি এবং লিখিতেছি |
আমার পত্র পড়িয়া আপনি যে ভাবিয়াছেন আমি বোলপুর যাইতে ইচ্ছা করি না – ইহা আপনি ভুল বুঝিয়াছেন | এবং তাহাতে আমার প্রতি প্রচণ্ড অবিচার করিয়াছেন | প্রকৃতপক্ষে আমি যে সেখানে যাইতে কত গভীরভাবে ইচ্ছা করি তাহা জানাইতে পারি না | সেবাবিমুখ জীবন লইয়া পবিত্র হিমারণ্যে বসিয়া আমি শক্তি পাই না | দেখি বড় বড় নদনদী শত শত পাষাণস্তূপ অতিক্রম করিয়া তাহাদের নির্ম্মল জলধারা লইয়া মলিন দেশের সেবা করিয়া মলিন হইয়া নিজেকে সাগরজলরাশিতে উৎসর্গ করিতে চলিয়াছে , আমিই কেবল ইহাদের তীরে পাষাণের ন্যায় এই সেবাব্রতের মূকসাক্ষী মাত্র হইয়া রইলাম | এক একদিন দেশজননীর দান অন্নগ্রাস তপ্ত অঙ্গারের ন্যায় বোধ হয় | হায় , ব্রতহীনের জননীর এই দানে কি অধিকার আছে ?
আমি বিবাহিত – পরলোকগত জেষ্ঠ্যের পরিবার ও সন্ততি ও বিবাহযোগ্য কন্যার ভার আমার উপর | বৃদ্ধ পিতামাতা ; তাই আপনাকে এত পত্র লিখিয়া বিরক্ত করিতেছি | আমার কমপক্ষে ১০০্ হইতে ১৫০্ টাকার প্রয়োজন | এখন ১০০্ বাৎসরিক ১০্ বৃদ্ধি হইলেই হইবে | ইহা আমার কথা , আপনার নয় | যদি বোলপুরে যাই তবে কায়মনোবাক্যে সেখানকার কাজে নিযুক্ত হইব এবং আশ্রমের সেবা আমার শ্রেষ্ঠ ব্রত হইবে |
ইতি
শ্রী ক্ষিতিমোহন সেন
১৯ শে ফাল্গুনের পর ২৫শে ফাল্গুন রবীন্দ্রনাথের আর একটি ছোটো চিঠি পাই , যেখানে রবীন্দ্রনাথ অনন্ত সময় ধরে অপেক্ষার কথা বলেছেন | চিঠিটা এইরূপ:
ওঁ
শিলাইদহ
সবিনয় সম্ভাষণপূর্ব্বক নিবেদন
সময় সমন্ধে কোনো সীমা না বাঁধিয়াই আপনার জন্য অপেক্ষা করিব | যাহাতে আপনার ক্ষতি না হয় তাহাই করিবেন এবং যত শীঘ্র পারেন আমাদের জালে আসিয়া ধরা দিবেন | ইতি ২৫ফাল্গুন ১৩১৪
ভবদীয়
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৬শে ফাল্গুন ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রনাথকে যে টিঠিটা লিখলেন তা ১৯শে ফাল্গুনের চিঠিতে যে আহ্বান রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে ছিলেন ক্ষিতিমোহন তা অস্বীকার করতে পারলেন না | কারণ ক্ষিতিমোহনের মন এখন দ্বিধাশূন্য | কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে নদীর উপমা ব্যবহার করেছেন কেবল ক্ষিতিমোহন সেটার সঙ্গে একমত নয় | সমুদ্রের অভিমুখে তিনি যাবেন পবিত্র হতে | চিঠিটা একবার দেখে নিই :
সপ্রণাম নিবেদন ,
অদ্য আপনার পত্র পাইলাম | আমার পূর্ব্ব প্রস্তাব ( ১০০্ টাকা বার্ষিক ১০্ টাকা বৃদ্ধি হইয়া ১৫০্ টাকা পর্যন্ত ) গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া আরও আনন্দিত হইলাম | আমার পূর্ব্বের পত্রে আমি ভগবানের উপর ভবিষ্যতের ভার দিয়া সম্মতি জানাইয়াছিলাম |
আপনার এই আহ্বানে আমি ভগবানের আহ্বান যে পাইয়াছি তাহা সর্ব্বতোভাবে বোধ করিতেছি | কারণ প্রাণের এমন ব্যাকুলতা এবং স্বীকারের পর এমন শান্তি কখনও বোধ করি নাই | আপনি আমার আশা ছাড়িয়া যে পত্র দিয়াছিলেন তাহা পড়িয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছিল | পত্রব্যবহার করিয়াছি তাহা অস্বীকার করিলে পৌরুষত্ব থাকে না | আজ আমার চিত্র পরিপূর্ণ , নদনদীর সঙ্গে আমার তুলনা হয় না | নদী যায় সেবা করিয়া মলিন হইতে আমি যাইতেছি পবিত্র হইতে | আমার বড় সাধ ছিল মহর্ষির চরণতলে একদিন বসিয়া উপনিষদ বাক্য শুনিব | তাঁহাকে পাইলাম না , আপনার চরণতলে ব্রহ্মবাণী শিক্ষা করিতে চাহি | হিমালয়ে আমি পথ না পাইয়া ব্যাকুল হইয়া পাগলের মত বনে বনে ফিরিয়াছি |
আপনার কাছে কোন কথা গোপন করি নাই | কারণ আপনি ঘরের লোক | কি কাজ করিতে হইবে তাহার সামর্থ্য আমার আছে কিনা বুঝিলাম না | দেবতার আহ্বানের ন্যায় ইহা আমাকে হঠাৎ অযোগ্য জানিয়াও ডাকিয়া লইল |
প্রণত
ক্ষিতিমোহন সেন
ক্ষিতিমোহন ও রবীন্দ্রনাথ মানসিক দ্বন্দ্বের যে ভাবটা ছিল তা অপসৃত হলো | উভয়েই উভয়ের মনের লোক হয়ে উঠলেন | এরপর রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে যে চিঠিটা লিখলেন তাতে বিদ্যালয় সম্পর্কে নিজের আশা ও সংকল্পের কথা লিখলেন | চিঠিটা এবার দেখব আমরা |
ওঁ
বিনয়সম্ভাষণ পূর্ব্বক নিবেদন
শাস্ত্রীমহাশয়ের পত্রে আপনার পথযাত্রার যে হিসাব দিয়াছেন আমাদের কোনো অসুবিধা দেখি না – কারণ জৈষ্ঠ্যের শেষ পর্য্যন্ত অর্থাৎ ১৫ই জুন পর্য্যন্ত বিদ্যালয় বন্ধ থাকিবে | আপনি যদি ২৫শে মে তারিখেও ছুটি পান তথাপি ২০দিন সময় হাতে পাইবেন | বিদ্যালয়কে আকৃতি দান , ইহার প্রকৃতিকে উদ্বোধিত করিয়া তোলা কোনো এক ব্যক্তির শাসনাধীনে হইবে না | এ সম্বন্ধে আমি নিজের কর্তৃত্বের দ্বারা বিদ্যালয়কে চালিত করি না | আমি চেষ্টা করি যাহাতে প্রত্যেক অধ্যাপক নিজের শক্তিকে স্বাধীনভাবে এই বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করিতে পারেন- এমনি করিয়া সকলের স্বাধীন সহকারিতায় বিদ্যালয় ক্রমশ গঠিত হইয়া উঠিতেছে | প্রকৃতি ভেদবশতঃ প্রথম প্রথম পরস্পরের মধ্যে যে বিরোধ উপস্থিত হইত এখন ক্রমশ তাহা দূর হইয়া বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রত্যেকে নিজের স্বাভাবিক স্থান অধিকার করিয়াছেন ; ক্রমেই বিদ্যালয়টি যান্ত্রিক ভাব পরিত্যাগ করিয়া জৈবিক ভাব গ্রহণ করিতেছে | আপনিও ইহার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করিয়া ইহাকে ভিতরের দিক হইতে উন্মেষিত করিয়া তুলিবেন , এই আশা করিতেছি | ভারতবর্ষে আমরা মিথ্যার জালে জড়ীভূত হইয়া পড়িয়াছি – বিদেশীর কাছে আমাদের বাহ্য অধীনতা কিছুই নহে কিন্তু আমাদের সমস্ত জীবন আমাদের অন্তঃকরণ মিথ্যার দাসত্বে বিক্রীত | ইহাই আমাদের সমস্ত দুর্গতির কারণ | আমাদের বিদ্যালয়ে সত্যের যেনো অবমাননা না হয় – ছাত্রেরা যেন সত্যকে নির্ভয়ে স্বীকার করিয়া জীবনকে ধন্য করিতে পারে সেই পরম শক্তি তাহাদের মধ্যে তাহাদের মধ্যে সঞ্চার করিতে হইবে – এই আমার একান্ত কামনা জানিবেন | ইতি ১১ই বৈশাখ ১৩১৫
ভবদীয়
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ক্ষিতিমোহন অবশেষে এলেন | আঠাশ বছরের সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সারস্বত জ্ঞান নিয়ে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে এসে দাঁড়ালেন অনাড়ম্বরভাবে | প্রণতি মুখোপাধ্যায় লিখলেন : “রবীন্দ্রনাথ তো কোনোদিন ক্ষিতিমোহনকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানাননি , আম্রকুঞ্জের সভায় অভিনন্দিত করেননি , তাঁর নামে কোনো গ্রন্থ উৎসর্গ করেননি , কিন্তু তিনি যে এই ক্ষিতিমোহন নামক এক মহৎ সম্ভাবনাকে শান্তিনিকেতনের আশ্রম বনস্থলীতে এনে রোপন করলেন , তাঁর এই দূরদর্শী উদ্যোগই ক্ষিতিমোহনের প্রতি তাঁর শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য | রবীন্দ্রনাথ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কালীমোহন ঘোষকে লিখলেন : “ক্ষিতিমোহনবাবু বোলপুর বিদ্যালয়ের কাজে প্রবৃত্ত হইয়াছেন | ইঁহাকে পাইয়া আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছি | ইঁহার দ্বারা বিদ্যালয়ের বিশেষ উপকার হইবে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই | তুমি যে আমাকে ইঁহার সন্ধান বলিয়া দিয়াছ সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আছি |”
কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ক্ষিতিমোহনও কম যায় না | জীবনের শেষ পর্বে ক্ষিতিমোহনের সশ্রদ্ধ স্বীকারোক্তি : “এখন ভাবি ২০বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন আশ্রমে একটানা ৩৪ বৎসর গুরুদেবের সঙ্গে কাজ করিবার এবং ঘন সান্নিধ্যে আসিবার পরম সৌভাগ্য কয়জনের ঘটিয়াছে |”

সহায়ক গ্রন্থ :
১| রবীন্দ্র কক্ষপথে ক্ষিতিমোহন সেন , প্রণতি মুখোপাধ্যায় , দীপ প্রকাশন , জানুয়ারি২০১৫
২| ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর শান্তিনিকেতন , প্রণতি মুখোপাধ্যায় , পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯ আগস্ট ১৯৯৯
৩| আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন , নিতাই বসু , গ্রন্থতীর্থ , ২০১৬

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *