সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ১৫)

পদাতিক

যে নাবিকের দুচোখের নীল তারায় আঁকা রয়েছে দূরবর্তী জনপদ আবিষ্কারের স্বপ্নভরা আকুলতা, তাকে কি আর নির্দিষ্ট কোনো বন্দরে আটকে রাখা যাবে? জীবন বাজী রেখে সে ঠিক বেরিয়ে পড়বেই অজানাকে জয় করতে, অচেনাকে চিনতে, অদেখাকে দেখতে। ভাগ্যলক্ষ্মী তার গলাতেই জয়মাল্য পরিয়ে দেন যিনি আপন ভাগ্যকে জয় করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন।

প্রথমেই বলেছি, অন্যান্য আর দশজন গ্রামবাসীদের মতোই ছিলো বলরামবাবুর জীবনযাপন। সাধারণ একজন গ্রাম্য পরিবারের তিনজন পুত্র সন্তানের মধ্যম পুত্র। এই অবস্থায় একজন উদ্যোগী মানুষ হিসেবে তিনি হয়তো তার জমিজিরেত বাড়াতে পারতেন, অথবা একজন মাঝারী মানের ব্যবসায়ী হতেও তার কোনো অসুবিধা ছিলো না। দিনের শেষে আর দশপাঁচজন গ্রামবাসীদের মতোই সন্ধ্যাবেলা সব কাজ সেরে পাঁউশি চৌরাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বসে হাঁটুর ওপর ধুতিটাকে তুলে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা জুড়তে পারতেন অন্য বাল্যবন্ধুদের সাথে। অথবা ঘুনেধরা রাজনৈতিক আলোচনার পঙ্কিল জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে পারতেন। বড়োজোর তার মধ্যমানের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ব্যবহার করে গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য, অথবা জেলা পরিষদের সদস্য হতেও তার কোনো বাঁধা ছিলো না। বাস্তবিকপক্ষে তার শৈশবসঙ্গীরা এখন সেরকমটাই। কিন্তু না। তিনি হয়তো সেই বীর যোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতোই নিজের হাতের তালুতে তরবারি চালিয়ে চিরে লম্বা করে দিয়েছিলেন তার ভাগ্যরেখা।

কে বুদ্ধি দিয়েছিলেন জানি না, কিন্তু তিনি যখন তার ভাগের বাস্তুজমির ওপর ছোটছোট কুঁড়েঘর বানিয়ে বাড়িতেই অনাথ আশ্রম বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখনই হয়তো গ্রামবাসীদের ভেতরে নানা রকম গুঞ্জনকে উপেক্ষা করে তার ভাগ্যদেবী আড়ালে আশীর্বাদ করে স্বাগত জানিয়েছিলেন তার এই উদ্যোগকে। ধীরেধীরে পরিসরের অপ্রতুলতা ছাপিয়ে উপচে উঠতে লাগলো তার উদ্যোগ। তিনি বুঝতে পারলেন এই স্বল্প পরিসরে আর তার স্বপ্নকে আটকে রাখা সম্ভব না।

ততক্ষণে গ্রামবাসীরাও ভাবতে শুরু করেছেন যে, না। এটা নিছকই শুধুমাত্র ক্ষেপামো না, এই উদ্যোগের পেছনে এমন একটা মানসিক দৃঢ়তা আছে যে মানসিক দৃঢ়তা বুনো ঘোড়াকে বশ মানতে বাধ্য করে। বাধ্য করে বন্যায় উচ্ছসিত নদীকে বাঁধের বাঁধনে বাঁধতে। রুখাশুখা পাথুরে জমিকে উর্বরা শস্যশ্যামলা করে তুলতে। বলরামবাবু আশেপাশের গাঁয়ের ঘরে ঘরে যে ভান্ডার রেখে এসেছিলেন তার আশ্রমকে সাহায্য করার জন্য সেসব ভান্ডার ভরে সাহায্য আসতে লাগলো। যে সব পরিবার থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠানো হতো আশ্রমে সেই সব পরিবারগুলো থেকে চাল ডাল তরিতরকারি, নগদ পয়সা দিয়ে যেতে শুরু করলেন তারা। এভাবে আশ্রমিকদের ও তার পরিবারের খাওয়ারের অভাব দূর হতে শুরু করলো। বলরামবাবুর দুঠোঁটের কোনে আত্মপ্রত্যয়ের হাসির ঝিলিক দেখা দিতে শুরু করলো তিনি বুঝতে শুরু করলেন,শুধুমাত্র ভাবনাটা কিছু নয়। সঠিক ভাবনার সাথে সঠিক পরিকল্পনাই একজন পদাতিকের আগামী লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পারে। সাথে চাই উদ্যম আর পরিশ্রম।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।