সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৩৩)

সীমানা ছাড়িয়ে

এখন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে বুড়ো শিবের মন্দির যেতে। আমি বললাম, ছোটবেলায় আমাদের কোপা গ্রামে মাটির রাস্তা ধরে ধুলোমেখে ঘরে ঢুকতাম। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হয়ে যেত। গোরুর গাড়ি ছাড়া কিছুই যান ছিল না। আর ছিল পাল্কি। গ্রামের ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই শুনতাম পাল্কির গান।

রাতে খেয়েদেয়ে সোমা ও আমি আবার চাঁদের আকাশে।
তার পরের গল্প ডুব দিয়েছে জ্যোৎস্না সাগরে…।কমলের স্ত্রী সকলের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসে। তার মধ্যে সরলতা আছে। কমল বার বার তাকে সাবধান করে। বলে সংসার কিন্তু তোমার মত সরল নয়। সকলকে বিশ্বাস করবে না।কমলের স্ত্রী আদৃজা বলে, ওইরকম মন নিয়ে সমাজে চলা যায় না। ছেলেদের সঙ্গে কথা বললেই তোমার রাগ হয়। এটা কিন্তু তোমার চরিত্রগত একটা দোষ।
কমল আর কথা বাড়ায় না। দিন চলে জলের স্রোতের মত। কমল ভালোবেসে ফেলে এক বিধবা রমণী রমাকে। রমা কমলের অফিসের ক্যাশিয়ার। অনেকদিনের পরিচয়। রমা বেশ সুন্দরী। নিজে চারচাকা গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করে অফিসে আসে। চোখে সানগ্লাস। এই চল্লিশের কোঠায় তার দেহ টানটান। যেকোন ছেলে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য। কিন্তু প্রেম তো বলেকয়ে আসে না। হঠাৎ আসে হুড়মুড়িয়ে। তখন কিছুই করার থাকে না। কমলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। রমার হৃদয়ে বাঁধা পড়লো তার মন। রমা তার গাড়িতে কমলকে নিয়ে অফিসফেরতা প্রথমে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। গল্পগুজব করে। খাওয়া দাওয়া করে। তারপর কমল নিজের বাড়ি যায়।
কমলের স্ত্রী বলে, কয়েকমাস ধরে তোমার অফিস থেকে আসতে দেখছি দেরি হচ্ছে।
কমল বলে, হ্যাঁ একটা বন্ধুর বাড়ি যাই। তারপর খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি আসি।
– তাহলে সন্ধ্যার খাবার বাড়িতে খাবে না তো কোনদিন।
– না সন্ধ্যার খাবারটা খেয়েই আসি। আর তাছাড়া অফিসের কাজে অনেক রাত অবধি মাঝে মাঝে কাজ পরে যায়। দু এক রাত বাড়ি না আসতেও পারি। মোবাইলে ফোন করে জানিয়ে দেব। তুমি চিন্তা কোরো না।
আদৃজা কেমন যেন হয়ে গেল এই কয়েকমাসে। আর আগের মত বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলে না। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে।একদিন
আদৃজা বলে, তুমি সত্যি করে বলো। কাল রাতে কোথায় ছিলে?
– আমি রমার কাছে ছিলাম
– সে আবার কে?
– আমাদের অফিসের ক্যাশিয়ার
– তাহলেও ও তো মেয়ে। রাতে থাকলে কেন?
– আমি ওকে ভালবাসি।
আদৃজার মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বিষ খেলো। তার ছেলেরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কোনওরকমে তাকে বাঁচিয়ে আনলো। কমল বললো, আমার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেলো। তুমি বিষ খেতে গেলে কেন। আমি রমাকে ছাড়তে পারব না। ও আমাকে আরও উন্নত পথে নিয়ে যাবে। ও খারাপ মেয়ে নয়।
আদৃজা বুঝতে পারলো আর স্বামীকে ফেরানো যাবে না রমার খপ্পর থেকে। আদৃজা কমলকে বললো, তোমার মনে এই ছিলো। কেন আমার মধ্যে কি নেই যা রমার মধ্যে পাও।
কমল বললো, মন আর চিন্তার পার্থক্য।রমা আমাকে স্মার্ট করে তুলেছে। আমি এখন গাড়ি চালাতে পারি, কবিতা লিখতে পারি। কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকলে কোনওদিন আমার প্রতিভার স্ফুরণ হত না। আমি রমাকে ভালোবাসি।
এইভাবেই সময় কাটে। শেষে কমলের বয়স বাড়ে আর বাড়ে তার শরীরের রোগ। সে আর আগের মত সবল নয়। বিছানায় সময় কাটে বেশি। অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রচন্ড। এদিকে রমা মোবাইলে খবর নেয় কিন্তু অফিসের কাজের চাপে সে ব্যস্ত থাকে। আর সময় থাকলেও কমলের বাড়ি সে আসতে পারে না লজ্জায়। কমল এখন তার স্ত্রী আদৃজার ওপর নির্ভরশীল। আদৃজা স্বামীর সেবা করে দিনরাত। তারপর কমল একদিন সুস্থ হয় স্ত্রীর যত্নে।
কমল বলে, প্রকৃত প্রেম কি তা বুঝতে আমার অনেক সময় পেরিয়ে গেলো গো…

রমা কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। এতদিন কমল কোমল কমল চিবিয়ে ছিবড়ে করে স্ত্রী দরদি হয়ে উঠবে একথা রমা মানতেই পারে নি। কমলকে ফোন করে, তোমার শরীর তো একটু সুস্থ হয়েছে, আমার সঙ্গে রাতে দেখা কোরো।
কমল ভিডিও কলটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করলো। এখনি আদৃজা চলে আসতে পারে। শুনতে পেলে আবার অশান্তি হবে। কিন্তু না। আদৃজা আর কলহ করে না। সবটাই ছেড়ে দিয়েছে সে সময়ের হাতে। আদৃজার মনের জোর আগের থেকে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একটা ভীষণ ভারি বোঝা তার মাথা থেকে নেমে গেছে চিরদিনের মত। সে স্বামীকে বলে, চলো তোমার রমার সঙ্গে একদিন দেখা করি দুজনে।

– তাহলে একদিন রবিবার দেখে তিনজনে বেড়াতে যাবো মুকুটমণিপুরে। সেখানে তোমার সঙ্গে পরিচয়ও হবে আবার ঘোরাও হবে।
কমল চাইছিলো এই সুযোগে দুজনের ভিতর একটা সেতু তৈরি করতে। এই সেতু দুজনের মনের দূরত্ব কমিয়ে আনবে। মিলিয়ে দেবে মিলনসেতুর আকারে। কিন্তু একজন নারী কি কখনও ভুলেও তার স্বামীকে অপরের হাতে চিরকালের মত ছেড়ে দিতে চায়। কমল জানে না। তবু একবার ট্রাই করতে চায় তার মন।
মুকুটমণিপুরে গিয়ে স্মার্ট রমা কমলের বউকে আপন করে নেয়। আদৃজারও ভালো লেগে যায় রমাকে। সে ভাবে সত্যি রমা তো খুব ভালো মেয়ে। হয়ত বিধবা হওয়ার জন্য পরকীয়ায় বাঁধা পড়েছে। দেহেরও তো একটা দাবি আছে। আদৃজা কেমন যেন মায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে যায় রমার আদরে আর ভালোবাসায়। তাহলে পুরুষতো বশ হবেই রমার প্রেমে। রমার প্রেম আর পারিজাত ফুলের পরশ কি একইরকম। আদৃজার নারীত্ব ফুটে ওঠে পদ্মফুলের মত।

আদৃজা ভাবে, এখন সে কি করবে। দুই সতীনের ঘর করবে, নাকি রমাকে সটান একচড় কশাবে।কিন্তু চড় মারার তো কারণ চাই। রমা তো একটাও কটু কথা বলে নি। শুধু একটা হাহাকার তার অন্তরজুড়ে, এটা আদৃজা লক্ষ্য করেছে বারবার। কমল ভাবে, নারীদের তৃতীয় নয়ন আছে। ওরা সবকিছু বুঝতে পারে তান্ত্রিক সাধকের মত।

আদৃজা খেই হারিয়ে ফেলে। মনে হয় মুকুটমণিপুরের পাহাড়ের একটা বড় পাথর ভারি হয়ে নেমে আসে তার বুকে। একটা চাপা অনুভূতি। রমা এসে সে পাথর সরিয়ে দেয়। রমা বলে, স্বামীকে চোখে চোখে আগলিয়ে রেখো। তোমাকে আমি স্মার্ট করে গড়ে তুলব। তুমি আসবে তো আমার বাড়ি।তুমি তো এমনিতেই সুন্দরী। শুধু প্রয়োজন একটু বাগানের মালির মত আদরে ক্যাকটাসের যত্ন নেওয়া।
তারপর আদৃজা এক অমোঘ আকর্ষণে রমার বাড়ি যায়। আসা যাওয়া সহজ হয়ে যায় মানুষের বিচিত্র মনের মত গতিময় আবেশে।
এখন আদৃজা স্কুটি চালায়। ডায়েট মেইনটেন করে। আদৃজার কোমর দেখে কমলের মনে হয় একটা হিলহিলে সাপ কেমন জড়িয়ে রয়েছে তার শরীরজুড়ে। কমলের ছোবল দিতে ইচ্ছে হয় আদৃজার ঠোঁট বরাবর মাঝখান দিয়ে নেমে একেবারে মাঝ নদীর গভীরতায়। রমার যত্নে সে স্বামীর চোখের মণি হয়ে উঠছে দিন দিন। আদৃজা বলে, এ তে তোমার স্বার্থ কি।আমি সুন্দরী,স্মার্ট হলে কমল তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে তো। প্রেম বিফলে যাবে।
রমা বলে, সবকিছুতে এখন স্বার্থ দেখলে হবে।সব প্রেম শরীর চায় না। মনের পরশেও ফুটে ওঠে আত্মার শক্তি। সে প্রেম তো আর ছেলেখেলা নয় যে ঠুনকো আঘাতে ঝরে পড়বে বাইরে।আর তাছাড়া নিজের হাতে গড়ে, দুনিয়া পাল্টে ফেলার তো একটা আলাদা আনন্দ আছে গো সুন্দরী…

 

অনিল আর বিমল একই স্কুলের শিক্ষক। একই স্কুলে চাকরি করার দরুণ তারা দুজনে একসঙ্গে স্কুলে যায় মোটর সাইকেলে। একটা মোটর সাইকেলে চেপে যায়। বিমল চালায় আর অনিল পিছনে বসে থাকে। বিমল গাড়ি চালানোর সময় মাঝে মাঝে ঢুলতে থাকে। গাড়ির গতি কমে যায়। অনিল মিটার রিডিং এ দেখে কাঁটা কুড়ির ঘরে নেমে গেছে। অনিল বিমলের পিঠে হাত বুলোয় তাকে জাগানোর জন্য। অনিল জানে, কলিগরা কখনও বন্ধু হয় না। হলেও কোটিতে গুটি। বিমল পিঠে হাত দিলে অসন্তুষ্ট হয়। বিমল একবার অনিলকে বলেছিলো, কেউ আমার গায়ে হাত দিলে খুব খারাপ লাগে। এখন বিমল মোটর সাইকেল চালানোর সময় ঘুমিয়ে গেলেও গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে সাহস করে না। মনে পড়ে যায় বিমলের কথা। গায়ে হাত দিলে তার ভালো লাগে না। একদিন মোটর সাইকেল একটা উঁচু মাটির ঢিপির ওপর উঠে গিয়ে থমকে গেল। বিমল কিছুক্ষণ দুদিকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে নিল। তারপর পিছনে গাড়িটা সরিয়ে এনে আবার রাস্তায় নেমে এল। অনিল জানে এ এক ভীষণ বাজে রোগ। বিমলের রোগের স্বীকার। অনিলের ডাক্তার বন্ধু সব শুনে বললেন, স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে ঠিকঠাক ঘুমের পরও ক্লান্তিভাব আসে। এই অসুখে প্রবল নাক ডাকার সঙ্গে শ্বাস বন্ধ হয়ে মাঝেমধ্যে ঘুম নষ্ট হয়। ভাঙা ভাঙা ঘুম। ফলে কম ঘুম গোটা দিনের জন্য ক্লান্তিতে ভরিয়ে তোলে। তোর কলিগেরও এই অবস্থা হয়েছে। হয়ত অনেক রাত অবধি পড়ে। হয়ত কোনো ডিপ্রেশন কমানোর ওষুধ খায়। তাহলে সারাদিন ঢুলুনি ভাব থাকবে। খুব সাবধান কিন্তু।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।