• Uncategorized
  • 0

মুড়িমুড়কি -তে ঈশানী রায়চৌধুরী


ব্যুমেরাং

স্বর্গে ভগবান অত্যন্ত বিচলিত ও বিরক্ত| আজকাল কাউকে ধারেকাছে পাওয়া যায় না| সব ব্যাটা মর্ত্যে যাওয়ার জন্য হেদিয়ে মরছে| ট্রেন, প্লেন, বাস এমনকী ভ্যানরিক্সাগুলোতেও পেছন ঠেকানোর  জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না| প্লেনে তো এখন লোকে সীট না পেলে দাঁড়িয়ে যেতেও রাজী| আপাতত অবশ্য দু-সারি সীটের মাঝে পরপর কিছু বেতের ডিজাইনার মোড়া রেখে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে| কিন্তু তাতেও সামাল দিয়ে ওঠা যাচ্ছেনা| কিন্তু কী এমন মধু আছে মর্ত্যে?
কে.পি.কোচিং সেন্টার| সেখানে একবার নাম লেখাতে পারলে সারা জীবনের মতো হিল্লে হয়ে যায়| আর কে নাম লেখায়নি বলতে পারেন? বাল্মীকি, হোমার, গ্যেটে, দান্তে থেকে শেক্সপীয়ার, নিউটন, আইনস্টাইন..তাবড় তাবড় রথী মহারথীরা! আজকাল বয়স হয়েছে, কোষ্ঠ সাফ হয় না বলে ব্যাস দেবকে কলঘরে সময় বেশি নিতে হয় মাঝেমাঝে| তাই তাঁর একটু খবর পেতে দেরীই হয়েছিল| যতক্ষণে তিনি লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে পৌঁছেছিলেন, ফর্ম ফিল আপ শেষ! রবিঠাকুর জমিদার নন্দন, কিঞ্চিৎ আহ্লাদে টাইপ| বাবামশাইয়ের কোল পোঁছা খোকা তো! “যাচ্ছি যাব” করে গড়িমসি করে সোনার সুযোগটাই হারাল!
এই কে.পি. কোচিং সেন্টারে কী হয়? পূর্বজন্মের ভুলভ্রান্তি, খামতি  সব সংশোধন করা হয়| ঘনঘন আইকিউ টেস্ট নিয়ে দেখা হয় দিনে দিনে কতটা উন্নতি হল বুড়ো হাবড়া এইসব তথাকথিত জিনিয়াসদের| বুদ্ধি ছিল, লোকে তোল্লাই দিয়েছে …সে তো ভালো কথা! কিন্তু নিজেদের আরও তৈরী করতে হবে তো! কে. পি.  এদের গুরুর গুরু| বাঘের ঘরে, থুড়ি ঘাড়ে ঘোগ| তিনি ক্ষণজন্মা| এইসব মনীষীদের ঘাড়ে ..নানা ..মাথায় বসে ইয়ে করার ক্যালি রাখেন| গ্যালিলিও একটু ঢেঁটা টাইপ| আরে, সীট পাচ্ছিস না, ম্যানেজমেন্ট কোটা তো আছে! কিন্তুনা! উনি সোজা পথে হাঁটবেন| মর গে যা, একটা বছর থাক এখন বাড়িতে বসে!
কিন্তু এই কে. পি. লোকটিকে? কী তাঁর পরিচয়? কে তাঁর গুরু?
কে. পি. স্বয়ম্ভু| তাঁর কোনো ঐহিক পারত্রিক গুরুর দরকার নেই| তাঁর গুরু অলীক, অজড়, অমর| জ্ঞানের আকর| যাঁকে স্পর্শ করা যায়, কিন্তু দর্শন করা যায় না| শিক্ষা নেওয়া যায়, কিন্তু সে ঋণ স্বীকার করার সৌজন্য দেখানো আবশ্যিক নয়| যিনি বয়সে নবীন,  কিন্তু জ্ঞানে বৃদ্ধ| যিনি সব জানেন| সব এবং সব|  তিনি একচিরনবীন, লাজুক, নিজেরঢাক নিজে পেটাতে অনাগ্রহী আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য ব্যক্তিত্ব| গুগলমুনি|
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, গুগলমুনির কাছে এইসব রথী মহারথীরা সরাসরি নিজেরা গেলে কি হত না? না, হত না| কারণ এঁরা কম্পু-স্যাভি নন| তাই এঁদের নতুন স্যার আমাদের এই কে.পি. স্যার| মিনিমাম ইনভেস্টমেন্ট, ম্যাক্সিমাম লাভ কে.পি স্যারের এই নতুন ব্যাবসাতে| শুধু একটাই শর্ত: এইসব রথী মহারথীদের পুরোনো লেখাপত্তর যথেচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি দিতে হবে কে.পি.স্যারকে| আর এটাও মুখ বুজে মেনে নিতে হবে যে, এতদিন লোকজন যা কিছু  এঁদেরই কাজকম্ম বলে মেনেগুনে এসেছে, সেসব কিছুই আদতে অজ্জিনাল নয়| সবই কে. পি. স্যারের পরোক্ষ অবদান| নিউটনের  প্রিন্সিপিয়ার পাণ্ডুলিপিতে যাবতীয় ফর্মুলা ক্রস চেক করেছেন কে.পি. স্বয়ং, আর্কেমিদিস বাথরুমে সেদিন একাছিলেন না, বাল্মীকির অক্ষর পরিচয় কে. পি-র হাতে, নার্সারি ক্লাস থেকেই বিয়াত্রিচের প্রাইভেট টিউটর ছিলেন কে.পি. এবং দান্তেকে মহাকাব্যের বৈতরণী তিনিই পার করিয়েছিলেন ..স্রেফ বিয়াত্রিচের ঘ্যানঘ্যানানি অগ্রাহ্য করতে না পেরে| আইনস্টাইন তাঁর কথা না শুনে কাগজে একটি আঁচড়ও কাটতেন না| কবে থেকেই তো কানাঘুসো চলছে, শেক্সপীয়ারের সবই নাকি টুকলি| কিন্তু কার থেকে, কেউ কি তার খবর রাখে? রবি, এই তো সেদিনের ছেলে! ওকে হারমোনিয়ামের বেলো টিপতে শেখাল কে, শুনি? হালফিলের এই যে বঙ্গীয় শব্দকোষ, অক্সফোর্ডের অভিধান … এসব কার লেখা? ওই সরস্বতী ..জ্ঞানের দেবী ..আসলে তো স্রেফ মিথ! সরস্বতী কে.পি-র সঙ্গে বনফুলের ভাষায় সামান্য “লদকালদকি” করে ওঁর সেন্টারে রিসেপশনিস্টের চাকরিটি বাগিয়েছিলেন প্রথমে| অবিশ্যি কে. পি–র দৌলতে ইঙ্গ-বঙ্গ কোনও ভাষাই আর অজ্জিনালিটি দাবি করার অবস্থায় নেই! আজব সেসব কিছু লিখতে গেলে সে এক মহাভারত| ব্যাসদেবের বকলমে অষ্টাদশ পর্বে মহাভারত লিখতেই বড্ড পরিশ্রম গেছে তাঁর| আজকাল তাই আর নিজের মুখে নিজের কথা বলতে ইচ্ছে করে না কে.পি-র|
ভগবানের আজকাল গা জ্বলে যায়| কেউ তাঁকে তোয়াজ করে না| বিপদে পড়লে ডাকাডাকিও বন্ধ| এমনটা চললে শিগগিরই স্বর্গের সিং দরজায় তালা ঝুলবে| হুহু করে লোক কমছে| মর্ত্য ছেড়ে নড়তেই চাইছে না মানুষজন| কে.পি. ….ওই নরাধমকে উচিত শিক্ষে দিতে হবে| ভগবান তেড়েফুঁড়ে ধরাধামে হাজির হলেন|
মাইরি, কী ভিড়, কী ভিড়! শালা যত পাবলিক জমা হয়েছে সেন্টারের সামনে| জগন্নাথের রথ না প্রয়াগের মেলা বোঝা দায়| বেলুনওয়ালা, “চায়  গ্রাম”, বুড়ির মাথার পাকা চুল থেকে শুরু করে নাগরদোলা, লটারির টিকিট সব স্টল বসে গেছে| কে.পি. নাকি ব্রাঞ্চ খোলার কথাও ভাবছেন| তাঁর পাকাচুলো হুমদো হুমদো জ্ঞানবৃদ্ধ ছাত্তররা সব মাসমাইনের মাস্টারি করবে সেখানে| কে. পি. এখন থেকে চিফ কনসালটেন্ট, না সি ই ও… কী যেন সব গুষ্টির পিণ্ডি! সক্কলেরমাথা| ভগবান আর অত সব জানতেও চান না, বুঝতেও চান না! চারদিকের হালচাল দেখে তাঁর নিজেরই যথেষ্ট শিক্ষে হয়েছে আজ! নিজের টেকো মাথাটি পায়ের কাছে পড়ে থাকা এঁটোঘুগনির ছিটেফোঁটা মাখা  ছেঁড়া শালপাতায় ঢেকে একপা একপা করে পিছু হটতে শুরু করলেন ভগবান| নিজের মাথাটি নিজেকেই বাঁচাতে হবে| কে. পি-র আবার ফাঁকা মাথা বড্ড প্রিয়| ফাঁকা মাঠ, থুড়ি মাথা ছাড়া নাকি তাঁর সকালের বেগই আসে না!
ভগবানের চোখ ফেটে কান্না আসছিল!
 কে. পি.| কাকপন্ডিত|
ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।