• Uncategorized
  • 0

গল্পে সুধাংশু চক্রবর্তী

বনবিবির উপাখ্যান  

মজার ব্যাপার হলো এই যে, তিনকুড়ির ওপর বয়স হলেও বনবিবি আজও বন-জঙ্গল দেখে উঠতে পারলো না ! নিজের এই অদ্ভুত নামটা নিয়ে যে কি করে তাও বুঝে উঠতে পারছে না ও । এই তল্লাটের ছেলেছোকরাগুলো মাঝেমধ্যেই এসে ঝুপড়ির ভাঙা দরজার ফোঁকর দিয়ে মুণ্ডু গলিয়ে ওকে খেঁপিয়ে দিতে চেয়ে বলে যায়, কিগো বনবিবি, বয়স তো কবেই তিন কুড়ি পার হয়েছে । অথচ অমন একটা নাম পুষে রেখে আজও নাকি বনের মুখ দেখে উঠতে পারলে না ? আর কবে বনে যাবে গো ? নাকি বন থেকে সোজা উঠে এসেছো এই মুলুকে ?
নামকরণের সময় বাবা কি বুঝেছিলো কে জানে সখ করে মেয়ের এমন একটা উদ্ভট নাম রেখে গেল যে, তার জের এখন সেই বনবিবিকেই পোহাতে হচ্ছে । তাই তো নিজের এই উদ্ভট নামটার জন্যে মরমে মরে থাকে বনবিবি । বুকটা দুঃখে ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে চায় । একটা ব্যাপার বনবিবি আজও বুঝে উঠতে পারেনি । কাউকে নাম ধরে ডাকতে হলে তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই কি সেটা তার নাম হয়ে যায় ? অথচ বাবা যে তেমন করেই মেয়ের নামকরণ করে খালাস হয়ে গেল ! এই যে এ-তল্লাটের ছেলেছোকরারা উড়ে এসে জুড়ে বসে ওর ভাঙা ঝুপড়ির দরজা দিয়ে মুণ্ডু গলিয়ে দিয়ে ওকে তাক্‌ করে যত্তসব উদ্ভট প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে বাবা কি সেসব প্রশ্নের জবাব শিখিয়ে গিয়েছে ওকে ? নাকি বলে গিয়েছে, শোন মা, কেউ যদি এমন তেমন প্রশ্ন করে তাহলে অমুক বা তমুক জবাব দিবি ? বাবা যে তেমন কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে যায়নি ওকে । এমন কি ওকে লেখাপড়াটাও শিখিয়ে যায়নি ।
খানিক আগে বেশ আয়েস করে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছিলো বনবিবি । এবছর বেদম ঠাণ্ডা পড়েছে । দুপুরে এদিক-ওদিক থেকে কাঠকুঠ জোগাড় করে এনে পোয়াটাক ফেনাভাত ফুটিয়ে নিয়ে তার ওপর একখাবলা নুন ছিটিয়ে দিয়ে একটা কাঁচালঙ্কা টিপেটুপে বেশ করে মেখে গপ্‌গপ্‌ করে খেয়ে শেষ করেছে । খাওয়াদাওয়ার পর হাতমুখ ধুয়ে ঝুপড়ির বাইরে এসে রোদ পোহাতে বসেছিলো ওই এঁদো পুকুরের ধারে । খানিক পরই পুকুর থেকে ঠাণ্ডা জোলো-হাওয়া ছুটে এসে এমন ঝাপটা মারতে শুরু করলো যে, সেই ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটানিতেই বনবিবির অমন সাধের রোদ পোহানো মাথায় উঠেছিলো । বুড়ো হাড়ে যে একটু বেশী মাত্রায় শীত লাগে বনবিবি কি তা জানতো ? জানতো যদি তাহলে ঝুপড়িটাকে পুকুরের ধার থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতো একে তাকে ধরেকরে । যে-হলধর মল্লিক ওকে… দুর্বল শীর্ণ শরীরটাকে ছেঁড়া কাঁথায় বেশ করে মুড়িয়ে নিয়ে চাটাইয়ের ওপর লম্বা হয়ে পড়ে থেকে এসব ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে বনবিবি ।
খানিক পরই বুঝতে পারে ভাবনার চোরাস্রোত এখাল-সেখাল হয়ে একসময় সেই সাগরের দিকে ছুটতে শুরু করেছে ! ব্যাপারটা ধরতে পেরে আবার ফিরে এলো ভাবনার প্রথম দিকটায় । পুকুর থেকে উঠে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটায় শেষমেশ অত কড়া রোদের মায়া ত্যাগ করতে হলো ওকে । সেখান থেকে উঠে এসে ঝুপড়ির মেঝেয় পেতে রাখা চাটাইটার ওপর দলা হয়ে পড়ে থাকা হিমশীতল ছেঁড়া কাঁথাটাকে টেনে নিয়ে গোটা শরীরটাকে বেশ করে মুড়ে নিয়ে ঠাণ্ডাকে খানিকটা কাবু করতে পেরে এতটাই আনন্দিত হয়েছিলো যে, সেই আনন্দে কাঁপা কাঁপা গলায় নিজের পেয়ারের গানটা গেয়ে উঠেছিলো, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো…’
গানে তেমন করে বিভোর হয়ে ওঠার আগেই বোষ্টমপাড়ার হারু এসে কুঁড়েঘরের ভাঙা দরজাটা হাট করে খুলে দিয়ে ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে গোটাকয়েক প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিয়েছিলো ওর দিকে, বলি ও বনবিবি, হরির হাত ধরে কোন বনটা পার হতে চাইছো তুমি ? হরিকে কি সেই বনের ধারে গিয়ে ধরে আনতে হলো ? কেন গো ? তাকে কি এই ঝুপড়িতে বসে ধড়পাকড় করা পোষাচ্ছিলো না তোমার ?
পাজি হারু প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিয়ে দরজাটা হাট করে খুলে রেখে পালিয়েছে । না পালিয়ে উপায় ছিলো নাকি ? এ-পাড়া সে-পাড়ার কে না জানে এসব প্রশ্নবাণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রয়াস করতে করতে বনবিবির মুখের ভাষা এতদিনে প্রচণ্ড বন্য হয়ে গিয়েছে । মুখের ভাষারও যে দাঁত-নখ বলে কিছু থাকতে পারে তা ক’জনাই বা জানে ? জানতোই যদি তাহলে কি আর যখন তখন এসে কথার খোঁচা দিয়ে যাবার সাহস দেখাতো ? বনবিবির ধারণা অনেকেই হয়তো না-জেনেই এসে কথার খোঁচা দিয়ে যায় । তারপর গালমন্দ শুনে যায় দু’কান ভরে । আবার অনেকে জেনে শুনেও খোঁচা দিতে আসে সখ করে । তাই যদি না-হবে তাহলে হারুর মতো ছেলেছোকরাদের অনেকেই এসে কিছু আজব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে পালায় কেন ?
অতএব সেসব ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার তাগিদে বন্য ভাষাগুলো জিভের ডগায় টেনে নামানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে নাকি ? এটাও ঠিক যে, মহাপ্রস্থানে যাবার আগে বাবা ওকে হাতে ধরে কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে যায়নি । শিখিয়ে পড়িয়ে গেলে ভালো করতো । বনবিবি তাহলে ভাষা নিয়ে খেলা করতে পারতো বাবু মানুষদের মতো করে । বাবা অবশ্য নিজের এই মেয়েটিকে তেমন করে কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে যাবার সুযোগও পায়নি । মায়ের কাছেই শুনেছে ও যেবার তিনবছরে পা রাখলো বাবা সেবারই হঠাৎ করে শেষযাত্রায় বেরিয়ে পড়লো । কচি বনবিবি তারপর চোখের জল মুছতে মুছতে বাবার ফিরে আসার পথ চেয়ে বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করেছিলো । অপেক্ষা করতে করতে একসময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো ।
বনবিবির মা অবশ্য স্বামীর ফিরে আসার পথ চেয়ে হা-করে বসে থাকেনি । হঠাৎ একদিন অন্য এক পুরুষের হাত ধরে কোথায় যেন চলে গেল কচি মেয়েটিকে ঘরে একলা ফেলে রেখে ! বনবিবি বয়স তখন মোটে পাঁচ । কথাগুলো মনে পড়ায় বনবিবির খুব হাসি পেলো । যখন জন্মেছিলো ওর হাতে তখন জমা ছিলো বাবা আর মা । বাবা গত হবার পর হাতে পড়ে ছিলো শুধু মা । সেই মা’ও যেদিন অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে বাঁচলো সেদিন থেকে ওর হাতে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকলো না ! এরপর থেকে বনবিবির এতগুলো বছর কেটেছে দুঃখের পর দুঃখের ঢেউয়ের ক্রমাগত আছড়ে পড়ার চাপে থেঁতলে যেতে যেতে ।
সে এক লম্বা কাহিনী ! অত কথা কি ছাই একটানা মনে পড়তে চায় ? বনবিবি অগত্যা ভাবনার জাল বুনতে বসে খামচা খামচি করে । মায়ের মুখেই একদিন শুনেছিলো বাবা নাকি অনেক আশা করেছিলো তার এই মেয়ে এক কালে বনজঙ্গলে রাজ করবে । সেই কারণেই হয়তো সাধ করে নিজের প্রিয় মেয়েটির নাম রেখেছিলো ‘বনবিবি’ ! বাবা আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে দেখে যেতে পারতো তার সেই আদরের মেয়েটি এতকাল কম চেষ্টা করেনি ওর বাবার ইচ্ছের মর্যাদা দিতে । হায়-হায়, বাবা দেখে যেতে পারেনি মেয়ে যে সেই এককুড়ি বয়স থেকে জঙ্গলে রাজ করতে শুরু করেছিলো ! অবশ্য সেই জঙ্গল গাছগাছালিতে ভরা সত্যি সত্যি কোনো সবুজ বনজঙ্গল ছিলো না । ছিলো জংলীমানুষদের আস্ত একটা জঙ্গল ।যতদিন গতর ছিলো ততদিন যেমন করে হোক বাবার ইচ্ছের মর্যাদা দিতে চেষ্টা করেছে বনবিবি ।
এখন তিনকুড়ির ওপর পার করে দেওয়া বয়সে এসে সেই তড়তাজা শরীরটাকে আর ধরে রাখতে পারলো না বনবিবি । শরীরে যত রক্তমাংস ছিলো, যতটুকু ক্ষমতা ছিলো তার সবটাই উজার করে দিয়েছে জংলীমানুষদের জঙ্গলে রাজ করার সময়ে । অবশেষে প্রায় শেষ বয়সে রক্তমাংসের ছিবড়ে হয়ে এই এঁদো পুকুরের ধারে এসে আস্তানা গেড়েছে জীবনের শেষ দিনগুলো দু’হাতে খরচ করবে বলে ।
পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা যত ভাবছে বনবিবির হাড্ডিসর্বস্ব শরীর থেকে ঠাণ্ডার দাপট ততই কমে আসছে ! ব্যাপারটা অনুভব করতে পেরে বনবিবি আবার ভাবনার জাল বুনতে শুরু করে । তবে হ্যাঁ, তার আগে ওকে জিরিয়ে নিতে হলো দু’দণ্ড । এই তিনকুড়ির ওপর পার করে দেওয়া শরীরটা নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়েছে ও । আজকাল একটু বেশী কথা বলতে গেলে বুকে হাঁপ ধরে যায় । এমন কি বেশী ভাবতে গেলেও সেই হাঁপ ধরাটাই এসে জাঁকিয়ে বসে বুকের ভিতর ।
সামান্য জিরিয়ে নিয়ে বনবিবি আবার ভাবনার সমুদ্রে তলিয়ে যেতে থাকে তোবড়ানো গালে হাত ঠেকিয়ে । পাঁচবছর বয়সে মাকে হারিয়ে ও যখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে তখনই বাবুপাড়ার লাহাবাবু ওকে দয়া করে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে স্বেছায় ওর থাকা খাওয়ার ভার নিয়েছিলেন । পরিবর্তে অনেক কিছুই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছিলো বনবিবিকে । সেসব কথা আজও ভুলতে পারেনি বনবিবি ।
ওই পাঁচবছর বয়সেই লাহাবাবুদের ডাঁই করে রাখা এঁটো বাসন-কোষন মাজতে হতো । এমনকি কাপড় কাচা, ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে ওর চেয়ে বছর দুয়েকের বড় লাহাবাবুর একমাত্র ছেলে বনির সঙ্গেও খেলতে হতো দিনের কিছুটা সময় । এতকিছুর বদলে খাদ্যের নামে যেসব সামগ্রী এসে জুটতো ওর পাতে সেকথা মোটেও বলার মতো নয় । হতো কি, লাহাবাড়ির সকলের খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাবার পর ওদের পাতের অবশিষ্ট উচ্ছিষ্টগুলো এসে জড়ো হতো একটা পাত্রে ।সেই জড়ো করে রাখা বস্তুগুলো একসময় এসে জুটতো বনবিবির পাতে । সেসব অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে যেনতেন প্রকারেণ বড় হচ্ছিলো বনবিবি । সেসব মেনেও নিয়েছিলো অদৃষ্টের লিখন বলে । কিন্তু বনির সঙ্গে খেলা করাটাই একদম না-পসন্দ ছিলো ওর । কেন না খেলার ছলে ওকে যে প্রচুর শাস্তি ভোগ করতে হতো ।
লাহাবাবুর স্ত্রী সবাইকে ডেকে বুক ফুলিয়ে বলতেন তাঁর ছেলে বনি নাকি কালে কালে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে খুব নাম করবে ।অতএব ছোটবয়স থেকে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়াটাও ছেলেকে শিখে নিতে হবে । কিন্তু শাস্তি দিতে হলে একজন অপরাধীর প্রয়োজন হয় যে সেকথা কে না জানে ? বনি যখন সেই অপরাধীর জন্য হেঁদিয়ে মরছে খুব কান্নাকাটি করে লাহাগিন্নী তখনই বনবিবিকে তুলে দিয়েছিলেন ছেলের হাতে । বনবিবিকে তুলে দিয়েছিলেন অপরাধী সাজিয়ে । এরপর অপরাধের শাস্তি স্বরূপ নিজের উলঙ্গ শরীরে বনির ছড়ির ঘা সহ্য করতে হতো ওকে । প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই অপরাধীর পার্টটা ওকে ততদিন চালিয়ে যেতে হয়েছিলো যতদিন না ও পূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছে ।
ও যখন যুবতী হয়ে উঠেছে বনিও তখন আর সেই ছোট্টটি ছিলো না । অতএব খেলার ধরণটাও তখন অন্য খাতে বইতে শুরু করেছিলো । তখনকার শাস্তি আরও কঠিন হলেও বনবিবি তাতে এতটুকুও আপত্তি করেনি । কারণ সেই নতুন ধরণের শাস্তিতে মিশে থাকতো একটু আধটু শারীরিক আনন্দ ! শাস্তির ধরণটা তখন ছড়ির আঘাতের বদলে এসে বর্তেছিলো শারীরিক নিস্পেষণে ।
সেসব দিনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বনবিবির মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠলো । বনবিবি তেমন দিনে অনুভব করেছিলো ওর পিঠে এক জোড়া পাখনা গজিয়েছে ! সেই পাখনাদুটোর ভার এবং ধার বাড়াতে চেয়ে লাহাদের ছেলে বনিকে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলো ও । বনি এবং ওর মধ্যেকার সেই নতুন খেলাটা দিনকতক বেশ চলেছিলো লুকিয়েচুরিয়ে । দু’জনেই পা ফেলতো অনেক দেখেশুনে । ওরা এত সাবধান হয়েও একদিন ঠিক ধরা পড়ে গেল লাহাবাড়ির গিন্নীর হাতে ।
হয়েছিলো কি, বনবিবি সেদিন লাহাবাবুর ছেলে বনিকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দু’জনে মিলে এক নতুন ধরণের শাস্তির স্বাদ পেতে চেয়েছিলো সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে । মোটামুটি অনেকটা পথ এগিয়েও গিয়েছিলো ওরা । তারপর যখন সেই আনন্দের চরম শিখরে উঠে পড়েছে লাহাগিন্নী ঠিক তখনই বনবিবির খোঁজে এখানে সেখানে হয়ে অবশেষে সেই ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন ! বিপত্তিটা তাতেই ঘটেছিলো ! লাহাগিন্নী ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন যে । নিজের পেটের সন্তান বলে বনিকে শাস্তি পেতে হলো না বটে কিন্তু সেইমুহূর্তে বনবিবিকে পথে নেমে যেতে হয়েছিলো অপরাধের সব দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে । তাতে একপ্রকার ভালোই হয়েছিলো । ভালো হবে না ? ওই ম্যাড়ম্যাড়ে এবং ভীতুর ডিম বনিটাকে দিয়ে যে সদ্যযৌবনে টগবগিয়ে থাকা শরীরের চাহিদাটুকু তেমন করে মেটাতে পারছিলো না ও ।
যাই হোক্‌, পথে নেমে আসার পর সেঁকল ছেঁড়া পাখি হয়ে আকাশে উড়তে শুরু করেছিলো বনবিবি । এ-গাছ সে-গাছের ডালে বসেছে-উড়েছে ইচ্ছেমতো । ইচ্ছে হলে কোনো একটা গাছের ডালে বাসা বেঁধেছে কিছুদিনের জন্যে । তা সেটা কচি গাছই হোক কিংবা বিশাল মহীরুহ সেসবের পরোয়া না করেই বাসা বেঁধে ফেলতো । অবশেষে একদিন একটা শক্তপোক্ত গাছের ডালে মনের মতো করে বাসা বেঁধেছিলো ও । সেটা ছিলো ট্রাক ড্রাইভার শবর মাহাতোর শক্তপোক্ত কাঁধ ।
শবর মাহাতো ছিলো ট্রাক ড্রাইভার । ওর কাজ ছিলো ট্রাকে করে দূরদূরান্ত থেকে বালি, স্টোন চীপস, মার্বেল পাথর ইত্যাদি এনে শহরের এক বাবুর গোলায় ফেলে দেওয়া । শবর মাহাতো এবং বনবিবির উপাখ্যানটা জমে একদম ক্ষীর হয়ে গিয়েছিলো অল্পকালের মধ্যে । এমন সুখের দিনেই কিনা ওর সোনার কপাল পুড়লো ! স্বয়ং ঈশ্বরই যে সেই সুখে বাধ সেধে বসেছিলেন ।শবর মাহাতো এবং ওর সুখের পারাটা যখন একেবারে চড়া পরদায় উঠেছে ঠিক তখনই একদিন শবর মাহাতোর জীবনে ঘটে গেল একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ।
হয়েছিলো কি, শবর মাহাতো সেবারই রাজস্থান না কোথাথেকে যেন মার্বেল পাথর বোঝাই ট্রাক চালিয়ে শহরে ফিরছিলো । অর্ধেকটা পথ চলেও এসেছিলো নিরাপদে । তারপরই ঈশ্বরের কি মতি হয়েছিলো কে জানে, সেদিন দিশীমদের বোতলের সবটুকু তরল পদার্থ শবরের গলায় না ঢেলে ট্রাকটাকে গিলিয়ে দিয়েছিলেন । পরিণামে শবরের বদলে সেদিন ট্রাকটাই নেশায় চূড় হয়ে নিজের চার-পা থুড়ি চারটা চাকা আকাশপানে তুলে ধরেছিলো রাস্তায় গড়াগড়ি দেবার আদম্য ইচ্ছেটাকে দমন করতে না পেরে । পরিণামে শবরকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো ভায়া হাসপাতাল হয়ে । ওকে তখন আরও একটা কাজ করতে হয়েছে নিজের প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও । ডানহাতটাকে হাসপাতালে রেখে আসতে হয়েছে ট্রাকটার মাতলামীর নিদর্শন স্বরূপ এবং ডাক্তারদের অনুরোধে । এমনকি সেই কাটা ডানহাতটার দেখভাল করার জন্যে ওর একটা চোখকেও থেকে যেতে হলো ওই হাসপাতালে !
বনবিবির বয়স তখন মোটে এককুড়ি সাত হয়েছে ! ওই বয়সেই ওকে কিনা একজন অন্ধ – নুলো মানুষের সঙ্গে দিন কাটাতে হলো আরও কিছুকাল ! হাতকাটা চোখকানা শবর মাহাতোর পেটের আগুন নেভানোর ভারটাও যে সেই ওরই উপর এসে বর্ত্তেছিলো তখন । শবরের পেটকে কোনো সাধারণ মানুষের পেট না বলে বরং বিশাল একটা মাটির জালা বলাই ভালো । সেই জালার আগুন নেভাতে চেয়ে কোনদিন হয়তো বনবিবিকেই টপ্ করে গিলে ফেলতো ! বনবিবি অনেক ভেবেটেবে অবশেষে এটাই বুঝেছিলো যে, একটা হাতকাটা-একচোখো মানুষের খাদ্য হয়ে যাবার চেয়ে অন্য রাস্তায় গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে । তাহলে একসঙ্গে ওর অনেকগুলো আশাও পূরণ হবে । অন্য রাস্তায় হাঁটা দিলে খাওয়া-পড়ার সাথে সাথে টাকাপয়সারও অভাব থাকবে না । সেইসাথে বাবার শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পারবে ।
এতসব লাভের এবং লোভের ভারে চাপা পড়ে গিয়ে এবং পেটের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরতে না চেয়ে বনবিবি তখন মানুষের জঙ্গলে রাজ করাটাকেই স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলো । শবর মাহাতোকে আর এতটুকুও পাত্তা না দিয়ে প্রবলভাবে মেতে উঠেছিলো নিজের রাজ্যপাট নিয়ে । রাজ্যপাটে জাঁকিয়ে বসার কিছুকাল পরই একদিন আকাশ পানে মুখ তুলে চেয়ে বাবার উদ্দেশ্যে হেঁকে বলেছিলো, বাবা গো, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো ? তোমার বনবিবি যে বনে রাজ করছে গো । মনের সুখে রাজ করছে ।তা’বলে ভেবো না এটা কোনো গাছপালার বনজঙ্গল । এ হলো গিয়ে জংলীমানুষের বিশাল একটা জঙ্গল । হাজার হাজার জংলী মানুষের আনাগোনা হরদম লেখে রয়েছে এখানে । তোমার শেষ ইচ্ছে যে পূরণ করতে পারছি তা জেনে তুমি নিশ্চয়ই সুখী হয়েছো স্বগগে বসে ?
বনবিবি কি সাধ করে ‘জংলীমানুষের জঙ্গল’ বলেছে ? ওর পোড়খাওয়া যৌবনে ভরপুর শরীরটা যে জংলীমানুষদের পাল্লায় পড়ে ছিঁড়েখুঁটে একাকার হচ্ছিলো প্রতিটি রাত্রে । তবুও দিনগুলো একপ্রকার মন্দ কাটছিলো না । সেইসব দিনেই ঈশ্বর আবার দাবায় একটা নতুন চাল দিয়ে ‘কিস্তি মাৎ’ বলে বসলেন। শবর মাহাতোর সাথে বনবিবির এমন ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন যে, শবর মাহাতোকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হলো বনবিবি। সেইথেকে ভুলেও আর শবর মাহাতোর মুখদর্শন করেনি ও ।
বনবিবি আবার একটা স্বাধীন মুনিয়া পাখি হয়ে স্বাধীন ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিলো খোলা আকাশের বুকে । ওর শরীরের ভাড়ারে তখনো যে অনেক কিছুই মজুত ছিলো । বয়স তখন মোটে দেড়কুড়ি বছর । যাই হোক্‌, এডাল-সেডাল করতে করতে বনবিবির দিনগুলো বেশ সুখেই কাটছিলো । এরই মাঝে একদিন লাহাবাবুদের ছেলে বনির সঙ্গে পথে দেখা হয়ে গেল । লাহাবাবু গত হবার পর বনি যে ওকেই খুঁজে মরছিলো পাগলের মতো ! না-খুঁজে উপায় ছিলো নাকি ? যে-অমৃতের সন্ধান দিয়ে এসেছিলো বনিকে সেই অমৃতের টানই ছেলেটাকে তাড়া করে মারছিলো । বনি দেখতে পেয়েই পাগলের মতো ছুটে এসে ওকে বুকে চেপে ধরে বলেছিলো, এতকাল কোথায় ছিলি বনবিবি ? তোকে যে কত করে খুঁজেছি এখানে সেখানে । আজ আর ছাড়বো না তোকে । তোকে আজই নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলবো আমি ।
সেদিন একপ্রকার বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এসে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এবং কিছুটা শারীরিক সঙ্গ দিয়ে অনেক কষ্টে বনিকে বাড়ি পাঠিয়েছিলো বনবিবি । পাছে বনি এসে আবার উপদ্রব করে সেই ভয়ে পরদিনই শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলো ও । এরপর এ-ঘাটের সে-ঘাটের জল খেতেখেতে যখন সোনালী দিনগুলো হাত থেকে গলে গলে তলিয়ে গেল অতীতের গাঢ় অন্ধকারে তখনই একদিন হলধর মল্লিকের হাত ধরে এখানে এসে একটা ঝুপড়ি বানিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো খসাতে বসেছে ও । ওর বয়স ততদিনে দুইকুড়ি দশ হয়েছে ।
এতশত ভাবতে ভাবতে বনবিবির দু’চোখ ছাপিয়ে ঝর্‌ঝরিয়ে জল নেমে এলো । এদিকে কণকণে ঠাণ্ডাটা আবার মরণ কামড় বসাতে শুরু করেছে ওর শরীরে । ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে আরও ভালো করে শরীরটাকে পেঁচিয়ে নিতে গিয়ে দেখে দরজাটা হাট করে খোলা হয়ে আছে ! দেখেই অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ওরে শালা ! অলপ্পেয়ে-জাত শূয়োর হারামীর বাচ্চা হারুটা যে দরজাটাকে এক্কেবারে হাট করে খুলে রেখে গিয়েছে ! একবার হাতের সামনে পাই হারামীর বাচ্চাটাকে…
হারু এই তল্লাটে নেই জেনেও ওর উদ্দেশ্যে বন্য ভাষাগুলো প্রয়োগ করতে করতে চাটাই ছেড়ে উঠে দরজাটাকে ঠেসে ভেজিয়ে দিয়ে এসে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আবার চাটাইয়ের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো বনবিবি । সবে মুখের বন্য ভাষায় লাগাম দিয়েছে তখনই কে যেন দরজাটা আবার খুলে দিলো হাট করে ! বনবিবি দরজার দিকে মুখ হয়ে শুয়েছিলো । দরজা হাট করে খুলে যেতেই মুখের বন্য ভাষাগুলোকে আবার লাগাম ছাড়া করে বাতাসে ভাসিয়ে দিতে শুরু করলো । অবাক কাণ্ড, সেইসব অকথ্য অশ্রাব্য ভাষার তীব্র জোয়ারে ভেসে না-গিয়ে একটি শক্তপোক্ত যুবক এসে ঢুকলো কুঁড়েঘরের ভিতর ! সেই দেখে হতবাক বনবিবি দ্রুত উঠে বসলো চাটাইয়ের ওপর ।
ইনি আবার কে এলেন রে বাবা ! কতযুগ হয়ে গেল কোনো জোয়ান পুরুষই যে এসে ঢোকেনি ওর ঘরে ! শেষ কবে জোয়ান পুরুষের শরীরের সুগন্ধে এই ঘরখানা ভরেছিলো তাও মনে করতে পারছে না বনবিবি । কিন্তু আজ একজন মরদ এসে ঘরে ঢুকলো কেন ওর ঘরে ? পুরুষটা কি দেখেও বোঝে না এই বয়সে অতিথি সৎকার করার মতো শারীরিক ক্ষমতাটুকুও আর অবশেষ নেই এই ওর এই হাড্ডিসর্বস্ব শরীরে !
কিন্তু আগন্তুক ঘরে ঢুকে এসে এটা কি করে বসলো ? বনবিবির কাছে এসে ওর পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রনাম ঠুকে বসলো ! বনবিবির এই পোড়া কপালে কখনো একটা প্রণামও জোটেনি কারও কাছ থেকে । অথচ সেই পোড়া কপালেই কিনা না-পাওয়া প্রণামটাও জুটে গেল আজ ! এসব দেখেটেখে খুলে রাখা মস্তবড় হা-টা বন্ধ করতে ভুলে গেল বনবিবি ! যুবকটি প্রণাম করার পর নরম গলায় বললো, আমাকে দেখে খুব অবাক হয়েছো, তাই না মা ? আমি যে তোমারই সেই চুরি হয়ে যাওয়া ছেলে । রাধেশ্যাম । তোমারই পেটের সন্তান । আমার বাবার নাম রামুয়া । কি গো কিছু মনে পড়ছে তোমার ?
বনবিবির মাথায় কিছুই ঢুকছে না । ‘মা’ বলে ডাকছে ! নিজেকে ‘চুরি হয়ে যাওয়া ছেলে’ বলছে ! আবার বাবার নামও বললো রামুয়া ! কোন রামুয়ার কথা বলছে ছেলেটা ? ওই নামের কাউকে জানতো বলেও মনে করতে পারছে না বনবিবি । মনে করতে না পেরে হা করে তাকিয়ে থাকে যুবকটির দিকে ।
ব্যাপ্রতা ধরতে পেয়ে রাধশ্যাম বলে, মনে পড়ছে না তোমার, তাই না মা ? ঠিক আছে, অতীতের দিনগুলোর কিছু কথা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমাকে ।
এরপর রাধেশ্যাম যা যা বলে গেল সেসব শুনতে শুনতে বনবিবি যেন ফিরে গেল নিজেরই ফেলে আসা দিনগুলোয় । শবর মাহাতোকে ছেড়ে আসার পর রামুয়ার সাথে কিছুকাল কাটিয়েছিলো ও ! সেই সুবাদে ওদের সংসারে একটা পুত্র সন্তানও এসেছিলো । সেই ছেলে যখন হাঁটতে শিখলো রামুয়া তখনই একদিন ফুলের মতো নিষ্পাপ ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল । বনবিবির জীবন থেকে দু’জনেই হারিয়ে গেল চিরকালের জন্যে । ছেলেটার কোনো খোঁজই পায়নি শত খোঁজাখুঁজি করেও । আজ সেই চুরি হয়ে যাওয়া ছেলে কিনা মাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে ! আবার বলছে মাকে নাকি নিয়ে যেতে এসেছে নিজের কাছে !
রাধেশ্যাম নিজেই জানালো ও নাকি কোন এক ঠিকাদারের অধীনে কাঠ কাটার কাজ করছে । সেই চাকরির সুবাদে ওকে নাকি জঙ্গলেই পড়ে থাকতে হয় ! বাপ রামুয়া ওকে কোলেপিঠে করে বড় করে তুলে এই চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছে । মাসখানেক হলো রামুয়া মারা গিয়েছে । ছেলেই জানালো, শেষবেলায় রামুয়ার কি মতিগতি হয়েছিলো কে জানে মারা যাবার আগে ছেলেকে নাকি ওর মায়ের খোঁজ দিয়ে গিয়েছে ! রাধেশ্যাম আরও বললো যে, বাপ নাকি লুকিয়ে চুরিয়ে বনবিবির খোঁজখবর রাখতো । অথচ বনবিবি তার বিন্দুবিসর্গ টের পায়নি ! রামুয়া মারা যাবার আগে ছেলেকে বলে গিয়েছে, পারলে মাকে এনে নিজের কাছে রাখিস রাধেশ্যাম । ও যে আজীবন একলাটি হয়ে থাকলো । এখন থেকে তুই হবি তোর মায়ের ভরসাস্থল ।
শুনতে শুনতে বনবিবির দু’চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা নামলো । রাধেশ্যাম কি তাহলে মা’কে নিয়ে যেতে এসেছে জঙ্গলে রাজ করাবে বলে ? হরি কি সত্যিই ওকে পার করতে এসেছেন ? তিনিই কি ছেলেকে পাঠালেন এতকাল বাদে ? তারমানে বনবিবি এখন থেকে সত্যিকারের জঙ্গলে গিয়ে রাজ করবে ? তারমানে ওর এই বনবিবি নামটা এতদিনে সার্থক হতে চলেছে !
বনবিবি এর বেশী ভাবতে না পেরে জলে ঝাপ্‌সা হয়ে আসা চোখদুটোকে ঝপ্ করে বন্ধ করে দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো চাটাইয়ের ওপর ।
Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!