• Uncategorized
  • 0

ওপার বাংলা – গদ্যে রুমা মোদক  

চাকরির বাজারে

চাকরিটি আমার খুব দরকার। বাবা ধনী ব্যক্তি। ভাত কাপড়ের অভাব নেই। বরং সপ্তাহের এ মাথা ও মাথা পোলাও কোরমা খাই।মাসের এ মাথা ও মাথা  শপিংমলে যাই। ক্লজেটে কাপড় ধরে না তাই বাবার মতের তোয়াক্কা না করে আরো ক্লজেট ঘরে ঢোকাই।পাক্কা সেগুন কাঠ। ফার্নিচারের দোকানদার বেলাবেলি ফোন দিয়ে স্যার স্যার করে, বাবা বিল চুকাতে বাধ্য হন। কোন অভাব নেই। তবে অভিযোগ আছে। তাই চাকরিটি আমার খুব দরকার।
কেনোনা আমার মা খুব দজ্জাল কিসিমের মহিলা। তিনি প্রতিদিন বাবা ঘরে ফিরলে তার পকেট হাতিয়ে সব টাকা নিজের জিম্মায় রাখেন। আমাকে হাতখরচের কতো টাকা দিলেন হিসাব নেন। যে আলিশান বাড়িখানার দোতালা জুড়ে ফ্ল্যাটে আমরা থাকি তা ভাইদের ঠকিয়ে বাবা পুরোটা দখল করে নিলেও আমার মা সন্তুষ্ট নন। পুরো ফ্ল্যাটের ভাড়া তার একাউন্টে জমা হয় এবং তা মাসে লাখ টাকার কম নয়। তবু প্রতিদিন শুনি বাবাকে খোঁটা দেয়, আহমেদ চাচা বউ নিয়ে প্রতিবছর সুইজারল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড যায়। বাবার দৌড় ইন্ডিয়া থেকে সিংগাপুর পর্যন্ত।
নিজের হীরের গয়না কিনতে মায়ের বাজেটের দরকার নেই। বিবাহবার্ষিকী কিংবা জন্মদিন। ভাব দেখে মনে হবে এই একটা উদ্দেশ্যেই দিনগুলো আসে। গয়না কেনা। কখনো ২২ ক্যারেটের সোনা কখনো হীরের গয়না। মায়ের কতো গয়না আছে তার জন্য দুয়েকবছরের মধ্যে হিসাবরক্ষক নিয়োগ দেয়া লাগতে পারে।
কিন্তু তার যত্তো হিসাব আমার হাতখরচের বেলায়। কোন মাসে লিপস্টিক কিনলাম, কতো টাকায় কিনলাম, কয়টায় কিনলাম তা তার মুখস্থ। শেষ হতে কতোদিন লাগে তাও তার হিসাবের বাইরে নয়। এটা কোন কথা? নেইল পালিশের বেলায়ও তাই। আমি বের হলেই ঘরে এসে তন্নতন্ন করে খোঁজে। নতুন নেইল পালিশ কিনলাম কিনা,জুতা কিংবা জামা কয়টা কিনলাম! আমার গোপন ক্লজেটের খোঁজ সে পায় না।  ভাগ্যিস যুগটা প্রেমপত্রের নয়। হাতের ডিভাইসের। নইলে আমারে কজন প্রেম নিবেদন করেছে তাও খোঁজে বের করতো।
যাহোক যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমার একটা চাকরি খুব দরকার। লুকিয়ে বাবার অফিসে গিয়ে ভিক্ষুকের মতো টাকা চাইতে আমার ভাল্লাগে না আর। বাবাও মায়ের ভয়ে কেঁচো। এমন হিসাব করে দেয় যেনো মা টের না পায়।
আমার পড়াশোনার দৌড় বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। বাড়ির কাছের কলেজ থেকে টেনেটুনে এম এ। তাও আবার একটা বাজার পড়তি বিষয় বাংলা সাহিত্য। এই বাজারে এই বিদ্যায় কি চাকরি জুটবে?  কিন্তু চাকরি টা আমার খুব দরকার। ঘটনা হলো দোকানে একজোড়া জুতা আমার পছন্দ হয়েছে খুব। দাম মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। বাবা কিছুতেই দেবে না। বলে কিনা আমার পায়ের দাম নাকি এর চেয়ে কম!  আমি সব বুঝি।  সব মায়ের ভয়ে। বেতনের চেয়ে বেশি উপরি তাও আবার মায়ের কাছে কড়ায় গণ্ডায় হিসাব দিতে হয়।
আমি যতোই বলি ক্লজেটে  তালা দিয়ে লুকিয়ে রাখবো। বাবা বুঝতে রাজি নয়। বাবার নজর শ পাঁচেক টাকার জুতার দিকে। আমি বাবার অফিস থেকে বের হই প্রতিজ্ঞা নিয়ে। নিজে রোজগার করে জুতাজোড়া কিনবোই কিনবো।
বলছিলাম কম্পিউটার স্কিল নই, ইংরেজি জানি না এই চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য আর মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যএর বৈশিষ্ট্য পড়ে এ বাজারে কি চাকরি পাওয়া যায়? তাও ঐ মুখস্থ করা নোট। দুকলম নিজে লেখার ক্ষমতা নেই!
তবু নব্য প্রতিষ্ঠিত একটা কলেজে বাংলা বিষয়ে শিক্ষক চাইলে আমি আবেদনপত্র প্রেরণ করি। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে দু তিনদিন ধর্না দেই। বেচারা! আমার সার্টিফিকেট উলটে পালটে দেখে। পড়তে পারে কিনা কে জানে!  আমাকে আশ্বাস দেয়, ও তুমি অমুক সাহবের  মাইয়া,তোমার বাপরে কইবা আমার রাস্তার বিলটা যেনো ছাইড়া দেয়। বেশি টাকা দিবার পারুম না। তবে তোমার চাকরি নিশ্চিত। আমি নিশ্চিত হয়ে বাড়ি ফিরি।
বাবার কাছে তদবির করি কমিশনারের জন্য। বাবা সন্দেহ যুক্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। আমি কমিশন টমিশন খেলাম কিনা! বাবাকে আশ্বস্ত করলাম। বিনিময়ে আমার চাকরি হবে। বাবা খুব একটা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো না। বাবার দোষ কি!  সারাজীবন এমন রেজাল্ট করেছি, আমার কোন চাকরি হবে এমন কাঁঠালের আমসত্ত্বে তিনি বিশ্বাস করেন কিভাবে!
যাইহোক নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আমার তো আক্কেল গুড়ুম!!  আমার সাথে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরির জন্য এসেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল!  এখন উপায়। এতো পরিচিত ফেইস।সেই ছোটবেলা  থেকে বই পুস্তকে দেখেছি! ভুল হবার কথা নয়।  তবু কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম। কি আর করা অপেক্ষা ছাড়া! নাম ডাকলে নির্দিষ্ট সময়ে বোর্ডে ঢুকলাম। রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তারা। নিরুত্তর বসে রইলাম। কিচ্ছু বলতে   পারলাম না। জিজ্ঞেস করলেন নজরুলের কাব্যে মিথ পুরাণের ব্যবহার সম্পর্কে। তাও পারলাম না। কেবল একটা লাইন মনে পড়ছিলো, আমি ভগবান বুকে এঁকে দেই চরণচিহ্ন।  কিন্তু ব্যাখ্যা করতে পারলাম না। নিরুত্তর থাকলাম। থাকতে বাধ্য হলাম।
ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এলাম। চাকরির আশা শেষ। ব্যাটা জুতোজোড়া আর কদিন রাখবে!  থাকুক কি আর করা। যা শুনলাম,   বেচারা রবীন্দ্রনাথ, পয়সার অভাবে শান্তি নিকেতন নাকি বন্ধ হবার উপক্রম, নজরুল বেচারা, টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না।  আমার চেয়ে এদের প্রয়োজন অনেক বেশি। বেশ সান্ত্বনা পেলাম মনে মনে । মেনে নিলাম।
কিন্তু  একি!  নির্দিষ্ট দিনে আমার নিয়োগপত্র এসে হাজির। আমিতো অবাক। আমি তো ভাইভা বোর্ডে কিছুই বলতে পারি নি। আমার চাকরি হয় কিভাবে!
রিক্সা একটা নিয়ে দৌড়ে গেলাম ওয়ার্ড কমিশনারের বাসায়। কমিশনার দেখেই হৈ হৈ করে উঠলেন। আমার কথা আমি রাখছি, বাপেরে কইয়ো হে য্যান কথা রাখে। মিনমিন করে বললাম, কিন্তু কাকা আমিতো কিছুই পারিনি ইন্টারভিউতে, আমার চাকরি কি করে হয়?  কমিশনার ধমকে উঠলেন, রাখো তোমার ইন্টারভিউ। ঐ দুই ব্যাটার তো সার্টিফিকেটই নাই!!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।