সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৬১)

সীমানা ছাড়িয়ে

বেজার বৌ বলেছিলো, জানি না রে মিনসে। তোর কাছে যেটা পেয়েচি,উয়ার কাছে পাই লাই। তোর কাছে তাই চলে এলাম। দে এবার যত পারিস তোর মন্ত্র তন্ত্র, ঝাড় ফুকের বিষ।তবু আমার সোয়ামীর যেন ক্ষেতি না হয়। আর সন্তান দিবি। তা না হলে তোর মরণ আমার হাতে।

তারপর থেকে সাধুর কারবার আরও ফুলেফেঁপে উঠলো। বেজা দিন রাত সাধুর দেওয়া বিধি নিয়েই থাকে। তার বৌ একশো দিনের কাজ করে। মুনিষ খাটে। তা থেকেই ওদের সংসার চলে। কিন্তু বছর গড়িয়ে গেলেও সন্তান হয় না। বেজা বলে, আর যাস না সাধুর কাছে আর আমি জঙ্গলে যেচি ভয়ে।
বেজার বৌ বললো, তু কুথাও যাবি না। ঘরে থাকবি। তোর কিছু হলে হেঁসো দিয়ে সাধুর গলা দোবো পেঁচিয়ে।এখনও সন্তান হলো নি। তু এত বনে বনে গেলি। আমি পিটুলির পাতা দিলাম শালা ঢ্যামনাকে। দেখে লিবো একদিন দেখিস…

বেজা বললো, আর যাস না সাধুর কাছে। আমাদের কপাল খারাপ।
তারপর থেকে ওরা দুজনে আর আশ্রমমুখী হয় নাই। সাধু আর খবর নেয় নি। কারণ সে এখন আর একজনের পার করার কান্ডারি সেজেছে।

গোয়ালা পাড়ার সিধু ঘোষ চল্লিশ বছর বয়সে মরে গেছে। বিধবা বৌ রমা সাধুবাবার কাছে ভালো কথা শুনতে যেতো। কিন্তু গত পরশু রমাকে একা পেয়ে প্রসাদ দিলো। তার সঙ্গে নিশ্চয় কিছু মেশানো ছিলো ওষুধ বা কেনো শেকড় বাকড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রমা উত্তেজিত হয়ে সাধুকে জড়িয়ে ধরলো। রাতের অন্ধকারে সাধু নিজের সাধ মিটিয়ে নিলো।
রমা বললো,এ তো পাপ।
সাধু বললো, পাপ বলে কিছু হয় না। যাও রোজ আমার কাছে এই সময়ে আসবে।

একবার মেয়েদের ভয় ভেঙ্গে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো সাধু। তারপরের পথ কুসুমাস্তীর্ণ।

মদন কাকা আর আশ্রমে আসেন না। কানাঘুষোয় অনেক কথা শুনেছেন। তাই নিজের মধ্যেই নিজেকে নীরবতার আড়ালে ঢেকে রাখেন।

আর এদিকে সাধু একের পর এক শিষ্য বাড়িয়ে চলে আর তেষ্টা মেটায় নশ্বর শরীরের। কিন্তু নিজের সমাধির গর্ত অজান্তে কেটেই চলে।

অবিনশ্বর আত্মার কথা কেন কেউ শোনে না।

আকাশে বাতাসে দীর্ঘনিশ্বাসের মেঘছায়া নীরবে সত্যের দামামা বাজিয়ে চলে অবিরত। মানুষকুল শুনেও শোনে না কানে।

বিজয় গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলো। তারপর আবার তপশিলী। পুলিশের চাকরী একটা পেয়েছে বছর পাঁচেক হলো।

বেজার বৌ কিন্তু ভোলেনি বেইমানকে।একদিন ডেঙা পাড়ার মাম্পি, বেজার বৌকে বললো,সাধু আমার ইজ্জত লিয়েছে। চড়াম করে রাগ হয়ে গেলো বেজার বৌ এর। এর আগে বিধবা বৌ ওআরও অনেকে রিপোর্ট করেছে বেজার বৌকে। ওদের গ্রামে মেয়েরা মেয়েদের কাছে সমস্ত কথা শেয়ার করে। বেজার বৌ বললো, তু বাড়ি যা। আমি দেকচি…

চারদিকে খবরটা ছড়াতে বেশি সময় লাগলো না। লোকজন মদন কাকাকে সঙ্গে করে চলে এলো বিচার করতে। মদনকাকা বললেন,সেদিন গোড়ের ঘাটে তু আমার কথা শুনে সাধু হলি। তাও ভন্ড সাধু।
তখন শিবু বললো, আমি তোমাদের শিবু।আমাকে মাপ করে দাও। তোমরাআমাকে বাঁচাও কাকা।

মদন কাকা বললেন, তুমি এখন আমাদের নও শিবু। তুমি এখন আইনের হাতে অপরাধি শিবু।

শিবু বললো, আমি মেয়েটাকে বিয়ে করে সুখে রাখবো।
কাকা বললো, তোর মতো চরিত্রহীনকে কোনো ভারতীয় কন্যা বিয়ে করবে না।। সব চরিত্রহীনের মনে থাকা উচিত,এটা ভারতবর্ষ।

রাত পেরোলেই পুলিশ আসবে। হয়তো আজ রাতেই হাতকড়া পরবে শিবুর হাতে। শিবু তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে পালানোর জন্যে বেজার বাড়ির পেছনের জঙ্গল দিয়ে পালাচ্ছে। আজ বিজয়ের নাইট ডিউটি। তার বৌ ধারালো হেঁসো নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সাধুকে। এবার বেজার বৌ আর সাধু সামনা সামনি। সাধু বললো, কি রে আমার সঙ্গে যাবি। সন্তান দোবো। মাথায় রক্ত উঠে গেলো বেজার বৌয়ের। চালিয়ে দিলো ধারালো হেঁসো সাধুর গলা লক্ষ্য করে। পাঁঠার মতো ছট্ফট্ করে স্থির হয়ে গেলো সাধুর শরীর।
সন্তান প্রাপ্তির আনন্দে শরীর নেচে উঠলো কালী পুজোর ঢাকের তালে তালে, বেজার বৌয়ের।

থানায় আজ রাতে কালীপুজো। বারবার বলা সত্ত্বেও বেজার বৌ থানায় আসে নি। সব পুলিশ অফিসারকে নিজের বৌ

দেখানোর বড়ো সখ ছিলো বেজার। তার জন্যে নতুন এল ই ডি শাড়িও কিনে দিয়েছে পাঁচ হাজার দিয়ে। তবু বেজার বৌ বলে, এই মাটির গন্ধ আমার জীবন।
সবে আসর জমে উঠেছে আর তখনই খবর এলো সাধু খুন হয়েছে। বেজা ভাবছে সাধুর কথায় পাশ করা ছেলে হয়েও বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। ধিক তার শিক্ষাকে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, ওষুধে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর দুবছরের মধ্যে তাদের ঘরে সন্তান, মা বাবার বুক আলো করে আসবে। কিন্তু সাধু খুন হওয়াতে একরাশ বৃষ্টির ছাট তার হৃদয় ভিজিয়ে দিলো।এখন খুনের তদন্তের দায়িত্ব পরেছে তার উপর। সে এখানকার লোকাল ছেলে। সব কিছুই তার নখদর্পণে। এখানকার প্রকৃতি সহজ সরল বেজার সঙ্গে কথা বলে। লাশের কাছে দলবল নিয়ে যেতে যেতে বিজয় বাবুর চোখের সামনে তার বৌয়ের মুখের আদলে একটা মুখ আলো হাসি মাখানো চোখে ভেসে উঠলো গ্রামের শান্ত সবুজ জুড়ে…
বিজয় যখন জঙ্গলে লাশ দেখতে গেলো, তখন নিজের বাড়িতে একবার টুকি মেরে দেখলো। কাউকে দেখা গেলো না। পাশের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করেও বৌয়ের খোঁজ পেলো না। তারপর বাধ্য হয়ে জঙ্গলে গেলো।

খুন করার পরেই রক্তমাখা হেঁসো নিয়ে বিজয়ের বৌ থানায় এসে হাজির। সেএসেই বললো, আমি সাধুকে খুন করেছি। পাড়ার মেয়ে বৌ সকলে খবর পেয়ে থানায় এসে হাজির। সবাই সাধুর নামে ধর্ষণের অভিযোগ করলো। অফিসার গ্রেপ্তার করলেন বিজয়ের স্ত্রীকে। তারপর বললেন, যা হবে কোর্টে হবে। আপনারা সাক্ষী হিসাবে সকলে যাবেন।

মদন কাকা বলছেন,এই কেসে কিছু হবে না রে। ধর্ষকের কোনো মতেই বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তবে নিজের হাতে আইন তুলে নিবি না। আইনে ভরসা রাখবি। তার হাত অনেক লম্বা। কিছু উঠতি ছেলে বলে উঠলো, শালাকে খুন করে ভালোই করেছে বেজার বৌ। কাকা বললেন, ঠিক বলেছো। কাল আমরা সকলেই কোর্টে যাবো, বুঝলে হে। সবাই রাজি হলো। কয়েক মাসের মধ্যেই শোনা গেলো বেজার বৌ এর দুবছরের জেল হয়েছে। কাকা বললেন, যারা অপরের জন্যে জীবনের বাজি রাখে, সমাজকে সুস্থ রাখে তারাই হলো প্রকৃত সাধু।
পাড়ার জটাই বাগ্দি বললো, বেজার বৌ ওই খচ্চরটাকে বলি দিলো বলেই গ্রামের মা বোনের ইজ্জত বাঁচলো। তা না হলি ওর কি দায় পরেছে জেল খাটার।
কাকা বললেন, ঠিক বলেছে জটাই। সবাইকে বাঁচাতে গেয়ে ওর এই অবস্থা। স্বাধীনতার যুদ্ধে র মাতঙ্গিনী হাজরা আমাদের এই বেজার বৌ। ও আমার বয়সে ছোটো হলেওআজকে আমার মা বলে মন হচে রে। ধুতির খুঁট দিয়ে ঝাপসা চশমার কাঁচটা মুছে নিলেন কাকা।

কাকা সবাইকে বলছেন, ওদের জন্যে আমরা প্রার্থনা করি এসো। একটা সন্তান ওদের ঘর আলো করে আসুক। আর তাছাড়া আমাকে বলেছে,বিজয় শহরে বৌমাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছিলো। ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিয়ছেন। ওষুধও প্রয়োজন মতো দিয়েছেন। স্বামী, স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কের সাথে সাথে ওষুধ খাবার পরামর্শ দিয়েছেন। কোনো সিষ্ট বা অস্বাভাবিক ত্রুটি কিছুই নেই। আল্টাসনোগ্রাফি করিয়েছে শহরের ভালো ডাক্তারের কাছে। বিখ্যাত ডাক্তার আর, এন, মন্ডল বলেছেন, চার বছরের মধ্যেই সন্তান হবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।