দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২১০)

পর্ব – ২১০

ভাবতে ভাবতে শ‍্যামলীর মাথায় রক্ত ছুটতে লাগল। মনে পড়ল, পুরুষের পোশাক পরেছে, এই অজুহাত দেখিয়ে ধর্মীয় আদালত জোয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেবার উদ‍্যোগ নিয়েছে। অথচ কারাগারে তার গা থেকে যারা কাপড় কেড়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে রেখে দিল, তাদের উপর দোষ বর্তাল না।
যে রাজপুরুষ তাকে একদিন টেনে নিয়ে গেলেন, তাঁর উপর কোনো দোষ বর্তাল না! বিচারের নামে ভয়াবহ অবিচার করা হল জোয়ানের উপর। অথচ ঊনিশ বছরের মেয়েটাকে নাকি যুদ্ধ যাত্রার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেন্ট মিকায়েল, সেন্ট মার্গারেট আর সেন্ট ক‍্যাথারিন। জোয়ানের সঙ্গে কথা বলবেন বলে তাঁরা আকাশ থেকে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু অবিচার যখন ঘটছে, তখন আর সন্তদের নেমে আসার ফুরসৎ হল না। শেষমেশ জোয়ানকে সন্ত বানিয়ে ফেলা হল। ১৯০৯ সালের এপ্রিলে বিটিফিকেশন হল তার। আর তারও এগারো বছর পর ১৯২০ সালের মে মাসে ক‍্যাননাইজড হল। মৃত‍্যুর পর পাঁচশো বছর পুরতে যায় যায়, জোয়ান হয়ে গেল পুরোদস্তুর সন্ত।
জীবনানন্দ দাশ যেন হোমারের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে থাকেন..
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্‌নায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক
জোনাকির দেহ হ‌তে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা:
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে-আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্ৰ— কবেকার শঙ্খিনীমালার;
এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।
দেশ স্বাধীন। অথচ দেশের গরিবেরা স্বাধীন নয়। গরিব ঘরের মেয়েরা আরো বেশি পরাধীন। ইলা মিত্র বেথুন কলেজের গ্রাজুয়েট ছিলেন। বিবাহিত জীবনে জমিদারের বৌ। সাংগঠনিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস‍্য। আর ছাত্রজীবনে ভাল স্পোর্টস কেরিয়ার। রাজ‍্য পর্যায়ের চ‍্যাম্পিয়ন।
আর অর্চনা গুহ উত্তর কলকাতার মেয়ে। পেশায় প্রধান শিক্ষক। তাঁর হয়ে তাঁর ভাই সৌমেন গুহ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা লড়ছেন। পুলিশের হাতে অকথ‍্য যৌন নির্যাতনের পর প‍্যারোলে ছাড়া পেয়ে ইউরোপে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন।
ইলা মিত্রও সাংঘাতিক অসুস্থ অবস্থায় ১৯৫৪ সালে প‍্যারোলে ছাড়া পেয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে কলকাতায় এসেছিলেন। আর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান নি। কেননা জানতেন, তারা বিদ্রোহিণীর জন‍্য সুবিচার করবে না।
তারপর ইলা মিত্র উত্তর কলকাতার মাণিকতলা থেকে বিধানসভা  ভোটে দাঁড়িয়ে জিতলেন। দু দুবার। প্রথমবার ১৯৬২ থেকে ১৯৭১। তারপর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭। তবুও দিন বদলায় না। ১৯৭৪ সালের আঠারো জুলাই মধ‍্যরাতে পুলিশ অফিসার রুনু গুহনিয়োগী অর্চনার গুহ‍্যদ্বারে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে আঘাত করে করে তাঁকে চিরতরে পঙ্গু বানিয়ে দিলেন। আর সেই পশুর অধম রুনু গুহনিয়োগী বাম সরকারের আমলেও বহাল তবিয়তে চাকরি করছে। যতই বদলায়, আসলে কিছুই বদলায় না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।