মনস্থির করেই নিয়েছিলাম, যদি রিভিউ লিখি তবে বিনায়ক দার মন্ত্র নিয়েই লিখব ।মন্ত্র পড়তে গিয়ে এমন এক তৃপ্তি অনুভব করছি, যা দুবছর পরেও রেশ একটুও কমেনি, অনেকদিন আগেই রিভিউ লেখা উচিত ছিল , উত্তরণের মত বলতে গেলে বলতে হয় সব কিছুর জন্য সময় নিদিষ্ট করা আছে, এই প্রধান চরিত্র উত্তরণ, সদর্থক নামটা।টানটান এই উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে থামা যাবে না যতক্ষণ শেষ না হয়, উপন্যাসটি আসলে একটা দর্শনবোধ ।পড়তে পড়তে মনে হল বইটা ইংরাজিতে অনুবাদ করা দরকার । উপন্যাসের শুরুতে উত্তরণ দেশে এসেছে বন্ধু সোমনাথের বইএর উন্মোচনে ।আভিজাত হটেলে অঢেল পানভোজনের ব্যবস্থা, উত্তরনের ক্যালচার শক লাগে, বিদেশে এমনটা হয় না, উত্তরণ চমকে যায়, সোমনাথের মেয়ে তনয়াও যখন এসেছে, এত কিছুর পরেও মেয়ে এসেছে, যে গতকাল রাতে উত্তরণকে ফোন করে বলে, বাবা মাকে মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে, আমাকেও মেরেছে, মদ খেয়ে এসে এরকম বাওয়াল করে, আপনাকে ফোন করলাম, এবার আরও সবাইকে জানাব এরপরেও আপনি কী আসবেন বাবার বইয়ের উন্মোচনে, এতকিছুর পরেও মেয়ে তনয়াকে দেখে অবাক হয়, বিনায়ক দা এবার উত্তরণকে নিয়ে যায় এক সাক্ষাৎকারে, লোপামুদ্রা নামের এক মেয়ে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল, আর লেখক দর্শনের একটা দিক তুলে ধরল , লোপামুদ্রা প্রশ্ন রাখে চিরন্তনের ভিতর সাম্প্রতিক কে আবিষ্কার করবেন বলেই গীতার উপর কাজ করেছেন । উত্তরণ জবাবে বলে গীতা ছোটবেলা থেকেই পছন্দের, এখানে বলা আছে কখন নিজের মুখোমুখি হতে হবে ।বিদেশে যখন ছাত্রছাত্রীদের পড়াই তখন বলি, সমন্বয়ে আসার, তারপর বলে দর্শনকে আমি দেখি ডেনটিস্টের মত, জীবনে পাথর জমবেই আর সেই পাথর নিস্কাসনের কাজ করে দর্শন, বেরিয়ে আসার সময় উত্তরণের মনে হল কাকে বিশ্বাস করবে, তনয়া না সোমনাথকে । পুরো উপন্যাসের ভিতর এক টানাপড়েন তার ভিতর প্রেম আর আধ্যাত্মচেতনা,আর সে নিজেও নিজের মুখমুখি হয়েছে প্রতিমুহূর্তে ,পড়তে গিয়ে মনে হল উপন্যাস টা একটা স্বীকারোক্তি মৃণাল সেনের একদিন অচানক । একটা কথা উঠে এসেছে, রিলিজ! সত্যি মুক্তি হয় কিসের থেকে কিসের, সত্যিই কী মুক্তি হয়, আমেরিকায় বাঙালীদের দুর্গা পুজো করতে গিয়ে এক মাতাল তাকে চিনতে পেরে কলেজজীবনে জড়িয়ে যাওয়া এক ঘটনার কথা চীৎকার করে বলতে থাকে, পারল কি মুক্তি পেল কি সেই ঘটনা থেকে, এইরকম ভাবে ক্ষরণ কথাটা উঠে আসে বলে দর্শন একটা বিয়োগচিহ্নের মত, উত্তরণের জীবনে অনুসূয়ার আসা ছেড়ে যাওয়া বোবা মেয়ের জন্ম দেওয়া, তার কানে বীজমন্ত্র দেওয়া আর সেই মন্ত্রই একদিন স্বর হয়ে বেরিয়ে আসা, সবেতেই সে ঈশ্বর কে খুঁজেছেন । ভাললাগে “আধ্যাত্মিকের গায়ে সেক্সের সাপ”, কৃচ্ছসাধন থেকে মুক্তির, গোটা উপন্যাসটা এক আধ্যাত্মবোধ আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন, কৃচ্ছসাধন জড়িয়ে ধরে মানুসের ইচ্ছাকে, যেভাবে উত্তরণ জড়িয়ে গেছিল ফুল যেভাবে খসে পরে প্রতিরোধ থেকে, উত্তরণের মনে হতে লাগল, শরীরের উরু জঙ্ঘা নাভি স্তন অতিক্রম করে নারী হল বালি আর পুরুষ হল সমুদ্রের জল বালির ভিতর প্রবেশ করে, তখন কাউকে আলাদা করে চেনা যায় না, সমুদ্র আর বালির মতোই পুরুষ আর প্রকৃতির মিলন যা দুনিয়া উপলব্ধি করে । এইরকম টানটান সংলাপ উপন্যাসটিকে অসামান্য করে তুলেছে, ইদানিংকালে এইরকম উপন্যাস আর পড়িনি ।
কয়েকটা সংলাপ না বললেই নয়, সংলাপ ঠিক নয় আধ্যাত্মবোধ আর রোমান্টিজিম, মুক্তি, রিলিজ । কমনিজিম ভারতীয় ভাবধারা নয় প্রশঙ্গে বলতে গিয়ে বললেন যে কী এনেছে না তাকিয়ে পাঁচ ছেলের মধ্যে ভাগ করে দিতে বলে সেই কুন্তিকে কমিউনিজম বলা হবে না কেন আর স্বামী বিবেকানন্দকে সাম্যবাদ , যে রচনা করেছিল এসো আমরা এককথা বলি একসঙ্গে বলি…
৩১ নম্বর প্যারাতে আছে মানত এর পসঙ্গ । উত্তরণ মনে করে পরিবর্তন ছাড়া কোন ।কিছুই চলতে পারেনা, আবার কিছু অপরিবর্তনীয় থেকে যায় যা পরিবর্তন করা যায় না ।যেমন ছাতিম গাছটার নিচে বেধে রাখা মানতের সুতো, যাদের মানত পূর্ণ হয় তারা এসে সুতোটা খলে দিয়ে যায় । তারা কী নিজের বাধা সুতোটা চিনতে পারে! না মানত না পূর্ণ হওয়া একটা সুতো খুলে দিয়ে চলে যায় ।এই পূর্ণ অপূর্ণ চাওয়া না পাওয়ার মধ্যেই বেধে রেখেছে ভগবানকে । শেষে ঠাকুরের পাদুকার সামনে বসে মনে হল সেও ওর মেয়ের মত অসহায়।ওর যেমন তার বাবার কাছে আওয়াজ পৌছায় না ওরও তেমন ঠাকুরের কাছে আওয়াজ পৌছায় না ।উপন্যাসের শেষে এসে বিনায়ক দা লিখলেন” সিটি অফ ব্রাদারলি লাভ “ ফিদেলফিলিয়া নয় । এই সত্যসেবী আশ্রম । এখানে সব অপরিচিতই ভাই হয়ে ওঠে ।উত্তরণ জানে ঠাকুর একদিন ঠিক ফিরিয়ে নেবেন তার রাতুল চরণে । সমস্ত পাপ কে খণ্ডন করে । নাহলে তার মেয়ে মন্ত্রর কানে দেওয়া বীজমন্ত্র প্রথম স্বর হয়ে উঠবে কেন, শেষে গুরুদেবের কথাটা আত্মোৎসর্গ থেকে মহৎ নিবেদন কিছু হয় না।উত্তরণ মেয়ে মন্ত্রর হাত শক্ত করে ধরল । শাঁখ বেজে উঠল । উত্তরণের মায়ের হাত ধরে আশ্রমে আসা আর শেষে সেই আশ্রমেই ফিরে আসা এই ভিতরের জার্নির ভিতর রয়েছে উপলব্ধি এক দর্শনবোধ ।মন্ত্র উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে মনে হল ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বলতে দ্বিধা নেই সাম্প্রতিককালে এমন দার্শনিক উপন্যাস পড়িনি, যারা এখনও পড়েননি একবার পড়ে দেখতে পারেন।