এক নৃত্য শিল্পীর স্মৃতিচারণ – পৌলামী ব্যানার্জী – ৩

পেশা আর নেশা দুটোই একই; নৃত্য শিল্প। গুরুমা হিসেবে পেয়েছিলেন মমতাশঙ্করকে। ছোটদের জন্য গড়ে তুলেছেন নৃত্য শিক্ষার একটি স্কুল। ওঁর শিল্পী জীবনের গল্প বলার জন্য এই প্রথম হাতে তুলে নিয়েছেন কলম।

পর্ব – ৩

প্রতিবছর ‘মমতাশঙ্কর ড্যান্স ট্রুপ’ এর প্রোডাকশনে আমরা রবীন্দ্র সদনে বসন্ত উৎসব করতাম। এই বসন্ত উৎসব আমাদের কাছে ছিল এক উৎসবের মতো। প্রায় তিন-চার মাস আগে থেকে রিহার্সাল শুরু হয়ে যেতো। তিন-চার মিনিটের একটি নাচ উপস্থাপনের জন্য আমরা সেই নাচ অগনিতবার অভ্যাস করতাম। সেখান থেকেই শিখেছিলাম ‘অনুশীলন সাফ্যলের চাবিকাঠি’। হয়তো তিন-চার মিনিটের সেই নাচের সময় ত্রিশ-চল্লিশ জনের ভিড়ে কোনো মেয়েকে সঠিক ভাবে তার অভিভাবকগন চিনতে পারব না অথবা চিনতে পারলেও বুঝতে পারবে না, তার প্রধান কারন নৃত্যের সাবলীল সাদৃশ্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গিমায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে একাত্ব হয়ে উঠেছে। সাধারনভাবে মমমাসির নৃত্যের choreography-এর মধ্যে good-better-best নির্ধারণ করতে যাওয়া নিতান্তই বোকামি। শুধু তাই নয়, স্টেজ রিহার্সালের দিন উনি স্টেজে নিজেদের স্থান নির্ধারণের বিষয়টি সঠিক ভাবে বুঝিয়ে দিতেন। কিভাবে পারফমেন্সের মঞ্চকে ব্যবহার করতে হয়, নিজের চোখের দৃষ্টিকে কিভাবে সঠিক রেখে এক্সপ্রেশন ফুটিয়ে তুলতে হয় তার যথার্থ শিক্ষা তিনি আমাদের দিতেন। এইসব রিহার্সাল চলাকালীন আমরা সব স্টুডেন্টসরাও একে অপরের ক্রমশ বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। কোনদিন যদি কোনো অসুবিধার কারনে ক্লাসে অনুপস্থিত থেকেছি তাহলে সেই বিকেলটাই ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে উঠত। সপ্তাহে দুদিন ক্লাসটা আমাদের কাছে শৈশব থেকে কৈশোরের এক অভ্যাস হয়ে উথেছিল। এইসব ক্লাস চলাকালীন শ্রদ্ধেয়া অমলাশঙ্কর (মমতাশঙ্করের মা) আমাদের ক্লাসে আসতেন। তিন-চার বছর পর আমাদের ক্লাসের সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়েছিল ভারতনাত্যম,কথাকলি ক্লাসের জন্য। আমরাও ক্রিয়েটিভ নাচের পাশাপাশি এই দুটি শাস্ত্রীয় নৃত্যে শিক্ষানবিশ হয়েছিলাম।
আমরাও তথাকথিতভাবে কোন গানের সাথে প্রচলিত নৃত্য শিখিনি। সেই একই এক্সারসাইস বছরের পর বছর ধরে ক্লাসে ৪০-৪৫ মিনিট প্র্যাকটিস করতাম। ইংরাজি অক্ষরকে (পাঁচ জনের মধ্যে গ্রুপ করে)কিভাবে কি ভঙ্গিমায় লিখে সেখান থেকে থিম ড্যান্স করতে হয় তিনি শিখিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন নৃত্যকে কিভাবে সর্বসাধারণের অন্তরের আবেগের মাধ্যম হিসাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। বিভিন্ন আবেগ (দুঃখ, বেদনা, হাসি, আনন্দ, কান্না)কে সঠিক মুদ্রা বা সঠিক অঙ্গভঙ্গি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশের চেয়ে তিনি বেশি জোর দিয়েছেন দেহের সাবলীল অঙ্গভঙ্গিমা বা সাবলীল মৌখিক এক্সপ্রেশনের ওপর। তিনি সবসময়ে বলেছেন-“ দর্শককে সবসময়ে নৃত্য বিষয়ে বিশারদ জ্ঞানী হতে হবে তার কোন মানে নেই। দর্শক হয়তো এমনও হতে পারে যার নৃত্য বিষয়ে কোন ধারনাটুকুও পোষণ করে না। কিন্তু শিল্পীর স্বার্থকতা সেখানে যখন শিল্পী তার রুচিসম্মত পরিবেশনের দ্বারা ওই দর্শকটির মধ্যে রসস্বাদন করতে সক্ষম হবে”।
বলতে লজ্জা নেই আজও আমি নিজে মঞ্চে পরিবেশনের সময় সর্বগ্রে সেই কথাটি মেনে চলি।
এইভাবে নানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে কখন যে আট বছরের শিক্ষাবর্ষীয় কোর্সটি সম্পন্ন করে ফেললাম তা বুঝতে পারলাম না। অবশেষে ফাইনাল পরীক্ষাও দিয়ে ফেললাম। রেজাল্টও মোটামুটি ভালোই হল। এরপর সেখানে প্রচলিত ‘টিচার্স ট্রেনিং’ কোর্স টিতেও সুযোগ পেলাম। তাহার ড্যান্স ট্রুপের সদস্য হওয়া নির্ভর করে মুলত তাদের উপর যারা এই টিচার্স ট্রেনিং কোর্সটি সম্পন্ন করে। তবে বর্তমানে সময়ে সময়ে উপযোগী নিয়মাবলী পরিবর্তন হতে পারে। যাই হোক আমার পরিবারের সবাই বিশেষত আমার বাবা ভীষণ খুশি হয়। এতদিনে হয়তো তার নিরলস চেষ্টা সফল হতে চলেছিল। কিন্তু বাধ সাধল ভাগ্য। হঠাৎ ব্যাংকিং চাকরির ট্র্যান্সফারের অর্ডার এসে উপস্থিত হয়। কোনা হাওড়া থেকে প্রতিদিন মেদিনিপুরের ঘাটালে যাতায়াত করে ব্যাংকিং ম্যানেজারির যাবতীয় কাজকর্ম সেরে আমাকে সপ্তাহে দুদিন গড়িয়া হাট ক্লাস করতে নিয়ে যাওয়াটা নিতান্তই অসাধ্য হয়ে ওঠে। সেই সময়ে যৌথ পরিবারের গৃহবধূ হওয়ায় মায়ের পক্ষেও তা সম্ভব ছিল না। এছাড়া আসন্ন মাধ্যমিক পরিক্ষার (তখন আমার স্কুল লাইফ) কারনে আপাতত নাচে ইতি হয়ে যায়।
এই সময়ে প্রায় চারবছর কোথাও নাচ শিখতে যেতে পারিনি। তারপর উচ্চমাধ্যমিকের পর গুরু দ্বিপান্বিতা রায়ের কাছে ‘ওড়িশি’ শাস্ত্রীয় নৃত্যটি শেখার সুযোগ আসে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যাক্তি, যিনি বছরের প্রায় অর্ধেক সময়েই ব্যস্ত থাকেন দেশে বিদেশের নৃত্য অনুষ্ঠান নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনে সেই মানুষটি যে কতো সাধারন হতে পারে তা দ্বিপান্বিতাদিকে না দেখলে বোঝা যায় না। আমি যদি আজ নিজেকে ওড়িশি নৃত্য শিল্পী হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকি তবে সেই অবদান সম্পূর্ণ রুপে দ্বিপান্বিতাদির। ক্রিয়েটিভ নৃত্য এর ধারক থেকে সম্পূর্ণ নিজের নৃত্যের ধরনকে বদলে ওড়িশি নৃত্যের ধারাটিকে অনুশিলন করা নিতান্তই সহজসাধ্য ছিল না। তবে দিদি অতন্ত্য স্নেহের সঙ্গে আমাকে ওড়িশির বেসিক স্টেপ (চৌকা ও ত্রিভঙ্গি) শিখিয়েছিলেন। আজও মনে পড়ে যেদিন গড়িয়া হাটের ‘সুরতীর্থ’ এ ক্লাস করে বাড়ি ফিরতাম সেদিন রাত্রিতে পায়ের ব্যাথায় প্রায় ঘুমোতে পারতাম না। তবে ক্লাস করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ এই ধারাটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠি।

ক্রমশঃ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।