কবিতায় আমি কলার তুলতে চাই (পর্ব – ১৬)
এই সময়পর্বে শুধু বিভাজনটাই স্পষ্ট হয়েছে আরও, একে অপরকে গভীর সন্দেহ করতে শিখেছি আমরা ; আমাদের বিপন্ন ধর্মমত বিস্ময় হয়ে গেছে একাধারে। এখন রাগ বানানোর খেলা, এখন দোষ চাপানোর ধুলা অন্যের মুখে ছড়িয়ে দিয়ে ছিঁটিয়ে দিয়ে ইস্তেহার লেখার সময়। এখন নিকেল করা বিকেলবেলা। আমাদের বিকেল মানেই রজনীগন্ধার বন, পাটক্ষেত পায়ে রেখে এগিয়ে যাওয়া, এগিয়ে যাওয়া ঘাসবাধানো সমান পাড় আমার ভীষণ প্রিয়, আর প্রিয় জিনিসগুলো ক্রমশই ফুটপাত হয়ে যায়। তার কাছে দুদণ্ড বিশ্রাম চাইলে, কে না জানে সেই দাম কী ভীষণ ভাবে চোকাতে হয়! তারপরেও এর কাছাকাছি পৌঁছতে স্বপ্নের জোঁক উড়ে যাবে। বাতাসে লালারসের গন্ধ আমাদের সমস্ত নুন চুষে ফুৎকারে ঘোষণা করবে অন্ধকার। অন্ধকার পুড়ে যাওয়ার আগে যদি মাঝারি রকম বৃষ্টি আসে, যদি মনে হয় এই চামড়া রঙের ছাতা নিজের জন্য যথেষ্ট নয়, যদি এই বিস্ময় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে গৌঁধূলিও বুজে আসে, তখন তাকে দ্যাখা যায়। শ্বাস থেমে এলে তাকে জেনেছি, মুখে লালারসের গন্ধ নিয়ে তাকে হজম করার সাধ্যি কারো নেই। সুতরাং
কবিতা শুনিয়া কেহ যখন বলে ‘বুঝিলাম না’ তখন বিষম মুশকিলে পড়িতে হয়। কেহ যদি ফুলের গন্ধ শুঁকিয়া বলে ‘কিছু বুঝিলাম না’, তাহাকে এই কথা বলিতে হয়, ইহাতে বুঝিবার কিছু নাই, এ কেবল গন্ধ। উত্তর শুনি, ‘সে তো জানি, কিন্তু খামকা গন্ধই বা কেন, ইহার মানেটা কী।’ হয় ইহার জবাব বন্ধ করিতে হয়, নয় খুব একটু ঘোরালো করিয়া বলিতে হয়, প্রকৃতির ভিতরকার আনন্দ এমনি করিয়া গন্ধ হইয়া প্রকাশ পায়। কিন্তু মুশকিল এই যে, মানুষকে যে-কথা দিয়া কবিতা লিখিতে হয় সে-কথার যে মানে আছে। এই জন্যই তো ছন্দোবদ্ধ প্রভৃতি উপায়ে কথা কহিবার স্বাভাবিক পদ্ধতি উলটপালট করিয়া দিয়া কবিকে অনেক কৌশল করিতে হইয়াছে, যাহাতে কথার ভাবটা বড়ো হইয়া কথার অর্থটাকে যথাসম্ভব ঢাকিয়া ফেলিতে পারে। এই ভাবটা তত্ত্বও নহে, বিজ্ঞানও নহে, কোনোপ্রকারের কাজের জিনিস নহে, তাহা চোখের জল ও মুখের হাসির মতো অন্তরের চেহারা মাত্র। তাহার সঙ্গে তত্ত্বজ্ঞান, বিজ্ঞান কিম্বা আর-কোনো বুদ্ধিসাধ্য জিনিস মিলাইয়া দিতে পারো তো দাও, কিন্তু সেটা গৌণ। খেয়ানৌকায় পার হইবার সময় যদি মাছ ধরিয়া লইতে পার তো সে তোমার বাহাদুরি, কিন্তু তাই বলিয়া খেয়ানৌকা জেলেডিঙি নয়; খেয়ানৌকায় মাছ রপ্তানি হইতেছে না বলিয়া পাটুনিকে গালি দিলে অবিচার করা হয়।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমি একমত যে, কিছু একটা বুঝাইবার জন্য কেহ কবিতা লেখে না, হৃদয়ের অনুভূতি কবিতার ভিতর দিয়া আকার ধারণ করিতে চেষ্টা করে মাত্র। অতঃপর
মাটিতে একটু হাত রাখি, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি বাস্তুতন্ত্রের ইতিহাস, আর্তনাদধ্বনি লেগে আছে জ্বলনশীল ফুলে, আজ সারারাত কুঁড়ি থেকে কুসুম পরিবর্তনের পাশে জেগে থাকব স্বার্থপর যুবকের মতো, যুবতী বায়ুর সমাবেশ ফেলে নির্বাসন মেনে নেবো, তবু গাছের ফুসফুস থেকে রক্তক্ষরণ নয়, রোজ রোজ এসে অনামিকা ছুঁতে ছুঁতে অনামী কলাকোশ স্মৃতিতে জড়িয়ে যায় : একাকার, আমি ভূমিষ্ঠ হই কথায়, বার্তায় রাখি অপার্থিব জল, মৃতদেহের মতো খুঁজে নিই নিঃসন্তান ছিপছিপে ঠোঁট, অতঃপর কস্তূরী গন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়ি, দিনের পর দিন আমার কোনো খোঁজ থাকে না, আমি জলের বদলে হাবুডুবু, আমি জীবনের স্থলে অত্যাচার খেলতে খেলতে দেখি অজস্র তীরের ফলা মেদিনী ভেদ করে দিচ্ছে, মাটির ব্যথা আমরা বুঝি না তবু, আমি তো বুঝিই না এর সাথে সবার কীসের এতো সঙ্গম!
ক্রমশ…