বিছানার ওপর শোয়া মিসেস রিন্দানীকে একবার দেখেই ডাঃ, গোড়বোলের অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারলো মহিলাটির মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু বিছানার পাশে দাঁড়ানো দেবাঙ্গী রিন্দানীর মুখের অবস্থা দেখে সত্যি কথাটা বলতে একটু বাঁধো বাঁধো ঠেকলো ডাঃ, গোড়বোলের। উনি চুপচাপ একজন ডাক্তারের কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। স্টেথোস্কোপ সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, দেবাঙ্গীর দেওয়া ব্লাডপ্রেসার মনিটর দিয়ে মেপে দেখলেন, মিসেস রিন্দানীর রক্তচাপ অনেকটাই বেশি। উনি মিসেস রিন্দানীর জিভের তলায় একটি বিশেষ ধরনের এসওএস ট্যাবলেট দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। দেবাঙ্গী জানালো ও সর্বপ্রথম সেই কাজটিই করেছে, কিন্তু কোনো ফল হচ্ছেনা দেখে ও ত্রিবেণীকে ফোন করে। ডাঃ, গোড়বোলে বুঝলেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তবুও উনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে মিসেস রিন্দানীর নাড়ী দেখলেন, দেবাঙ্গীর কাছে জানতে চাইলেন ওঁকে কি কি ওষুধপত্র দেওয়া হয়, সারাদিনে উনি কি কি খান। দেবাঙ্গী গড়গড় করে বলে যেতে লাগলো রোগে জর্জরিত মায়ের দিনচর্চার গল্প। ডাঃ, গোড়বোলে এবার ভালো করে দেবাঙ্গীর দিকে চেয়ে দেখলেন; মেয়েটা বেশ সুন্দরী, খুব বেশি সেক্স অ্যাপিল নেই ঠিকই কিন্তু এমন কিছু একটা আছে যা পুরুষমানুষকে কাছে টানে, গিলে ফেলতে চায় অজগর সাপের মতো।
জয়শ্রীর মুখ থেকে বের হওয়া একটা অস্পষ্ট শব্দে সম্বিত ফিরলো ডাঃ, গোড়বোলের। উনি আবার গম্ভীর মুখে মিসেস রিন্দানীর নাড়ী দেখার উপক্রম করলেন। কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়ল না, মিসেস রিন্দানীর প্রাণপাখি ততক্ষনে দেহের খাঁচা চিরতরে ত্যাগ করেছে। নতুন করে কিছু বলতে হল না, ওঁর মুখ দেখে সবই বুঝে নিল দেবাঙ্গী। আর বুঝতে পেরেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। জয়শ্রী আর ত্রিবেণী দুজনে মিলে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে লাগলো দেবাঙ্গীকে। কান্নার সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে দেবাঙ্গীর শোকার্ত শরীর। ত্রিবেণী একটু নিচু হয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর হাতে। নিচু হওয়াতে ত্রিবেণীর কুর্তির গলার কাছটা ঈষৎ ফাঁক হয়ে গিয়েছে, উঁকি দিচ্ছে ভরাট বুকের একাংশ। সেদিকে বিভোর হয়ে দেখতে দেখতে ডাঃ, গোড়বোলের মনে হল একবার বাথরুমে গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু এই মড়ার বাড়ির বাথরুমে যেতে একেবারেই ইচ্ছে হল না ওঁর, তাছাড়া সেটা শোভনীয়ও নয়।
উঠে দাঁড়ালেন ডাঃ, গোড়বোলে। জয়শ্রীর শরীরের দোহাই দিয়ে বিদায়ের অনুমতি চাইলেন ত্রিবেণীর কাছে। জানালেন ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না, নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর উনি নিজে এসে ডেথ সার্টিফিকেটের দিয়ে যাবেন। দরজা বন্ধ করার জন্য ত্রিবেণী এলো ওদের সাথে। বিদায়ের মুহুর্তে ডাঃ, গোড়বোলে আর একবার আড়চোখে তাকালেন ত্রিবেণীর বুকের দিকে। না, আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, ক্লিভেজ ঢাকা পড়েছে পোষাকের আবরণে।
দ্রুত পা চালালেন ডাঃ, গোড়বোলে। জয়শ্রী ওঁর সাথে তাল মেলাতে না পেরে পিছিয়ে পড়লেন। কিন্তু ডাঃ, গোড়বোলে সে দিকে খেয়াল করলেন না। উনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললেন নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। আমেজের রেশ থাকতে থাকতে বাথরুমে ঢুকে পড়ার জন্য…
____________
ডাঃ, গোড়বোলে বিদায় নেওয়ার পর কেটে গিয়েছে বেশ কিছুটা সময়। খাটের উল্টোদিকে থাকা সিএফএল-এর তীব্র আলোটা ত্রিবেণী রঙ্গরাজনের চোখের ওপর এসে পড়ছে। তা সত্বেও অপরিসীম ক্লান্তিতে বার বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওর চোখের পাতা দুটো। কোকিলাবেন রিন্দানীর মড়া আগলে লাল প্লাস্টিকের শক্ত চেয়ারটাতে এভাবে ঠায় বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না ত্রিবেণীর, ইচ্ছা করছে ঘরে ফিরে স্নান করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিজের বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পড়তে। ছোট্ট একটা হাই তুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল ত্রিবেণী, দেবাঙ্গী আশেপাশে কোথাও নেই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। এগিয়ে গেল জানালার দিকে। হালকা হাতে জানালার পর্দাটা অল্প একটু সরিয়ে দিয়ে দেখল বাইরে সবে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ছ’টা বাজতে চলল তাহলে। ঘুম তাড়াবার জন্য হাতের পাতা দুটো চোখের পাতার ওপর একবার ঘষে নিলো ত্রিবেণী। ঘরের ভেতর কেমন একটা দমবন্ধ করা গুমোট ভাব, জানালার কাচ অল্প একটু ফাঁক করে দিয়ে ও আবার চেয়ারে বসতে গেল। কিন্তু শক্ত চেয়ারটাতে অনেকক্ষন ধরে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকার ফলে ওর পিঠে আর কোমরে টান ধরতে শুরু করেছে, ভারী নিতম্ভে জমতে শুরু করেছে চাপ চাপ ব্যথা। জানালার কাচ বন্ধ করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল ত্রিবেণী। পাশের ঘরে একমনে খুব নীচু স্বরে কারও সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলছে দেবাঙ্গী, ও কথা বলতে এতোটাই মগ্ন যে দরজার বাইরে ত্রিবেণীর উপস্থিতি টেরই পেলো না। ত্রিবেণী ওদের বসার ঘরে এসে নরম সোফাটাতে আয়েশ করে গা এলিয়ে দিল।
আচ্ছা, এতো সকাল সকাল এতো বিভোর হয়ে কাকে ফোন করছে দেবাঙ্গী ? ওর দাদা জিগনেশকে ? কিন্তু তাকে তো বোধহয় কাল রাতেই ফোন করেছে, ত্রিবেণীর সামনেই।
জিগনেশকে অল্প অল্প মনে আছে ত্রিবেণীর। শান্তশিষ্ঠ ভালো ছেলে, বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান। তবে জিগনেশের বিয়ের পর থেকে রোজ ওদের ঘরে অশান্তি হোতো। ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যেতো নীচের কম্পাউন্ড থেকে। তারপর একদিন জানা গেলো জিগনেশ বউ নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গিয়েছে। সে সব অনেকদিন আগের কথা, তখন তো মিস্টার রিন্দানীও বেঁচে ছিলেন।
মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও কি জিগনেশ পারবে এখানে আসতে? কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোর থেকে মহারাষ্ট্রের পুনাতে? বোধহয় না, কারন লকডাউনের জন্য এখন ইন্টার-স্টেট ট্র্যাভেলিং পুরোপুরি বন্ধ। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল ত্রিবেণী। পুত্রবতী হওয়া সত্বেও কন্যার হাতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে কোকিলাবেন রিন্দানীর।
নরম সোফায় বসে থাকতে থাকতে আবার ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে লাগলো ত্রিবেণীর। দেবাঙ্গীর কোনো সাড়াশব্দ নেই, বোধহয় মায়ের কাছে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। মা ছাড়া আর কেউই তো ছিল না মেয়েটার। এবার কি হবে দেবাঙ্গীর ? কিভাবে কাটবে ওর বাকি জীবনটা ??
মোবাইল ফোনের কনট্যাক্ট লিস্ট থেকে বাসু সাকলানির নম্বর খুঁজে বার করে নামের নীচে থাকা ফোনের চিহ্নটায় আঙুল ছোঁয়ালো ত্রিবেণী। কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর ফোন ধরলেন বাসু আঙ্কল। ত্রিবেণীর কাছে সব কিছু শুনে উনি ঘুম জড়ানো গলায় আশ্বাস দিলেন, ফ্রেশ হয়ে অল্পক্ষনের মধ্যেই আসছেন ত্রিবেণীকে সঙ্গ দিতে।
ফোন রেখে আড়মোড়া ভাঙলো ত্রিবেণী। এখন দেবাঙ্গীর পাশে বসে ওকে একটু স্বান্তনা দেওয়া উচিত, কিন্তু মন চাইলেও শরীর একেবারেই সঙ্গ দিচ্ছে না ত্রিবেণীকে। হাত দুটো মুখের ওপর ঘষে নিয়ে চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা করলো ত্রিবেণী। আর তো মাত্র কিছুক্ষন, একবার বাসু আঙ্কল এসে গেলেই ত্রিবেণী ছাড়া পাবে। নিজের ঘরে গিয়ে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে ঘুমিয়ে নেবে কিছুক্ষন। কোকিলাবেন রিন্দানী মারা গিয়েছে বলে অফিস তো আর ত্রিবেণী রঙ্গরাজনকে একদিনের ছুটি মঞ্জুর করবে না। যতই কষ্ট হোক আজও ওকে রোজকার মতোই নির্দিষ্ট সময় সেজেগুজে অফিসে বের হতে হবে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ত্রিবেণী। মিসেস রিন্দানীর বেডরুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই শোনা গেল কলিং বেলের আওয়াজ। কেউ খুব হালকা ভাবে হাত রেখেছে দরজার পাশে থাকা বড় সুইচটার ওপর। ত্রিবেণী ভাবে, সত্যি, বাসু আঙ্কলের জবাব নেই। এতো কম সময়ের মধ্যেই এসে হাজির হয়েছে। খুশি মনে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ও।