হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ২১)

চললুম ইউরোপ

আমাদের নেক্সট প্ল‍্যান শোন…. এখন আমরা ‘সেইন ‘ ( seine) নদীতে ক্রুজে চড়ে ঘুরবো।
এখনও সূর্য মাথার ওপর সন্ধে পর্যন্ত কি করব আমরা।
বাবাই দারুণ খেলাম নেক্সট প্ল‍্যান কি? মা সামনের নদীতে দেখ কত ট‍্যুরিস্ট বোট…..এখন আমরা ‘সেইন’ (seiine ) নদীতে বোটে চড়ে ঘুরব।
উঠে দেখলাম চমৎকার সিটিং এ‍্যারেঞ্জমেন্ট। অনেকে উঠেই সিঁড়ি দিয়ে ক্রুজের ছাদে উঠে যাচ্ছে আমারও ইচ্ছা করছে ওপরে ওঠার তবে রাশভারি কত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস পাচ্ছি না। ছেলেকে বললাম বাবাই ওরা সবাই ওপরে যাচ্ছে কেন! মা, এটা প্রেমের শহর। লোকজন তাদের টাইম এনজয় করবে। আইদার তুমি এখানে বোস অর ডু হোয়াটএভার। অগত‍্যা চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কত সৌধ প‍্যারিসের কত সুবিখ‍্যাত আকর্ষণ। এক ঘন্টার এই ক্রুজজার্ণি শুরু হয় পন্ট ন‍্যুফ (Pont Neuf) প‍্যারিসের সবথেকে পুরোনো ব্রীজ থেকেও যদিও আমরা উঠলাম আইফেল টাওয়ারের সামনে থেকে। চলমান কমেন্ট্রির ব‍্যবস্থা আছে তাতে। আইফেল টাওয়ার তো আছেই আছে নোতরদাম ক‍্যাথিড্রাল(Notre dame cathedral) তার গথিক আর্কিটেকচার , মুসি ডি ওরসে (Musee d’Orsay) ল‍্যুভর (Louvre) ম‍্যুজিয়াম। দিনরাতে অনেকবার চলে এই বোটট‍্যুর। অনেক ব্রীজ আছে কোনটা আবার লাভারদের জন‍্যে লাকি। এখানে নাম লিখে দিলে নাকি খুব শুভ হয়। মতান্তরে এর নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় যা প্রার্থনা করা যায় তা নাকি সত‍্যি হয়। আমি একাই এখন ক্রুজের ছাদে…. জলের হাওয়া আর ঠান্ডা উপেক্ষা করে প্রেমিক প্রেমিকারা ঘনিষ্ঠ মূহুর্ত্তে মশগুল। আমার বেশ লাগছে তরুণ তরুণিদের দেখে। আস্তে আস্তে রং লাগল আকাশে জলেও তার ছায়া পড়ল। ইতিহাস আর স্থাপত‍্যের আকর্ষণ পেরিয়ে প্রক‍ৃতির এই অনির্বচনীয় উদ্ভাস আর জীবন্ত প্রেমস্থাপত‍্য আমায় মুগ্ধ করে রাখল বহুক্ষণ।

কি করে একঘন্টা সময় পেরিয়ে গেল বোঝার আগেই ফিরে এলাম স্টার্টিং পয়েন্টে। এবার নামতে হবে অগত‍্যা ক্রুজের খোলে এলাম। এবার আমাদের যেতে হবে ব্রীজ পেরিয়ে খানিকটা হেঁটে একটা উঁচু জায়গায় যেখান থেকে আইফেল টাওয়ারের ইলিউমিনেশন প্রোগ্রাম দেখা য়ায়।
আমরা সময় হওয়ার একটু আগেই পৌঁছে গেলাম যাতে সুবিধেজনক জায়গায় দাঁড়াতে পারি। সামনের সারিতে না পেছনের আরো উঁচু জায়গায় দাঁড়াবো এসব ভাবতে গিয়েই দেখলাম দারুণ সব টেলিলেন্স, জুমলেন্স ইত‍্যাদি নিয়ে লম্বাচওড়া লোকজন। অতএব আমি সামনে থেকে নড়ছি না। শুনলাম অন্ধকার ঘনিয়ে এলে আইফেল টাওয়ারের গোল্ডেন লাইট স্বয়ংক্রিয় ভাবে জ্বলে ওঠে।
বাবাই বলল লাইটসেন্সিটিভ সেনসর লাগানো আছে। আমাদের রাত একটা পর্যন্ত চলে এই আলোর উৎসব। শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর। মূল স্রষ্টা ‘ পিয়ের বিডো’ ( Pierre Bideau) ছিলেন একজন লাইট এঞ্জিনিয়র। তাঁর যে টিম এই অসাধারণ কাজটা করেছিল সেখানে বিশ্বের ৫০জন আলোকস্থপতি ছিলেন তাঁদের মধ‍্যে অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস‍্য ছিলেন ভারতের তাপস সেন।এই সিস্টেমে ৩৩৬টা প্রোজেক্টর , হলুদকমলা অতি শক্তিশালী সোডিয়াম ল‍্যাম্প আছে। শীর্ষদেশে চারটে প্রোজেক্টর রোটেট করে, প্রতিটা ঘোরে ৯০ ডিগ্রী। শীর্ষদেশ থেকে দুটো জ‍্যোতিরেখা স্বচ্ছ, নির্মেঘ রাতে প্রায় ৮০কিলোমিটার পর্যন্ত প্রভা বিস্তার করে।

প্রতি ঘন্টায় পাঁচ মিনিট করে ঝিলিমিলি আলো জ্বলে যখন, ওপরের বেকন বন্ধ থাকে। 20000 ছয় ওয়াটের বাতি জ্বলে দ্রুত হারে।
১৮৮৯এ যখন টাওয়ার উদ্বোধন হয় তখন গ‍্যাসই ছিল একমাত্র আলোর উৎস। আইফেল টাওয়ারের আলোর দায়িত্বে ছিল ১০০০০ গ‍্যাস লাইট । তারপর বিজ্ঞান স্পর্শ করল নতুন শীর্ষ।
১৯০০ সালে ইলেকট্রিসিটি এল। স্বাভাবিকভাবে আলোকোৎসবের দায়িত্ব চলে গেল ইলেকট্রিক আলোর দখলে।
উৎকন্ঠ অপেক্ষায় সবাই মূহুর্ত গুণছি আমরা। কখন শুরু হবে সেই বিশ্ববিশ্রুত আলোর রোশনাই। একসময় অধৈর্য হয়ে ভাবছি আর কত অন্ধকার হবে! হঠাৎ চোখের সামনে যেন ভোজবাজি ঘটতে লাগল…. কি অনবদ‍্য আলোর নাচ শুরু হল কালো আকাশের মঞ্চে। চোখের পলক ফেলবার অবকাশ নেই…. ক‍্যামেরার সাটার টিপতেও ভুলে গেছি। সম্বিত ফিরল বিদেশি নানারকম মুগ্ধতার আওয়াজ শুনে। আমার মোবাইল ক‍্যামেরাও সচল হয়ে স্মৃতির বাক্স বোঝাই করতে লাগল। মনে হচ্ছিল…. মনে হচ্ছিল লাখ লাখ আলোর প্রজাপতি ‘চঞ্চল পাখনায় উড়ছে’
আটকে গেছে বেরোতে পারছে না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।