• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ৩)

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

শীত যা পড়েছে! ভোর ভোর উঠে ট্রেন ধরা খুব দুঃসহ। অভ্যেস নেই। অনেকেই তো রাত তিনটায় উঠে ট্রেন ধরে। কাজ বড় বালাই। পেট টানলে রাত তিনটাকেও মনে হবে সোনালি সকাল। এই ক-বছরে চুল পেকে মাথা পাকা হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশও উঁকি দিচ্ছে। এই চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছেও নিজেকে ভীষণ ভীষণ দামি আর জরুরি মনে হয় অর্ণবের। জীবনে দুঃখ থাকলেও আনন্দও ওজনে কম হবে না।
চারটে দশ-এ ট্রেন। এখন তিনটা কুড়ি। একটু কফি খেয়ে নিলে হয়। দুধ সামান্য পড়ে আছে। তা দিয়েই আপাতত হয়ে যাবে। অর্ণব সময়ের হিসেব কষছে। বাইকে স্টেশন সাত মিনিট। টিকিট কাটতে পাঁচ মিনিট। যদি ভিড় থাকে! এতো ভোরে ভিড় তেমন থাকবে বলে মনে হয় না। যদি বা থাকে আরো দশ মিনিট। তাহলেও ট্রেন মিশ হবে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। না তেমন বুড়ো বুড়ো লাগছে না। গ্যারেজের ধুলো কালিও লেগে নেই। এই বয়সেও বিয়ে করা যায়। কত লোক করে। অর্ণব করলেই দোষ! এতদিন বিয়ের কথা মনেই ছিল না। রাকা, হ্যাঁ রাকাই তো উস্কে দিল দেশলাই। হয় জ্বলে মর না হয় জ্বালিয়ে দে। অর্ণবের ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে এল গান, “দোষ কারো নয় গো মা স্বখাত সলিলে ডুবে মরি।”
ট্রেন চলছে। আধো অন্ধকার ছিঁড়ে দিচ্ছে অন্ধকার বাল্ব। ট্রেনের হেডলাইট। কল্পনাতে ভেবে নিচ্ছে অর্ণব।কারণ জানলা বন্ধ। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বন্ধুরা বলেছিল, ‘আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখ। এই রকম সাদা মাথায় কেউ পাত্রী দেখতে যায়! আজকাল বাজারে কত রঙ! বুড়ো বুড়ো ভাবটা নিমেষে বদলে যাবে। ইয়াং লাগবে।’ অর্ণব শুনেছিল। মনে মনে হেসেও ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েওছিল। ছিঃ। নিজের সঙ্গে নিজের প্রতারণা। না, চুলে সে কিছুতেই রঙ করবে না।
আর চার-পাঁচটা স্টেশন। তারপরই আনন্দপুর। কী সুন্দর নাম! ওখানকার মানুষেরা সবাই কি সুখে থাকে। ধ্যাৎ ভুল হচ্ছে। বলো সবাই কি আনন্দেই থাকে। কথাটা কে বলল! কেউ তো নেই। নিজের মনের দ্বিখণ্ডিত একখণ্ড আরেকখণ্ডকে এইসব কথা বলে যায় অবিরাম-অবিরত।
‘দাদা টাকাটা দিন।’ গলা শুনেই সম্বিত ফিরল অর্ণবের। ঝালিমুড়ি খেয়েছে। তার টাকা চাইছে মুড়িওয়ালা। মুড়ি দিতে দিতে ট্রেনের এমাথা  থেকে ওমাথা। ফিরে এসেছে বকেয়া নিতে। পকেট থেকে পাঁচ টাকার কয়েন বার করল অর্ণব। মুড়িওয়ালা ছোকরা, ‘পাঁচ নয় দশ দিন। পাঁচ টাকার দিন শেষ হয়ে গেছে কাকু। জলদি করুন, সামনে নামব।’
ঝালমুড়ির ব্যবসা একটা দারুণ বিজনেস। কম পুঁজিতে বেশি লাভ। পাঁচশো টাকা খাটালে পাঁচশো লাভ।
আনন্দপুর স্টেশনে নেমে রিক্সা নিল অর্ণব। এখান থেকে দু-কিলোমিটার দূরে তন্ময়বাবুর বাড়ি। ওঁর বড় মেয়ে অনুস্মিতা। ইস্  ভুল হল। একটাই তো মেয়ে।  তার আবার বড় ছোট কী! পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লাই করেছিল। রাকার কথাটা খচ করে লেগেছিল বুকে। তাই। আজকেই আসতে বলেছেন।
-‘আমি অনুস্মিতা। আপনার নাম অর্ণব; তাই তো।’ মিষ্টি করে হাসল মেয়েটি।
মনটা উসখুস করছে। তবু জোর করে অর্ণব ও হাসি হাসি মুখ করল। কাঁচাপাকা চুলগুলো উঁকি দিচ্ছে। ধ্যাৎ, উঁকি নয় জানান দিচ্ছে। টুপিটা পরে থাকলে ভালো হত। এখন তো শীতকাল। ভালোই হতো।
মেয়েটির মা খাবারের দুটো প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। -‘তোমরা বাবা গল্প করো। সংকোচ করো না। দুজন দুজনকে জেনে নাও। তারপর পাকা কথা হবে। বিয়ে অত সহজে হয় না বাপু। আজকাল কী আর সেই দিন আছে! একেবারে ছাদনাতলায় দেখা হবে দুজনের তাও আবার শুভ দৃষ্টির সময়। খাও বাবা খাও। সংকোচ করো না। তোমাদের বয়সে অনুর বাবা ষাটটা রসগোল্লা খেতেন। আর আজকালকার ছেলেরা চারটে খেতেই কুঁকড়ে যায়।’ এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলেন মেয়ের মা। অর্ণবের হাসি পেল। অনুস্মিতা বলল, ‘তুমি থামবে মা। তুমিই যদি সব কথা বলো, আমরা কী বলব!’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা বেরিয়ে গেলেন। অনুস্মিতা বলল, ‘আপনাকে তুমি করেই বলি। আজ আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তোমার মোবাইল নাম্বরটা দাও। আমি ফোন করব।’
অর্ণবের রাগ হচ্ছে। অত ভোর ভোর উঠে এতদূর আসা শুধু মোবাইল নাম্বর দিতে। মোবাইল নাম্বর তো ওর বাবার কাছেই ছিল। তবু নিজেকে সামলে নিল।
অর্ণব যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত নটা। কিছুই খাওয়া হয়নি। শরীরে ক্লান্তি নেমে আসছে না কিন্তু নামার তো কথা ছিল। ফ্রেস হয়ে টিভি চালাল।
বৃষ্টির জন্য ভারত পাক ম্যাচ হচ্ছে না। চ্যানেল পাল্টে পাল্টে যেতে লাগল। কফি খেলে হয়। রান্না ঘরে ঢুকল। না, দুধ নেই। লিকার চা বানাল। একটা সুপ বানালে হয়। আলু ফুলকফি, পালং, গাজর, মটরশুটি, ধনেপাতা, টম্যাটো আর বিন দিয়ে। মুড়ির সঙ্গে দারুন হবে। অনুস্মিতা কি রান্না করতে জানে! অ্যাই যা কোনো কথাই তো হয়নি।
মোবাইলে ভেসে উঠল একটা অজানা নাম্বার। রিসিভ করতেই।
-‘আমি অনুস্মিতা বলছি। বাড়ি পৌঁছে গেছ।’
-‘হ্যাঁ।’ যাক মেয়েটা কথা রেখেছে। মনে মনে স্ফূর্তি অনুভব করল অর্ণব।
-‘অর্ণব আমার জীবনে একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা যাই বলো তা আছে। বড় জোর দু-তিন মিনিট লাগবে। তোমার সময় আছে! শুনবে!’ খুব ঠাণ্ডা শোনাল গলাটা।
-‘বলো।’ উদ্বেল হল অর্ণব।
-‘আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম। তা ধরো স্কুল বয়স থেকেই। ও আমার সহপাঠীও ছিল। সেও আমাকে ভালোবাসত। আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার শারিরীক ব্যাপার-স্যাপার ও  হয়েছে। ছেলেটা খুব ভালো। সদ্য সদ্য একটা চাকরিও পেয়েছিল। দাঁড়াও একটু জল খেয়েনি।’
অর্নব ভাবল যাক আমার ভাগ্যে বিয়ে বোধ হয় নেই। এটাও ফস্কে গেল। অনুস্মিতা বলল, ‘শুনছো!’
-‘হ্যাঁ, বলো। আছি।’
-‘আমি এখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। সামনের ফেব্রুয়ারিতেই আমরা বিয়ে করতাম। বাড়ির কেউ এইসব জানে না। মা, বাবা কেউ না। কিন্তু ছেলেটা চলে গেল।
অর্নব বিস্মিত হয়। বলল, ‘কোথায় গেল!’ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার অনুস্মিতা বলল, ‘ও আর নেই। বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। এর আগে যে দুজন আমাকে দেখতে এসেছিল তাদেরকে এই ঘটনাটা বলেছিলাম। ওরা নোংরা নোংরা কথা শুনিয়েছিল আমাকে। তুমিও হয়ত সেই রকমই কিছু বলবে এবার। কিন্তু দেখো আমি তো এটা গোপন করতেই পারতাম। আর ওটা ইরেজ করে দেওয়া তেমন কিছু জটিল নয় আজকের দিনে। কিন্তু নিজেকে নিজের কাছে ছোটো করতে পারিনি।’
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কিছু কথা বলছে না। দুই পাশে দুই পৃথিবীতে একজন নারী আর একজন পুরুষ। মাঝখানে তৃতীয় আরেকজন। যে এখনও পৃথিবীতে আসেনি। দেখেনি পৃথিবীর আলো। দেখার অপেক্ষায় আছে।
নীরবতা ভেঙে অর্ণবই প্রথমে বলল, ‘অনুস্মিতা আমি তো তোমাকেই খুঁজছিলাম। সামনের ফেব্রুয়ারিতেই আমরা যদি বিয়েটা করে ফেলি তোমার কী কোনো আপত্তি আছে! একটু ধরো। সূপ বসিয়েছি। ওভেনটা একটু কমিয়ে দিই।’
ওভেনের আঁচ কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। শীত বাড়ছে। বাইরে তখন কুয়াশার চাদর। পৃথিবীকে মুড়ে রাখছে সযত্নে। ফোনের অন্যপাশে অন্য পৃথিবীতে এক নারী তখন কাঁদছে। আনন্দে। অশ্রুতে মিশে যাচ্ছে আলো। পৃথিবীতে এখনও এতো এতো আলো।
ফোনের এইপাশে এই পৃথিবীতে এক পুরুষের চোখেও জল। ওই সন্তান তো আমারই। বাবা বলে ডাকছে। হামি খাচ্ছে গালে।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।