সাপ্তাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (পর্ব – ২২)

অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে (প্রথম পর্ব)

আমার জন্ম পুনাতে । দাদু পুনাতে ডাক্তার ছিলেন । পুনায় একটা ছবির মত বাংলো বাড়ীতে মায়ের বাপের বাড়ী ছিল ফলত: আমার জ্ঞান হয়ে ইস্তক দেখে এসেছি প্রত্যেক বছর বাক্স, প্যাটরা বেঁধে মা পুজোর সময় বাপের বাড়ী যেতেন যতদিন দাদু চাকরী করেছেন ।
পুনা শহরে বরাবর কিছু ঘটনা ঘটেছে যার ব্যাখ্যা বুদ্ধি দিয়ে করা যায় না, এ কথা সর্বজনবিদিত । শরদিন্দু থেকে শীর্ষেন্দু সকলেই তাদের সাহিত্যকীর্তিতে বারবার বলেছেন । পুনা শহরে আমার মামাবাড়ীর পরিবারটিও এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী বৈ কি ।
আমার জন্ম হওয়ার পর বেশ কিছুদিন মা পুনাতে রয়েছেন । বাবা কলেজে পুজোর ছুটি পড়তে আমাদের আনতে পুনাতে গেছেন । পুজোর সময় প্রত্যেকবার পুনার প্রবাসী বাঙালীদের বিশাল জলসা হত ।
সে বছর অষ্টমীর রাতে মাকে জলসায় পৌছে দিয়ে বাবা বাংলোতে ফিরে আসছেন । সদ্যজাত কন্যার ঘুমন্ত মুখটি তাঁর কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় জলসার চেয়ে, তা বলাই বাহুল্য । তা ছাড়াও পুনা শহরে ইতিহাসের এক অমোঘ হাতছানি ছিল । ইতিহাস প্রিয় মানুষ যে বারবার সেই শহরে গিয়ে ইতিহাসের পথেই হাটার আনন্দ পাবেন এ তো জানা কথা । পুজোর প্রাঙ্গণ থেকে দাদুর বাংলোতে ফিরতে গেলে একটা বিশাল গির্জার পাশ দিয়ে আসতে হত । সেই বিশাল গির্জার স্থাপত্য বাবাকে খুব টানত । বাবার উচ্চতা ছয় ফুটের উপরে ছিল । লম্বা লম্বা পায়ে গির্জার পাশের রাস্তাটা ধরে বাংলোতে ফিরে আসাটা বেশ উপভোগ্য ছিল বাবার কাছে ।
সেদিন নক্ষত্রের আলোতে পথ রূপোলী হয়ে রয়েছে । গির্জার পাথুরে দেওয়াল ছুঁয়ে ঠিকরে যাচ্ছে রূপোলী আলো । বাবা হাটতে হাটতে হঠাৎ খেয়াল করলেন ঠিক হাতখানেক দুরত্বে এক ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছেন, একটা ছাইরঙা জামা পরনে । বাবা ভাবলেন ভালোই হল এই লোকটির সঙ্গে যাওয়া যাক । তিনি চেষ্টা করলেন লোকটির পাশে পাশে হাটার । যতই জোরে পা চালান না কেন, কিছুতেই সেই আগন্তুকের কাছে পৌঁছতে পারেন না । দুজনের দুরত্ব সমান থেকে যায় । এ ভাবে যত জেদ বাড়ে তাঁর, তত তিনি গতি বাড়ান কিন্তু ব্যাবধান সেই একই থেকে যায়, এক অলিখিত, অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এমন করে চলতে চলতে বাংলোর পাঁচিলের কাছে এসে সেই পথিক স্রেফ উবে গেল । গেট ঠেলে বাংলোতে ঢুকে বাবা ঘড়ি দেখলেন রাত প্রায় এগারোটা । যে পথ আসতে তাঁর দশ মিনিট লাগে তা অতিক্রম করতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেছে । বাবা পরে শুনেছিলেন এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে । বাবা ঘোরতর অবিশ্বাসী হয়েও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন শরীরবিহীন অস্তিত্বরা যদি থাকেও তাঁরা ক্ষতি করে না । সেদিন বোধহয় সেই অস্তিত্ব পথ দেখাতেই এসেছিল । হয়তো বোঝাতে এসেছিল অনেক প্রতিযোগিতা প্রাণপণে পা চালিয়েও জেতা যায় না ।
পুনার এই বাংলোটিতে আরও কিছু অভিজ্ঞতার গল্প, মামার বাড়ীর মজলিসি আড্ডায় অনেকবার শুনেছি । তাই জন্যই কিনা জানি না ‘ভূত’কে, অতীতের পারসনিফিকেসন ভাবতে শিখেছি আর একথাটাও মজ্জাগত হয়ে গেছে যে ভূতেরা নাকি ‘ মানুষ’ ভালো হয় । ভয় করলে রবি ঠাকুরের গান গাইতে হয় ‘অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে’, তাহলেই আর ভয় করে না । ভয় ফুড়ুৎ করে উড়ে পালায় ।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।