• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৫)

‘যেনাহং নামৃতা স্যাং’

৪৮

কলেজ থেকে ফিরে শ্যামলী দেখল বৈঠক খানা ঘরে কয়েকজন বয়স্ক লোক বসে আছেন ।
আপনারা কাউকে খুঁজছেন?
আমরা তোমার বাবার পরিচিত । শ্রমিক সংগঠন করি । তোমার বাবার সাথে আমরা এক দু জন দেখা করে এসেছি । তিনি তোমার সাথে কথা বলতে বলেছেন।
আপনারা সকলে চা পেয়েছেন? শ্যামলী পরিস্থিতি আঁচ করে নেবার সুযোগ খোঁজে ।
সে তোমার মা থাকতে ওসবের ভাবনা কোরো না। তোমাদের বাড়ির আতিথেয়তা এ অঞ্চলে বিখ্যাত ।
শ্যামলী মুখে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে রাখতে চায়।
প্রবীণ একজন বললেন তোমার বয়স যে এত কম তা আমরা ভাবতে পারি নি। আমাদের ছেলে মেয়ের বয়সী তুমি । তুমি করে বলছি বলে মনে কিছু কোরো না।
আপনারা কি একটাই শ্রমিক সংগঠন করেন , না আলাদা আলাদা ?
মামণি, তুমি একটা শক্ত প্রশ্ন করলে । শ্রমিকের একটাই জাত। শ্রম বিক্রি করা তার জাত ব্যবসা । সব শ্রমিকের একটাই সমস্যা , একটাই যুদ্ধ । তুমি প্রশ্ন করবে, তাহলে শ্রমিকের এতগুলো দল কেন? ওই জবাব দিতেই আমরা দল বেঁধে এসেছি । আলাদা আলাদা সংগঠন হলেও দরকারে শ্রমিককে জোট বাঁধতে হয়।
কি কি সংগঠন তাই জানতে চাইছিলাম ।
আছে নানা রকম । বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আলাদা আলাদা শ্রমিক ফ্রন্ট ।
বুঝেছি । কিন্তু আমায় কি সকলের সাথেই কথা বলতে হবে, না কি, আপনাদের মধ্যে বিশেষ কেউ আমার সাথে কথা বলবেন?
আমরা সবাই এসেছি, সবাই কথা বলতে চাই ।
আমি সবার সাথেই কথা বলবো । বলুন কি বলবেন , কি জানতে চান ।
দ্যাখো, তুমি একটা খুব কাঁচা কাজ করে ফেলেছ । ছেলেমানুষ বলেই এটা হয়েছে । পাকা মাথার কাজ আদৌ নয়। এভাবে একটা কারখানায় তুমি তালা দিতে পারো না। শ্রমিকের অনেক নিয়ম আছে, সেগুলো জানতে হয়। নোটিশ দিতে লাগে । লেবার কমিশনার আছেন । অনেক আইন আছে।
আমি কারখানায় গিয়ে দেখেছিলাম সব কিছু হাঁ করে পড়ে আছে। কেউ কোথাও নেই । কারখানার যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাবার ভয়ে আমি তালা দিয়েছি।
একটু ভুল বললে মা। কেউ কোথাও নেই , কাউকে না দেখে তুমি তালা দিয়ে ফেলেছ – এটা ঠিক বলছ না। এই লোকটা সে সময় কারখানায় কাজ করছিলো ।
সবার পিছন থেকে সেই তোতলা লোকটা বেরিয়ে এলো । বার কতক আমি আমি করে কিছুতেই পুরো কথাটা বলে উঠতে পারল না সে।
মামণি, তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলে যে কারখানাটা তুমি নিজের দখলে নেবে, আর তাই এই লোক টাকে তুমি ধূপ কেনার অছিলায় বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলে । কেমন, সত্যি কথাটা বলো ?

৪৯

আসলে সত্যি জিনিসটা খুব কঠিন । আমরা অনেক সময় আমাদের সুবিধে মত করে সত্যের একটা চেহারা খাড়া করি । কিন্তু তলিয়ে দেখলে সে চেহারা সদা সর্বদা কাজ দেয় না। আমি যে কারখানায় ঢুকে ছিলামদ, এটা যেমন সত্য, তেমনি কারখানায় তালা বন্ধও আমি করেছি, নিজের হাতে করেছি, এটাও নিখাদ সত্য ।
এই তো, তুমি নিজের ভুল স্বীকার করে নিলে । অল্প বয়স, মাথা ঠিক রাখতে পার নি । এবার তালা খুলে দাও । লোকগুলো কাজ করুক ।
না, আমার কয়েকটা বিষয় দেখানোর আছে ।
যেমন?
ধরুন , আমি ওই শ্রমিক ভদ্রলোককে ধূপ কিনে আনতে বললাম। কি, আপনাকে আমি ধূপ কিনে আনতে বলেছিলাম তো?
হ্যাঁ , সেটাই তো আমরাও বলছি। আর যেই ও বেচারি বেরিয়ে গিয়েছে, তুমি পট করে তালা লাগিয়ে দিয়েছ ।
না, এর মধ্যে আর একটা কথা আছে।
আবার কি কথা?
সত্যের তো ওই মজা ! একটা সত্যের ভেতর থেকে আর একটা সত্য উঁকি দেয় । সবটা না জানলে সামগ্রিক সত্যটাকে জানা যায় না। তা, আমি ওই শ্রমিক ভদ্রলোককে ধূপ কিনে আনতে বললাম। কি , আপনাকে আমি ধুপ কিনে আনতে বলেছিলাম তো?
এক কথা নিয়ে প্যাঁচাচ্ছো কেন?
একটু ধৈর্য ধরে শুনুন ।
কি , আপনাকে আমি ধুপ কিনে আনতে বলেছিলাম তো? ও মশাই , সকলের সামনে পরিস্কার করে বলুন না কেন?
প্রবীণ শ্রমিক নেতাটি বলেন এ বেচারার তোতলামির সমস্যা আছে । আর তোমার মতো কালচারড মেয়ের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা ওর নেই ।
শ্যামলী বলে, আচ্ছা, তাহলে আপনি শুধু হ্যাঁ বা না বলুন।
বলুন তো, আপনাকে আমি ধুপ কিনে আনতে বলেছিলাম?
হ্যাঁ । শ্রমিকটির গলায় সুস্পষ্ট রাগ ঝরে পড়ে ।
টাকা দিয়েছিলাম?
হ্যাঁ । শ্রমিকটি বলেন । নেতারা উসখুস করেন। শ্যামলীর কথা কোন দিকে মোড় নেবে আন্দাজ করে তাঁদের উদ্বেগ বেড়ে চলে ।
কত টাকা দিয়েছিলাম?
পাঁচ টাকা ।
ধুপের প্যাকেটের দাম কত?
মহা মুশকিল তো ? আপনি এখন ধূপ নিয়ে প্যাচাল পাড়বেন না কি? পিছন থেকে তুলনায় কম বয়সী শ্রমিকেরা গর্জে ওঠে ।
শ্যামলী ওদের কথায় কান না দিয়ে আবার জানতে চায় – ধূপের প্যাকেটের দাম কত?
আট আনা।
আট আনার জিনিস কেনার জন্যে একজন পাঁচ টাকা দিয়ে দিল ? আপনি খুচরো চাইলেন না কেন?
দ্যাখ মা, তোমাকে তো বলছি, এরা সাদা সরল লোক । তোমার মতো বুদ্ধিদীপ্ত একটা মেয়ে একটা কথা বললে এরা না করে পথ পায় না ।
আচ্ছা, বলুন তো আপনি আমায় চিনতেন? আগে দেখেছেন?
রাগত ও বিরক্ত স্বরে শ্রমিকটি বলে ওঠে – ন্নাঃ বাপের জম্মে দেখি নি !
ভাল করে চিন্তা করে দেখুন , আগে দেখেছেন কি না?
প্রবীণ শ্রমিক নেতাটি বলেন – এ লোকটা নতুন । তোমাকে চিনতো না।
তাঁর কথায় কান না দিয়ে শ্যামলী বলে , তা হলে, কারখানায় কে একটা মানুষ ঢুকে পড়ে আপনাকে ধূপ আনবার জন্যে পাঁচটা টাকা গছিয়ে দিল বলেই আপনি লাখ লাখ টাকার মেশিনপত্র তার হাতে ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেন? আপনারা ভেবেছেনটা কি? মগের মুলুক পেয়েছেন?
শ্যামলীর কথার দমকে জানালার কাচের শার্সি ঝন ঝন করে কেঁপে ওঠে ।
প্রবীণ শ্রমিক নেতাটি বলেন – তুমি কি পড়ো মা ?
শ্যামলী তাঁকে বলে – আপনি সে কথা পরে শুনবেন । আমাদের কারখানা থেকে লাখ লাখ টাকার মাল চুরি গিয়েছে – এইসব অপদার্থ লোকগুলোর জন্যে। চুরির সব মাল উদ্ধার করব – আপনারা দেখে নেবেন ? মজা পেয়ে গেছ না? শশাঙ্ক পালের হয়ে বলবার কেউ নেই না? দেশে আইন বলে কিছু নেই না?

৫০

প্রবীণ শ্রমিক নেতাটি বলেন – একটা ভুল হয়ে গিয়েছে মা , এবার কারখানা খোলো , ও বেচারাদের অন্ন কেড়ো না।
সে তো ভেবে দেখতে হবে । কি ভুল হয়েছে, কার ভুল হয়েছেদ, যাতে আর ভুল না হয় তার কি পথ, অনেক ব্যাপার ।
মা, একটা মিটমাট হোক । এ বেচারীদের পেটে অন্ন নেই । আমি তোমার বাবার বহুদিনের চেনা মানুষ । শশাঙ্ক পালের কাছে খালি পেটে কেউ এসে দাঁড়ালে পাল বাবু তাকে পেট ভরে না খাইয়ে ছাড়তো না। কি বলো না তোমরা ?
আমার বাবা অসুস্থ । আমি বাবার অস্থায়ী প্রতিনিধি মাত্র । আমি চাই আজকের আলোচনার একটা সিদ্ধান্ত হোক । একটা লেখাজোখা থাক ।
শ্রমিকদের মধ্যে একটা গুঞ্জন ওঠে ।
কি লিখতে হবে?
কারখানার ভালোর জন্যে শ্রমিক ছাঁটাই আর বেতন বন্ধ ছাড়া মালিক যে রকম সিদ্ধান্ত নেবেন তাতে আপনারা সবাই রাজি ।
পিছন থেকে অল্পবয়সী শ্রমিকেরা বলে উঠলো – ছাঁটাই না করলে আর মাইনে না আটকালে যা বলবেন তাই করবো ।
প্রবীণ শ্রমিক নেতাটি বলেন – তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
শ্যামলী হেসে বলে ওঠে – যাদের আপনি নিয়ে এসেছেন, ওরা সবাই বুঝতে পেরেছে ।
নেতারা মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন। শ্যামলী তার কলেজের ব্যাগ থেকে খাতা বের করে ফুলস্ক্যাপ কাগজ বের করে নেয় । তার পর একজন অল্পবয়সী শ্রমিককে ডেকে বলে – কারখানায় যারা থাকতে চান, তারা সবাই এই কাগজে সই করুন ।
বয়স্ক শ্রমিক নেতারা বলেন আপনি কেন সাদা কাগজে সই করাতে চাইছেন বলুন তো ?
শ্যামলী দেখে অল্পবয়সী শ্রমিকেরা সবাই কাগজটায় সই করছে । মাথা উঁচু করে দীপ্ত নয়নে সে তাকিয়ে থাকে পিছনের সারির শ্রমিকদের দিকে । সামনের সারির নেতারা উসখুস করে, এমন পরিস্থিতি তাদের সিলেবাসের বাইরে ।
বেশির ভাগের সই হয়ে গেলে কাগজটা শ্যামলী চেয়ে নিয়ে তার ব্যাগে রাখল। প্রবীণ শ্রমিক নেতাটি বলেন – তুমি যে এই শাদা কাগজে সই করালে, এর কোনও দাম নেই ।
শ্যামলী তাঁর দিকে না তাকিয়ে পিছনের সারির শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে বলে , আপনারা জানেন কারখানা কি করে চলে । আপনারা কাজ করেন, মালিকও কাজ করে । মালিক যন্ত্রপাতি মেশিন পার্টস , তেল মোবিল কিনে, ইলেকট্রিকের বিল শুধে, ব্যাংকের লোনের ঝক্কি নিয়ে থাকে, আর আপনারা তেল কালি মেখে হাড়ভাঙ্গা খেটে বাকি কাজটা উতরে দেন। কি ঠিক কি না?
অল্পবয়সী শ্রমিকেরা বলে হ্যাঁ ঠিক । নেতারা অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন ।
তাহলে কারখানা দু তরফের । মালিক তার কাজ করবে, শ্রমিক তার কাজ করবে । কি ঠিক কি না?
পিছন থেকে উত্তর আসে হ্যাঁ ঠিক।
তাহলে আমি এই হাত বাড়ালাম , কে কে আমার সাথে পুরোপুরি একমত হাত মেলাও ।
অল্পবয়সী তরুণদের ইচ্ছে হয় শ্যামলীর হাতে হাত রাখে । সংকোচে জড়োসড়ো হয়ে থাকে ।
শ্যামলী বলে কি হাত মেলাও ?
পিছনের সারির শ্রমিকেরা একসাথে বলে – ছোড়দি, তুমি কারখানা খোলো , আমরা তোমার সাথে আছি ।
মাথা উঁচু করে শ্যামলী বলে – তাহলে আমার গরীব ভাইয়েরা শোনো, আমার বাবা অসুস্থ, কারবারের আর্থিক অবস্থাও খারাপ , তবু বলছি – আমার ভাণ্ডার আছে ভরে , তোমা সবাকার ঘরে ঘরে , তোমরা চাহিলে পরে এ পাত্র অক্ষয় হবে , ভিক্ষা অন্নে বাঁচাবো বসুধা , মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা ।
এবার বেশির ভাগ শ্রমিক একযোগে বলে – তুমি কারখানা খোলো, তুমি যা বলবে আমরা শুনব ।
প্রবীণ শ্রমিক নেতাটি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন – তুমি এ কবিতাটা জানলে কি করে ? এতো ম্যাডাম গান্ধীর কবিতা। উনি বিশ্বের দরবারে এ কবিতা বলেছিলেন ।
হ্যাঁ , উনি বলেছিলেন । আমিও বললাম । আসলে একটা গরিব মেয়ে এ কথা বলেছিল । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন । তোমরা সবাই মনে প্রাণে চাইলে পাল অটোমোবিলস আবার খুলবে। তোমরা শপথ নাও, চুরি করব না, চুরি করতে দেবনা, কেউ চুরি করলে জান দিয়ে লড়ব ।
হ্যাঁ , আমরা রাজি, আমরা রাজি ।
এমন সময় শ্যামলী হঠাৎ খেয়াল করল – রাস্তার ধারে জানালার পাশ দিয়ে কে যেন , সরে গেল । মুখ তার বীরু কাকার মতো ।
ক্রোধ সংবরণ করে শ্যামলী বলল কাল থেকে কারখানা খুলবে । আমি খাতাপত্র দেখবো । চোর ছ্যাঁচড়দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব ।
শ্রমিকের একে একে বেরিয়ে গেল। নেতারা রয়ে গেলেন।
লেবারদের তো ব্যবস্থা করলে । এবার আমাদের দ্যাখো ।
কি চান ?
তোমার বাবা প্রতি মাসে আমাদের কিছু হাত খরচা দিতেন । তুমি কি করবে ভাবছ?
আমার নিয়ম হচ্ছে, কিছু দাও, আর বিনিময়ে কিছু নাও । আপনারা কি দেবেন?
ছোটো একটা মেয়ে তুমি, কিন্তু কথার খুব বাঁধন তোমার।
বাবা অনেক টাকা লস করে ফেলেছেন । সেই জন্যে শরীর খারাপ হয়ে পড়েছে। কারখানা বাঁচুক , আপনাদের ফেরাব না।

৫১

আস্তে আস্তে নেতারা বেরিয়ে যাচ্ছেন । শ্রমিকেরা আগেই বেরিয়ে পড়েছেন। শ্যামলী খুব ক্লান্ত বোধ করছিল । কারখানা খুলতেই হবে । এতগুলো লোকের রুটি রুজির প্রশ্ন । এটা কেবল একটা ঘরোয়া ব্যাপার হতেই পারে না। দু একজন দাঁড়িয়ে উঠেছেন, চলেই যাবেন , কিন্তু মনে হচ্ছে আরও কিছু কথা বলতে চান। শ্যামলী একটু হাসিমুখ করে বলল – “আমি তাহলে ভেতরে যাই ?”
“না , শোনো … “ প্রবীণ নেতাটি বললেন, শ্যামলী তাঁর দিকে তাকায় ।
“তোমার মতো মেয়ে ছিল আমার একটা ।“
শ্যামলী ধৈর্য ধরে তাকিয়ে থাকে ।
“সে মেয়ে আমার মরে গিয়েছে।“ মানসিক যন্ত্রণায় চোখ মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে ভদ্রলোকের।
শ্যামলী বলে “আপনি বসুন । শরীর খারাপ লাগছে না তো ?”
ঘরের সিলিং এর দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ় বলেন – “বাচ্চা হতে গিয়ে মেয়ে আমার …”
হু হু করে দু চোখ বেয়ে জল নামে । শ্যামলী কি করবে ভেবে পায় না। কি করা উচিত , কতটা করা উচিত । টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে থাকে। মনে আসে কতো কথা। কিন্তু কি ভেবে বলে না কিছু । ভাবে বুড়ো বাপকে কন্যা হারানোর সান্ত্বনার কোনও ভাষা হয় না।
“আমি যে কী করবো ?” নিজের বাম হাতের করতলে ডানহাত দিয়ে একটা কিল মারেন প্রবীণ মানুষটি ।
“আপনি শান্ত হোন ।“
না, মেয়ের জন্যে আর আমি কাঁদি না। অনেক কেঁদেছি । আর কাঁদতে পারি না।
শ্যামলী ধৈর্য ধরে তাকিয়ে থাকে ।
কি জানো মা, ওই জামাই ধরেছে আমার ছোটো মেয়েটাকে বিয়ে করবে। আর কি জানো, বাড়ির সবাই রাজি ।
না । কিছুতেই নয় ! নিজেকে আশ্চর্য করে গর্জে ওঠে শ্যামলী ।
প্রৌঢ় প্রশ্নাতুর মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কি বলে বাড়ির লোককে বোঝাবো ? তারা বলছে অ্যাকসিডেন্ট একটা হয়ে গেছে বলে কি ছেলেটারও জীবন বিফলে যাবে? আমি যে কী করবো ?
হতেই পারে না। অন্য কোথাও বিয়ে করতে বলুন লোকটাকে ।
কি করে বলবো ? মেয়েও যে আমার খেপে উঠেছে । পনেরো বছর বয়স । সে আর স্কুলে যাবে না। জামাই দু বেলা আসা যাওয়া ধরেছে।
শুনুন, যে বৌ এর বোনকে বোন বলে ভাবতে পারে না, ভাবতে চায় না, সে একটা খাঁটি অমানুষ । আপনি কিছুতেই এটা হতে দেবেন না। লোকটিকে কড়াভাবে বারণ করে দিন ।
শ্যামলীর চোখ দিয়ে কঠিন রাগ ঝরে পড়ে ।
হঠাৎ টের পায় প্রৌঢ় তার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আছেন । তাঁর চোখদুটি হতে অগাধ স্নেহ ঝরে পড়ছে।

৫২

নেতাদের বিদায় করে শ্যামলী উপরে গিয়ে দেখল বাবা খাটে আধ শোয়া হয়ে বসে আছেন। মা তাঁর কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন । নিচে মেঝেয় বসে সবিতা পিসি বাবার জন্যে ফল কাটছে ।
সে ঘরে ঢুকতে বাবা বললেন – তুই যে সব ব্যাপারটা এতো ভালভাবে সামলাতে পারবি আমি ভাবতে পারি নি ।
সবিতা পিসি বলল – আমাদের সেই ছোট্টো মেয়েটা যে এতো রকম কথা কবে কি করে শিখে গেল জানতেই পারলাম না ।
শ্যামলী বলল – বাবা, কারখানা আমাদের খুলতেই হবে । তুমি আমায় একটা এক্তিয়ার দাও ।
বাবা বলল – কি রকম?
মেয়ে বলল – আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দাও । তাতে বলো যে তুমি আমায় এইসব কাজ করতে দায়িত্ব দিয়েছ
নিজের বাবার গ্যারেজ ম্যানেজ করবি , তাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার লাগবে কেন?
বাবা, এটা দরকার। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার থাকলে আমার কাজ করতে সুবিধে হবে ।
মা বলল – হ্যাঁ , ও যা চাইছে দিয়ে দাও না ।
বাবা বললেন, তাহলে আমার টাইপ রাইটারটা দে ।
বাবার শৌখিন ব্রিফ কেসটা আলমারী থেকে কতো দিন বাদে বেরোলো । তার ভেতর থেকে থেকে বেরোল রেমিংটনের স্লিম টাইপ রাইটার ।
বাবা লেখো – আই ডু হিয়ারবাই অ্যাপয়েন্ট শ্যামলী পাল …
বাবা বললেন “আমি জানি কি লিখতে হয়…”
কারখানার প্যাডে টাইপ করা চিঠিটা খামে ভরে নিজের আলমারীতে রাখতে গেল শ্যামলী ।
সবিতা পিসি বলে উঠলো – মেয়ে হয়েছে বটে একটা, যা বলে, করিয়ে ছাড়ে।
তার দিকে একটু মুখ ভেংচে শ্যামলী গেল নিজের ঘরে । এখন তার চাই একটা চমৎকার স্নান ।

৫৩

তার ঘরে লাগোয়া একটি স্নান ঘর আছে। দিদি আর তার জন্যে শখ করে বানিয়ে দিয়েছিল বাবা । দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পরে সে একাই ব্যবহার করে এই স্নান ঘর । ভারি নিরালা , ভারি নিরিবিলি । স্নান করতে করতে গান গায় প্রাণ খুলে।
এখন ওর গলায় একটি সোনার চিকন হার ছাড়া কিছু নেই । সেই হারে আবার হিরের পেনডেন্ট । সব গয়না খুলে রেখে দিয়েছিল সে । এক রকম রাগ করে । এটা সে পরত না। মায়ের কাছে আলমারীতে রাখা ছিল। মা আজ কলেজ যাবার সময় নিজের হাতে পরিয়েছে । বলেছে হিরে সৌভাগ্য আর শক্তির প্রতীক । মা যেন কী । মা তো জানে না হিরে হল কারবনের একটা রূপভেদ । অ্যালোট্রপি । সামান্য কারবন । সে নাকি সৌভাগ্য আর শক্তির প্রতীক । তাহলে যে কোনো কারবনই সৌভাগ্য আর শক্তির প্রতীক । কলেজ যাবার সময় মায়ের সাথে তর্ক জুড়বার ফুরসত ছিল না। সবিতা পিসি আদর করে বলেছিল – বাবা মা জীবন্ত দেবতা। তাদের কথা ফেলতে নেই । সে কথা নিয়েও তর্ক করতে ইচ্ছে হয় নি । হিরের পেনডেন্ট টা দেখতে বেশ সুন্দর । নিজেকে আয়নায় দেখতে ভাল লাগছে শ্যামলীর ।
বাঃ , আজ তোকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে তো
কেন দেখাবে না
দর্পণে নিজের প্রতিকৃতির সাথে গল্পে ডুবে যায় শ্যামলী ।
তার মনে পড়ে অজ্ঞাতবাসের সময় দ্রৌপদী যখন কাজ খুঁজতে এসেছেন , বিরাটরাজার রাণী সুদেষ্ণা তাঁকে বলছেন – তুমি দাসী হতেই পারো না । তোমার শরীরের গ্রন্হিগুলো সব গুপ্ত , ভীষণই মসৃণ । দুই ঊরু পরস্পর সম্মিলিত । তোমার শরীরের তিনটি জায়গা খুব অভীষ্টভাবেই নিচু এবং গভীর , আর ছ’টি জায়গা অভীষ্টভাবেই উঁচু , উন্নত । যে – তিনটি গভীর , সেগুলি হল – তোমার নাভি , স্বভাব এবং কন্ঠস্বর । আর যে ছ’টি উন্নত , সেগুলি হল – তোমার স্তন-যুগল , নিতম্ব যুগল, নাসিকা এবং মন। পাঁচ জায়গায় তোমার রক্তবর্ণের সুলক্ষণ – তোমার দুই পায়ের পাতা , দুই হাতের তালু এবং তোমার অধর-দেশ। তোমার কথা রাজহংসের মতো গদগদ-গম্ভীর। তুমি সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণীপয়োধরা – এই রূপ-ই তোমাকে কাশ্মীরী তুরঙ্গমীর মতো করে তুলেছে ।
কাশ্মীরী তুরঙ্গমী … আয়নার সামনে নিজেকে একটা ছুটন্ত ঘোড়া বলে কল্পনা করে শরীরে বিভঙ্গ তুলল মেয়ে ।

৫৪

স্নান শেষে ঘরোয়া পোশাকে লাগোয়া ছোটো ছাতটিতে সে গেল । দিনমণি অস্তে চলেছেন। কতকগুলো বক কোথায় উড়ে গেল । কাকের দল ফিরছে সারা দিনের ব্যস্ততার পর । সব পাখি ঘরে ফেরে । এমন সময় কাদের কথা ভেবে শ্যামলীর মন আকুল হল ।
ও মন , মন , তুমি কার কথা ভাবো?

৫৫

ঘরে এসে নিজেকে ডুবিয়ে নিল অঙ্কের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ পরে একবার মনে হল বাবাকে দেখে আসি। রেমিংটনের স্লিম টাইপরাইটারটা দেখে ওর মনে পড়ে গিয়েছে আর একটা জিনিসের কথা। সেই চোঙ ওয়ালা গ্রামোফোন । রেকর্ড গুলোও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে । বাবা শুয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। গান শুনলে বাবার ভাল লাগবে ।
বাবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখল – কারা যেন দুজন বসে আছে। আচ্ছা বিকেলে বুঝি এদের কথাই তার মনে হয়েছিল । ঘরোয়া পোশাক সম্বন্ধে সহসা সচেতন হয়ে দরজার পরদাটাই একটু জড়িয়ে নিলো গায়ে ।
বাবা বলল, আয় , দ্যাখ , কারা এসেছে ।
মেয়ে বলল , বাবা ওঁদের বসতে বোলো। আমি এক মিনিট যাবো আর আসবো ।
ঘরোয়া পোশাকের ওপর একটা অ্যাপ্রন জড়িয়ে ফিরে এলো শ্যামলী ।
এক গাল হেসে বললো , জানেন , আজ বিকেলেই আপনাদের কথা ভাবছিলাম ।

৫৬

কি করে বুঝবো ? কাকা বাড়ি ফিরে এসেছেন , আমাদের তো কেউ জানায় নি ।
বাবা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন – তাতে তোমরা দোষ নিয়ো না। ও দশ হাতে কতো কাজ সামলাচ্ছে ।
সত্যি বলছি আপনাদের কথা ভুলি নি । বিপদের দিনে যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন …
স্মিত মুখে দীর্ঘতর যুবকটি বলে – কাকা, এখন কেমন আছেন?
শশাঙ্ক পাল বলেন – শ্যামলী আর তার মা মিলে আমায় বন্দী করে রেখেছে…
অন্য যুবকটি বলে – স্নেহের শাসনে বন্দী ।
শশাঙ্ক পাল হাসেন। দীর্ঘতর যুবকটিকে বলেন – জানো , তোমার জ্যাঠামশায় আমাকে খুব ভালোবাসতেন । উনি আমায় কারবারে খুব উৎসাহ দিতেন। ওঁর বেবি অস্টিন গাড়ি ছিল একটা । মাঝে মধ্যেই সেটাকে চেক করাতে আনতেন । দেখে শুনে বলতাম, ডাক্তারবাবু , আপনার গাড়ি তো ঠিকই আছে । কোনো গোলমাল তো নেই । উনি হেসে বলতেন , বাচ্চা কি না, চেক আপে রাখা ভালো । জোর করে হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছেন কতো দিন। আচ্ছা, ডাক্তারবাবু এখন কোথায় আছেন?
যুবকটি বলে – জ্যাঠামশায় এখন দিল্লিতে থাকেন । জ্যাঠাইমা মারা যাবার পর দিদি ওখানে নিয়ে চলে গেছে।
কি করে ওঁদের মেয়ে ?
দিদি খুব বড়ো অফিসার । ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দাঁড়িয়ে তোলা একটা ছবি পাঠিয়েছে ক’মাস আগে।
বাবার সাথে ওরা দু জনে বেশ গল্পে ডুবে গিয়েছে ।
ঘরের দেওয়ালে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। এই বিবেকানন্দ গেরুয়াধারী দণ্ডপাণি নন । মাথায় পাগড়িও নেই। কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একটা দৃপ্ত ভঙ্গিমা। মুকুটহীন রাজার মতো লাগে। বেলুড় মঠে নিয়ে গিয়ে বাবা বলেছিল স্বামীজীর একটা ছবি নাও। শ্যামলী তখন ক্লাস এইটে পড়ে । বাবা বলেছিলেন এই ছবিটা কেন পছন্দ করলি ? মেয়ে বলেছিল – এটাই ভালো । বাবা আর কিছু বলেন নি। ওটাই নিয়েছিলেন। ক্লাস এইটে বাবাকে বলা যায় নি এই সপ্রাণ তেজোময় যুবকটিকেই তার ভালো লাগে। এখন বোঝে, কতোখানি হৃদয় থাকলে তার টানে একটি ব্যক্তিত্বময়ী শিক্ষিকা নিজের স্বদেশ স্বজন পরিমণ্ডল ছেড়ে ভারতে চলে এসে জীবন মন প্রাণ সব সঁপে দিতে পারেন ।
বাবার ডাকে সম্বিত ফেরে। শ্যামলিমা, তোর বন্ধুদের কিছু খাওয়াবি না?
বলতে বলতে মা এসে ঢোকে । পিছনে সবিতা পিসি । হাতে খাবার।
মা ইঙ্গিত করল প্লেটগুলি ওদের হাতে নিজে তুলে দিতে। সবকিছু অনেক সহজ হয়ে গেল।

৫৭

ফিরে যাবার সময় ওদের সাথে একেবারে সদর পর্যন্ত গেল শ্যামলী । সিঁড়ি দিয়ে নামার একটু আগে ওদের একজন পকেট থেকে একটা কাগজের ঠোঙা বের করে শ্যামলীর হাতে দিল। বলল – আমাদের বাগানের কাঠ চাঁপা ।
ও মা! কাঠ চাঁপা যে আমি খুব ভালবাসি। ঘন করে শ্বাস নেয় মেয়ে। হাত বাড়িয়ে বলে আবার আসবেন। ওরা দুজনে শ্যামলীর হাত দুটি ধরে। এমন সময় শ্যামলী খেয়াল করে কে যেন সরে গেল সহসা। সবিতা পিসি ।
পিসি বরকে হারিয়েছে কোন ছেলেমানুষ বয়সে । কেউ তাকে আর বিয়ের কথা বলে নি। শ্বশুরবাড়িতেও ঠাই জোটাতে ব্যর্থ হয়েছে বাল বিধবা। অন্যের আশ্রিত হয়ে তার যৌবন ব্যর্থ হাহাকারে ফিরে গিয়েছে শ্রাবণে ফাল্গুনে । পিসির জন্যে একটু কষ্ট হল শ্যামলীর । বিদ্যাসাগর কে এদেশে কেউ মানে না। কেউ মানে নি। রবীন্দ্রনাথ ঠিক বলেছেন – বিদ্যাসাগর বড়ো একা ছিলেন। শুধু বিদ্যাসাগর? রবীন্দ্রনাথ নন? একা না হলে একাকিত্বের জ্বালা কেঊ বোঝে? আর বিবেকানন্দ ? হাহাকারের মতো করে বলছেন – এই বিবেকানন্দ কি করে গেল , আর একটা বিবেকানন্দ থাকলে বুঝতো। একাকিত্বের জ্বালায় না জ্বলতে থাকলে এ কথা কেঊ বলে?
বন্ধুদের হাতদুটি আঁকড়ে ধরে শ্যামলী । আঁকড়ে থাকা আঙুলগুলি নিজেদের মধ্যে কতো কিছু বলে নেয়।

৫৮

বাবা, কেমন লাগছে আজ?
ভালোই তো । ছেলেদুটো এসে খুব আনন্দ দিয়ে গেল ।
আমি একটু আমার ঘরে যাচ্ছি বাবা , দরকার হলে ডেকো । আগামীকাল একবার ব্যাঙ্কে যেতে হবে আমাদের ।
কেন রে শ্যামলী ?
বাবা , মনে নেই , ব্যাঙ্কের লোনটা মিটিয়ে দেবে – কথা দিয়েছিলে ।
দীর্ঘশ্বাস পড়ে শশাঙ্ক পালের ।
যা বলবি , তাই আমায় করতে হবে ?
কথা দিয়েছিলে বাবা, ঋণের শেষ রাখবে না ।
আলোটা নিবিয়ে দে । তুই নিজের ঘরে যা ।
তাহলে মশারিটা টাঙিয়ে দিয়ে যাই । অন্ধকারে মশা কামড়াবে ।
তুই কি আমায় একটু একা থাকতে দিবি না?
একা থাকবে বলেই তো মশারি টাঙাচ্ছি । মশাদের সাথে থাকা ভালো না।

৫৯

দূর থেকে কাদের বাড়ির রেডিওর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভালোবাসি , ভালোবাসি , এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি …। অঙ্কের খাতায় মন বসাচ্ছে শ্যামলী । এক চাষার ছেলের গল্প মনে পড়ে। স্কুলে না গিয়েও অঙ্কের বই পড়ে পড়ে বিজ্ঞানী হয়ে গেলেন। গাঁয়ের ছেলে হয়েও সেরা মানুষ হতে বাধে নি উইলিয়ম ফেরেলের। বাবাব্র কাছ থেকে দুটো টাকা চাইতেও বাধত ওঁর । এত গরিবানা । মায়ের আলমারি থেকে এ কোণ ও কোণ হাতড়ে যে টাকা পেয়েছিল শ্যামলী , তাই দিয়ে সংসার চলছে । কাল ফিক্সড ডিপোজিট গুলো দিয়ে ব্যাঙ্কের দেনা মেটাবে । তার পর যে করে হোক রোজগার করতেই হবে কারখানা থেকে ।
এমন সময় নিচে কাদের জড়িত কণ্ঠের চীৎকার ।
একি , এতো শান্তনু আর অতনুর গলা ! কি হয়েছে ওদের ?
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই শ্যামলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল ওরা দু ভাই।
সবিতা পিসি আর ড্রাইভার মিলে ওদের ঠেকাতে চেষ্টা করছে ।
শান্তনু আর অতনু টলছে । গা দিয়ে বিশ্রি গন্ধ ।
বোনের চুলের গোছা ধরে টান দেয় শান্তনু । মা তেড়ে এসে সবেগে চড় মারে বড়ো ছেলের গালে । কি পেয়েছিস কি তোরা ? বোনটাকে মেরে ফেলবি , আর আমি চুপচাপ দেখব?
ড্রাইভার ঠেলতে ঠেলতে ওদের রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দেয় । শ্যামলীকে বলে – ছোড়দি , তুমি ওপরের ঘরে পালাও ।
ততোক্ষণে সবিতা পিসি ওদের মাথায় রান্নাঘরের ঘড়া থেকে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে । নেশা কেটে যেতে দু ভাই মাথা নিচু করে বসে আছে ।
শ্যামলী বললো , কি রে বোনকে মারবার জন্যে নেশা করে এসেছিস? এমনিই তো মারতে পারতিস। বাড়ির মেয়েদের মারধর করতে অসুবিধে কিসের? কতো ভদ্রলোক মাকে বউকে নিয়মিত পেটায় !
হু হু করে কান্না এসে যায় ওর ।
সবিতা পিসি সবাইকে ধমকে বলে – তোরা থামবি? তোদের জ্বালায় দাদা নিচে নেমে এসেছে ।
শ্যামলিমা , আমায় হাসপাতালেই রেখে এলি না কেন? তাহলে তো ওদের এই অধঃপতন দেখতে হতো না। সিলিং এর দিকে চেয়ে বলেন – বীরু , তোকে বড়ো ভালোবেসেছিলাম রে, আর আজ এমনি করে সে ভালোবাসার প্রতিদান দিচ্ছিস ?

৬০

শান্তনু আর অতনু দু ভাই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে থাকে । মা বাবাকে ধরে ধরে ওপর ঘরে নিয়ে যায় । বাবা, মায়ের আলমারি থেকে যে টাকা পেয়েছি, তার বেশি একটা পড়ে নেই । আমায় টাকা পয়সা রোজগারের চেষ্টা করতেই হবে ।
কারখানাটা বেচে দে ।
হ্যাঁ বাবা, মাথা ধরলে কেউ মাথাটা কেটে ফেলার তাল করে? না কি, মাথাটা কিসে ভালো থাকবে সেই কথা ভাবে ?
আমি আর ভাবতে পারছি না ।
সেই জন্যেই তো আমায় চাকরি দিয়েছো । আমি দেখভাল করবো । কিন্তু একটু আধটু তো বুঝিয়ে দেবে ?
চোখের সামনে দু দুটো সা-জোয়ান ছেলেকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখলে কোন বাপের মাথার ঠিক থাকে?
বাবা, তুমি না গীতা পড়ো ! গীতায় কি বলেছে ? অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলছে – ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ … মনে করতে পারছ বাবা?
কি জানতে চাস বল ?
বাবা, কারখানার ধারবাকির কথা শুনিয়েছ , কিন্তু পাওনাও তো কোথাও পড়ে থাকতে পারে?
সে কি তারা দেবে ? কতোবার তো দেখা হলে বলেছি ?
বলেছো বাবা ?
হ্যাঁ বলেছি ।
তুমি বলেছো বাবা ? না বীরু কাকা?
বীরু বলেছে।
তাই বলো বাবা । বীরু কাকা বলেছে ।
নামগুলো মনে করতে পারবে?
আচ্ছা , মনে করে তোকে বলবো ।
বোলো বাবা ।
সবিতা পিসি বাবার খাবার নিয়ে ঢোকে । পিছনে মা। বাবা ওদের দেখে রেগে ওঠেন । আমি খাব না। খাবার নিয়ে চলে যাও ।
মা বলেন , সে কি কথা? এই আক্রা গণ্ডার বাজারে কতো কষ্ট করে তোমার জন্যে শিঙি মাছ আনিয়েছি । খাবো না বললে হবে কেন?
বলছি তো খাবো না। কে তোমায় শিঙি মাছ আনাতে বলেছে ?
মা বলেন , বলবে আবার কে? হার্টের পেশেন্ট সহজপাচ্য খাবার খাবে – এই তো জানি ।
সবিতা পিসি বলে, বাড়িটার যেন কী হয়েছে । সবাই সবার ওপর রেগে আছে । এমন তো কোনো দিন দেখি নি।
শ্যামলী বলে – “দাও খাবারটা আমার হাতে দাও । বাবা , আমার সাথে গল্প করছিল । তোমরা এসে পড়াতে গল্পে ছেদ পড়েছে বলে বাবা রেগে গিয়েছে। দাও, আমি খাইয়ে দেব ।“
মেয়ের দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকেন শশাঙ্ক পাল।

৬১

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর কারখানায় ঢুকল শ্যামলী । মা আজ বলেছিলেন তাঁর কাছে শুতে। মেয়ের জন্যে দুশ্চিন্তা তাঁর । শ্যামলী বলল – “আমায় কাল যে করে হোক কারখানা খুলতেই হবে । তার আগে হিসেবের খাতাগুলো দেখবো । তুমি চিন্তা কোরো না মা, কারখানা ভেতর থেকে তালা দিয়ে রাখবো ।“
সবিতা পিসি মাকে বললো – “হ্যাঁ , বউদি, তুমি কিছু চিন্তা কোরো না গো । আমি তো থাকছি।“
শ্যামলী অবাক হয়ে বললো “তুমি আবার কেন যাবে? আমি বেশ নিরিবিলিতে খাতাপত্র কি আছে না আছে দেখে নিয়ে ভোরবেলা চলে আসব ।“
“হ্যাঁ , ছোটো একটা মেয়ে , যাকে কেউ দেখতে পারে না, সে একাটি বাইরে থাকবে, আর যারা তাকে বড় করেছে, তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোবে ! এ হয় না শ্যামলী ।”
“আমি যে কতোদিন রাত জেগে পড়ি । আমার অসুবিধে হয় না পিসি।“
“বাড়ির মধ্যে তুমি রাত জেগে পড়ো কিংবা তা তা থেই থেই নাচো , আমি কিছু দেখতে যাবো না। রাতের বেলা তুমি একলাটি জাগবে, আর আমরা ঘুমাব, তা হবে না “

৬২

খাতাপত্র দেখতে দেখতে শ্যামলী বুঝে ফেলল বাবা এক সময় হিসেবের খাতা ঠিক রাখলেও পরে ক্রমে ক্রমে তাঁর মুঠো আলগা হয়ে গিয়েছে । ব্যবসার নিয়ম কানুন মানা হয় নি । বেহিসেবি খরচ শুরু করেছেন । আয়ের চাইতে ব্যয় বেশি হয়ে ডোবার ব্যবস্থা পাকা করেছেন। মহাজনে মালপত্র পাঠিয়েছে, কিন্তু তা স্টক রেজিস্টারে তোলা হয় নি । গাড়ি সারাতে মোটর পার্টস লেগেছে । অথচ সারাই খরচ বাবদে সর্বদা পার্টসের দাম নেওয়া হয় নি। এঞ্জিন সাফা করতে তেল মোবিল কিছু কম লাগে না। কিন্তু মজুরি নেবার সময় সে খেয়াল রাখা হয়নি। গ্রাম থেকে খালি পায়ে বেকার যুবক এলে বাবা কাজের সুযোগ দিয়েছেন , কিন্তু দক্ষতা যাচাইয়ের কথা মনে রাখেন নি । পিসির দিকে চাইলো শ্যামলী । পরিশ্রান্ত মানুষটা তক্তাপোশের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে । কার কার কাছে গাড়ি সারানো বাবদ মজুরি পাওনা থাকতে পারে সন্ধান করতে চেয়ে একটা হাত খাতা পেলো শ্যামলী । নামগুলো টুকতে শুরু করলো একটা কাগজে । আশ্চর্য কাজ করিয়ে পয়সা না দেওয়া লোকেদের মধ্যে রাম নামের ছড়াছড়ি ।

৬৩

ভোর হবে । কাকেরা গাছে গাছে চঞ্চল হয়ে উঠলো । দিনমণির দেখা দিতে এখনো খানিকটা দেরি রয়েছে । বাবার খাতা পত্র দেখে শ্যামলী মোটামুটি বুঝে নিয়েছে যে তাকে সব কিছু নতুন করেই শুরু করতে হবে । স্টোরের হিসেব রাখা । কি পার্টস কিনতে হবে , কোন পার্টস আছে, তা যেন হাতড়ে দেখতে না হয় । গাড়ি সারাই খরচা না মিটিয়ে কেউ যেন ছাড়া না পায়। কাস্টমারের গাড়ি সারানোর কাজ ধরার আগেই কিছু টাকা অগ্রিম আদায় জরুরী । কিন্তু মূলধন কি করে আসবে ?
দূরে পশ্চিমা পালোয়ানরা রামা হৈ গান ধরেছে ।
শ্যামলীর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল । রামা হৈ ।

৬৪

সারা রাত জেগে কাটিয়ে দিলি মা? জানিস, শরীর রাতে তার ক্ষতিপূরণ করে ? তাবৎ চরাচর রাতে বিশ্রাম নেয় ।
হ্যাঁ বাবা, রাতে জাগে যোগী । জাগতে রহো …
তুই কি যোগী হবি ?
না বাবা, তুমিও ঘুমাও নি, আমিও না ।
চায়ের কাপ এগিয়ে আনলেন মা, বললেন, আমিও না । শুধু বিছানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করেছি । ঘুম আসে নি।
হিসেব দেখে কি বুঝলি ?
সে কথা থাক । শুনলে তুমি খুশি হবে না বাবা।
তুই কি করবি ভাবছিস ?
প্রথমে দেনা মেটাবো । তার পর যার কাছে টাকা পাই সেটা আদায় করবো । কোনো শর্টকাট নেই বাবা।
তোমার কারখানার টাইপ মেশিনটায় বসে চিঠি বানিয়ে নিয়েছি ।
চিঠি পাঠিয়ে টাকা আদায় করবি ?
হ্যাঁ বাবা, ভদ্র পথে ।
তা হলেই হয়েছে। রঘু ডাকাত চিঠি পাঠালে নয় ভয়ে ভক্তি আসতো । তোর চিঠিতে ওরা ভয় পাবে ভাবছিস?
বাবা, বাগান থাকলে বাগানে অনেকেই বসে । বাগানে বসে পাকা আম পেয়ারা টুপ করে পড়তে দেখেও অনেকে । কিন্তু দেখলেই কেউ আর মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করে না।
ঠিক তো , অনেক ব্রেন ওয়ার্ক লাগে ।
সেটা করছি বাবা।
শশাঙ্ক পাল নিজের মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।