প্রবন্ধে আশরাফুল মন্ডল

জন্ম ঐতিহ্যমন্ডিত বাঁকুড়া জেলার সুপ্রসিদ্ধ সোনামুখী শহরের কাছাকাছি কামারগড়িয়া গ্রামে। বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। পেশা শিক্ষকতা। কর্মসূত্রে দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর চন্ডীদাস এভিনিউ-তে স্থায়ীভাবে বসবাস। নব্বইয়ের দশক থেকে লেখালিখি শুরু। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল, বিভিন্ন জেলা, কলকাতা সহ আসাম, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের কিছু পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: " কান পেতেছি উৎসমুখে" ( প্রান্তর প্রকাশনী, দুর্গাপুর ) " নাবিক হব ঝড়ের পাখি" ( পাঠক, কলকাতা )।

“ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল…”

“ওরা” বানের জলে ভেসে আসে নি। “ওরা” এই মাটির আদিম অধিবাসী। “ওরা” আত্মত্যাগী দধীচি। “ওরা” জল- মাটি- গাছ ও আগুনের মতোই পবিত্র। “ওরা” নিরন্তর মানব কল্যাণে নিজেদের নিঙড়ে দিয়েও ঋক্ বৈদিক আগমনে উচ্চকোটির সমাজজীবন থেকে বহিস্কৃত হয়ে নিচুতলায় নেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল। চর্যাগীতির রচনাকালে এই অবদমন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলেও তারা যে খুব সহজেই তা মেনে নেয় নি চর্যাগীতির গানগুলোই তার প্রমাণ। সেই পরাজিত বিদ্রোহীদের নিষ্ফল বিদ্রোহের চিহ্ন আজ সমাজ থেকে লুপ্ত হয়ে গেলেও বাংলাদেশের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শনে তার পরিচয় আজও অম্লান হয়ে আছে।
চর্যার যুগে অচ্ছুত জাতি হিসেবে যারা বিবেচিত হত, তারা ছিল এদেশের আদিমতম অধিবাসী কোল নরগোষ্ঠীর মানুষ – শবর – পুলিন্দ – ডোম – চন্ডাল প্রভৃতি বর্ণের মানুষেরা। চর্যাগীতিতে এঁদের উল্লেখ আছে। চর্যাকারগণ একেবারে অসংস্কৃত নিরক্ষর সমাজের লোক ছিলেন না। তাঁদের শিক্ষা – সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক আদর্শের কিছুটা পরিচয় চর্যাপদে মেলে। তাঁদের ধর্মসাধনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্ব প্রকাশে এইসব শবর – ডোম – চন্ডাল প্রভৃতি জাতির কথা, জীবনযাপন, চারিত্রকথা এতো বেশি করে প্রকাশিত হয়েছে যার ফলে একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এই শ্রেণির জনগোষ্ঠী সমকালীন বাঙালি জাতির একটা বড় অংশ অধিকার করে ছিল।
চর্যার কিছু পদাংশের দিকে নিবিড়ভাবে খেয়াল রাখলে বোঝা যায় সে যুগে উপরে উল্লেখিত জনগোষ্ঠীর কথা কতখানি আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছেন চর্যার রচনাকারগণ।
কাহ্নপাদের দোহায় শবরদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
” বরগিরিসিহর উত্তুঙ্গ মুণি সবরেঁ জহিঁ কিঅ বাস”- অর্থাৎ, বরগিরির শিখর উত্তুঙ্গ, মুনি শবর যেখানে বাস করেন।
২৮ সংখ্যক চর্যায় শবরপাদ লিখেছেন-
” উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী”- অর্থাৎ, উঁচু উঁচু পর্বত সেখানে বাস করে শবরী বালিকা।
৮ সংখ্যক পদে কম্বলাম্বরপাদ লিখেছেন –
” সোনে ভরিলী করুণা ণাবী। রূপা থোই নাহিক ঠাবী।।” সেকালে জলপথে দূরদেশে অনেকে বানিজ্যে যেত। তখন রূপো ছিল সোনার তুলনায় বেশ তাচ্ছিল্যের বস্তু।
১০ সংখ্যক পদে কাহ্নপাদ লিখেছেন –
“নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ” অর্থাৎ, নগরের বাইরে ওরে ডোম্বী, তোর কুঁড়েঘর।
– এই শবর – ডোমদের বিচিত্র বৃত্তির কথাও চর্যাপদে রয়েছে পরোক্ষভাবে। শবরদের আদিম বৃত্তি পশুশিকার। শর – ধনু ছিল শিকারের সরঞ্জাম।
৫ সংখ্যক চর্যায় চাটিলপাদ লিখেছেন –
” ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই। পারগামি লোঅ  নিভর তরই।।” নদী নালার বাহুল্যের জন্য সাঁকোর প্রয়োজন ছিল।
৩৩ সংখ্যক চর্যায় ঢেণ্ঢনপাদ লিখেছেন –
” টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী”-
অর্থাৎ, টিলায় আমার ঘর ( কোন ) প্রতিবেশী নেই।
৫০ সংখ্যক পদে শবরপাদ লিখেছেন –
” গঅণত গঅণত তইলা বাড়ী হেঞ্চে কুরাড়ী”
অর্থাৎ, গগনে গগনে তৃতীয় বাড়ি হৃদয়ে কুঠার।
– উপরে উদ্ধৃত পদগুলো পড়ে বোঝা যাচ্ছে যে, নগর জনপদ থেকে দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছিল শবরদের নিঃসঙ্গ প্রতিবেশী হীন সংসার। ডোমেরাও বাস করত জনপদের বাইরে।
ডোমেরা তাঁত-যন্ত্র তৈরি করতো এবং চাঙাড়ি চুপড়ি বানাতো। আবার নদীর ঘাটে খেয়া নৌকো পারাপারও ছিল তাঁদের অন্যতম বৃত্তি।
শুঁড়িখানার নিখুঁত চালচিত্র অনেক চর্যার পদে রয়েছে। সে যুগে মদ্যপান কোনো গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হতো না। শুঁড়িপত্নী এক ঘরে বসে মদ তৈরি করতো, অন্য ঘরে মদ বিক্রি করতো। একজাতীয় সরু বাকল বা শিকড় শুকিয়ে গুঁড়ো করে মদ চোলাই- এর জন্য ব্যবহার করা হতো। চৌষট্টিবার শোধন করে উৎকৃষ্ট মদ তৈরি করা হতো।
চর্যাপদে চিত্রিত এই শ্রমজীবী মানুষজন দরিদ্র ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের সেই দারিদ্র্য পীড়িত জীবনে আমোদ উৎসবের অভাব ছিল না। হাঁড়িতে ভাত না থাকলেও নিত্য অতিথি আসতো। ৩৩ সংখ্যক চর্যার গানে ঢেণ্ঢনপাদ লিখেছেন-
” হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী”- অর্থাৎ, হাঁড়িতে ভাত নেই, ( অথচ ) নিত্য অতিথি আসে।
নিম্নবর্ণের নারীরা উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে রাত কাটাতো।
২৮ সংখ্যক চর্যায় শবরপাদ নিষাদ রমণীর যে ছবি এঁকেছেন তাতে দেখি পাহাড়ঘেরা কোনো পুষ্পখচিত উপত্যকায় বিরহিণী এক বিষণ্ণা রমণী মাথায় দিয়েছে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় পরেছে গুঞ্জাফুলের মালা, কানে দুলিয়েছে কুন্ডল। কোনো কোনো পদে দেখি উন্মত্ত শবর – শবরী মিলনের আনন্দে একাকার হয়ে পরস্পরকে প্রবল আকর্ষণে নিষ্পেষিত করছে, তখন বহুযুগের ওপার থেকে এক রোমান্টিক প্রণয়পিপাসা যেন পালযুগীয় কোন ভাস্কর্যকে জীবন্ত করে তুলে পাঠকমনকে স্বেচ্ছায় ” suspension of disbelief ” – এর দিকে এগিয়ে দেয়। অবলীলায় বলা যেতে পারে যে, চর্যাগুলোতে তত্ত্বকথার অতিরিক্ত একটা আকর্ষনীশক্তি আছে, যাতে সেযুগের খেটে খাওয়া মানুষের যন্ত্রণাদগ্ধ, দারিদ্র্য পীড়িত, অবহেলিত দিনযাপনের মধ্যেও যেন মনে হয়, “কোথাও জীবন রহিয়াছে জীবনের স্বাদ রহিয়াছে…”
আমাদের অনুভব আর অভিব্যক্তির মধ্যে ফারাক সীমাহীন। কেননা আমরা অনেকেই আজও সর্বত্র এই অন্যতম সমাজবন্ধুদের কথা বিন্দুমাত্র ভাবি না। “ওরা” এখনও সেই তিমিরেই।
চর্যাকারগণ পদগুলোতে তাঁদের সাধনার গুহ্য গূঢ় তত্ত্ব রূপকার্থে প্রকাশ করতে গিয়ে যে সকল উপমা – রূপক, চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন তাতে তৎকালীন সময়ের ভাঙা ভাঙা টুকরো টুকরো ছবি ফুটে উঠেছে। পদগুলোতে আমরা পাই বাঙালি শ্রমজীবী জাতির “আঁতের কথা”। চর্যাপদে আক্ষরিক অর্থে তখনকার খেটে খাওয়া মানুষের “কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা” যেন আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট ক্যানভাসে ধরা পড়ে। চর্যাগীতিতে আমরা দেখি এই কর্মমুখর নিচুতলার মানুষেরাই মানব সমাজের মূল চালিকাশক্তি। অথচ এই সাধারণ মানুষেরা কখনো পাহাড়ে, কখনো কন্দরে, কখনো নদী নালার তীরে আস্তানা গেড়েছে।এই সর্বরিক্ত আদিম জাতি এক স্থান থেকে আর এক স্থানে বিতাড়িত হয়েছে বারবার। সেই ট্রাডিশন আজও অব্যাহত। দেশের এই শিকড় জনেরা আজও চর্যার যুগের মতোই গালভরা ভাষায় “ব্রাত্য জন”, “ছিন্নমূল”। এদের গৃহহারা দেশছাড়া করা মানেই আমাদের গর্বের ইতিহাসকে অসম্মান করা। মনে রাখতে হবে ” যারে তুমি নীচে ফেলো সে তোমারে বাঁধিছে যে নীচে/ পশ্চাতে ফেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”এই সোজাসাপটা বিশ্বকর্মার দল চর্যার যুগে যেমন ছিলেন কর্মের ঘর্ঘর যন্ত্রে বাঁধা, যারা এ বিশ্বকে আগামী প্রজন্মের বাসযোগ্য করে তোলার হিতার্থী ব্রতে সমর্পিত প্রাণ, ঠিক তেমনি আজও তাঁদের আন্তরিক কর্মতৎপরতায় চলছে বিশ্বসংসার, অথচ তাঁরা পড়ে আছে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর জীবনচর্চায়। মাটি ছাড়ার ফরমান পাবার অপেক্ষায়। যুগ যায় যুগ আসে ” ওরা ” তথৈবচ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।